ওরা কারা?

শীতকাল। অবন্তী লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। কিছুদিন ধরে এত্তো শীত পরেছে যে, লেপ থেকে শরির বের করলেই গা ঠক ঠক করে। অবন্তী, রাইসা, জোঁসনা, এরা তিনটা বান্ধবী। দেখে মনে হয় তিন দেহে এক প্রাণ। এই শীতের সকালে তিনজনে মোটা কাপড় গায়ে জড়িয়ে হাত ঘষতে ঘষতে কুহু কুহু করে স্কুলে যায়। স্কুলেও একই ব্রেঞ্চে বসে। আবার বিকেল বেলা একসাথে স্কুল থেকে ফিরে আসে।
স্কুল ছুটি হয় চারটার দিকে। শীতকালে এই একটাই অসুবিধা। স্কুল ছুটি হওয়ার এক-দেড় ঘন্টার মধ্যেই গভীর কুয়াশা নামতে আরাম্ব করে। পকৃতি জানান দিচ্ছে, এখন সন্ধ্যা হয়ে যাবে। যে যার মতো খেলা শেষ করে ঘড়ে ফিরে যাও। তারপর গিয়ে পরদিনের স্কুলের পড়াগুলো শেষ করে ফেল।



অবন্তীদের গ্রামটা বেশি বড় না। ছোট্ট একটা গ্রাম। অবন্তীদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই রাইসা আর জোঁসনাদের বাড়ি। দিনের বেলা গ্রামটা সুন্দর হলেও রাতের বেলা গ্রামের চেহাড়াটা একটু বদলে যায়। গা ছম ছম করে আর কী। অবন্তীদের বাড়ির পেছনে বিশাল পুকুর। পুকুরের পাশে ঝোপের মধ্যে সারাক্ষন ঝিঝি পোকা অনবরত ডেকেই যাচ্ছে। আর এই শীতকালে যেন আলাদা একটা মোহ কাজ করে।

অবন্তী স্কুলের পড়া শেষ করে খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ে। আজকেও নিয়মের ব্যাতিক্রম হল না। মুশারী টাঙ্গিয়ে লেপটা গায়ে দিয়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ল।

অনেক রাত এখন। অবন্তীর ঘুম ভেঙে গেল। রাত কয়টা বাজে সেটা অবন্তীর খেয়াল নেই। তার বাবা-মাও ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগেই। তখন হটাৎ অবন্তী খেয়াল করে দরজায় কে যেন ঠক ঠক করে শব্দ করছে। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ল সে। দরজার কাছে গিয়ে আস্তে করে বলল, কে?
ওপাশ থেকে আওয়াজ আসল, “অবন্তী! আমি জোঁসনা। দরজা খুল, কথা আছে তোর সাথে।”
অবন্তী দরজা খুলে দিল। তারপর জোঁসনা ফিস ফিস করে অবন্তীকে বলল, “এই শোন! করিম চেয়ারম্যানের বড়ই গাছে অনেকগুলা বড়ই পেকেছে, যাবি আমার সাথে? সকাল হলে আবার অন্য কেউ নিয়ে যাবে, আয় এখনি যাই।”
অবন্তী বলল, তাই বলে এতো রাতে?
- রাত হয়েছে তো কি হয়েছে?
- আমার যে ভয় করে!
- ধুর পাগলী। আমরা তিনজন যাবো। আমাদের সাথে রাইসাও যাবে। এতো ভয় কিসের হ্যা?

অবন্তী অনেক নিষেধ করার পরেও শেষমেশ অবন্তী যেতে বাধ্য হল। জোঁসনা বলল, একটা বড় পলিথিনের ব্যাগ সাথে নিয়ে আসিস।
অবন্তী চুপ করে ঘড়ের খিল আটকে ঘড় থেকে বের হয়ে গেল। তার বাবা-মা টেরও পেল না।
অবন্তী জোঁসনাকে বলল, রাইসা কোথায় রে?
জোঁসনা বলে, সামনেই অপেক্ষা করছে হয়তো। তুই তারাতারি হাঁট। নাহলে আমাদের আগে অন্য কেউ বড়ই নিয়ে চলে যাবে। তখন গিয়ে আর লাভ হবে না।

অবন্তী আর জোঁসনা দ্রুত হাঁটতে আরাম্ব করল। আজকে রাতে অনেক কুয়াশা পড়েছে। আকাশের চাঁদের আলোটাও যেন নিভে গিয়ে চারদিকের পরিবেশটা অন্ধকার বানিয়ে রেখেছে। অবন্তীর হাতে একটা ছোট্ট টর্চ লাইট। এই কুয়াশার রাতে এটা দিয়ে সর্বোচ্চ ৩-৪ মিটারের মতো দূরে দেখা যায়। তারচেয়ে বেশি দূরে আর দেখা যায় না।

একটু দূরে যাওয়ার পর অবন্তী খেয়াল করে সামনের একটা গাছের নিচে রাইসা দাঁড়িয়ে আছে। অবন্তী রাইসাকে বলল, তোর সাহস বড্ড বেড়ে গেছে দেখছি। এই রাতের অন্ধকারে একা একা এই গাছের নিচে বসে আছিস, ভয় করলো না?
রাইসা বলল, এসব কথা বাদ দে তো। চল তারাতারি, আজকে যেভাবেই হোক, চেয়ারম্যানের গাছের বড়ই আমাদেরই আনতে হবে।
- হুম চল।

আর একটু দূর। সামনেই চেয়ারম্যানের বাড়ি। সেই বাড়ির পেছনেই প্রকান্ড একটা বাগান। আর বাগানের মাঝখানেই বিশাল দেহী একটা বড়ই গাছ। বড়ইগুলা অনেক মিষ্টি। কিন্তু এলাকার দুষ্টু ছেলেদের জন্য বড়ই খাওয়াই যায় না। ছেলেগুলো গাছ থেকে পেড়ে পেড়ে নিয়ে যায়। চেয়ারম্যান লোকটাও ব্যাস্ত মানুষ। এইসব সামান্য বড়ই নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। যার যার ইচ্ছা বড়ই খাক। অসুবিধা কি? তার ছেলেপুলেরা থাকে লন্ডন। সেখানে চাকরি করে। কয়েক বছর পর পর আসে। বলতে গেলে বড়ই খাওয়ার লোক তার নেই।

বাগানটা অন্ধকার। অবন্তী টর্চ লাইট দিয়ে নিচের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল, বাহ্‌! অনেক বড়ই। অবন্তী তো অনেক খুশি। এখানে এসে মন্দ হয় নি। তাই সে জোঁসনা আর রাইসাকে বলল, এই! আমরা প্রতিদিনই আসবো এখানে, ঠিক আছে?
জোঁসনা বলল, সেটা পরে দেখা যাবে। এখনকার চিন্তা এখন কর।
তিনজনের পলিথিনের ব্যাগ প্রায় অনেকটা ভর্তি হয়ে গেল। অবন্তী নিজের মতোই কুড়াচ্ছে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই বড়ই শেষ হয়ে গেল। এখানকার সব বড়ই কুড়ানো শেষ। আর একটাও মনে হয় বাকি নেই। জোঁসনা রাইসাকে বলল, এই! পশ্চিমের দিকে চল, ওই দিকে অনেক পাওয়া যেতে পারে।
অবন্তী তাদের বলল, হয়েছে রে বাদ দে। আয় বাড়ি ফিরে যাই। আর যাস না ওইদিকে।
কিন্তু জোঁসনা আর রাইসা অবন্তীর কথা শুনল না। তারা বাগানের পশ্চিম দিকে চলে গেল। নিমেষের মধ্যে দুইজন ঘণ কুয়াশায় মিলিয়ে গেল। অবন্তী আর সেদিকে গেল না। আশেপাশেই টর্চলাইট দিয়ে খুজে দেখল, কোন বড়ই পাওয়া যায় কিনা।
কয়েকটা বড়ই কুড়িয়ে অবন্তী আশেপাশের আরো দূরে লাইট দিয়ে দুজনকে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু সাদা কুয়াশা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
অবন্তী হালকা বিরক্তি নিয়ে বলল, কোথায় গেল মেয়ে দুটা? এখনো আসছে না কেন?
তারপর অবন্তী আর বসে না থেকে বাগানের পশ্চিম দিকে গেল। অনেকখানি গেল। আশেপাশে লাইট দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। আজব ব্যাপার! তাদের দুজনের মধ্যে কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। অবন্তী জোরে ডাক দিয়ে বলল, জোঁসনা... জোঁসনা... কই গেলি? রাইসা... কোথায় তোরা?
কিন্তু কারো উত্তর পাওয়া গেল না। একসময় অবন্তী পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিন সবদিকে খুঁজে দেখল। কিন্তু বাকি দুজনের হদিস আর কোথাও পাওয়া গেল না। একসময় অবন্তী খেয়াল করে, এই পুরো বিশাল শুনশান বাগানের মধ্যে সে একা দাঁড়িয়ে। তার আশেপাশে কেউই নেই।

অবন্তী আর একটা মুহুর্তের জন্যও সেখানে দাড়াল না। হাতে থাকা পলিথিনের ব্যাগটা খামচে ধরে সোজা দৌড়। আশে পাশে আর কোথাও তাকানোর সাহস পেল না সে। অবন্তী বুঝতে পারে তার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে শব্দ হচ্ছে। এটা ভয়ের সংকেত। কোনরকম বাড়িতে এসে অবন্তী দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি ঢক ঢক করে খেয়ে, হাত দিয়ে মুখ মুছল।
বুকের মধ্যে এখনো ধরফর করছে। ভয় আর ক্লান্তিতে। এরকম ভয় অবন্তী আর জীবনে কোথাও পায় নি। অবন্তী চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। আর ভাবতে লাগল, তার দুইটা বান্ধবী তার সাথে এমনটা করতে পারল? কি লাভ হল আমাকে অন্ধকার বাগানের মধ্যে একা ফেলে পালিয়ে গিয়ে? যাদেরকে আমি এত্তো ভালোবাসি, তারাই আমাকে এভাবে ভয় দেখালো?
চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল অবন্তীর। আজকে সকালে এর বিচার হবেই হবে।

সকালবেলা অবন্তী সোজা গেল জোঁসনাদের বাড়ি। তারপর গিয়ে ওকে রাগী কন্ঠে বলল, কালকে রাতে কেন ওভাবে আমাকে বাগানের মধ্যে রেখে আসলি? আমার যদি কিছু হয়ে যেত? আমি একা রাতের বেলা কত্তো ভয় পাই জানিস না তুই? কেন করলি এমনটা? কেন ভয় দেখালি আমাকে?
জোঁসনা এতোক্ষন অবন্তীর কথাগুলো হা করে শুনছিলো। অবন্তীর কথা বলা শেষ হলে জোঁসনা অবাক ভংগিতে বলল, কি বলছিস তুই এগুলা? আমি কবে তোর সাথে রাতে চেয়ারম্যানের বাগানে গেলাম? আমিও তো তোর মত একা বাইরে যেতে ভয় পাই। আমি কেন যাব?

অবন্তীর পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। তারপর অবন্তী বলল, সত্যি বলছিস তো?
- হ্যা রে... আমি কেন তোকে মিথ্যে বলব।
- আমাদের সাথে রাইসাও তো ছিল।

অবন্তী আর জোঁসনা রাইসাদের বাড়িতে গেল। রাইসাকে অবন্তীর পুরো ঘটনা খুলে বলার পর রাইসা বলল, আমি আবার কবে রাতের বেলা বাগানে গেলাম?
অবন্তী বলল, আজকে রাতেই তো আমার সাথে বড়ই কুড়াতে গেলি।
- তুই হয়তো সপ্ন দেখেছিস রে।
- সপ্নই যদি হয়ে থাকতো তাহলে আমার ঘড়ে এখনো সেই এক পলিথিন পাকা বড়ই কেন পড়ে আছে?

এখন অবন্তী এটাই ভাবছে, তাহলে রাতের বেলা যে তার সাথে বড়ই কুড়াতে গেল, তারা কারা?

- মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল

Comments

Popular Posts