জঙ্গল


সেদিন বিকেলবেলা খবর আসলো, আমাদের বন্ধু রাজিবের ছোটবোনের বিয়ে। অনেক বড় আয়োজন। বন্ধু বলেছে, যে করেই হোক, যেতেই হবে। এরকম একটা সুন্দর সময় বন্ধুদের ছাড়া না কাঁটালে ব্যাপারটা জমে না। তাই আমরা তিন বন্ধু, আমি, মাসুদ আর সোহাগ মিলে চিন্তা করলাম কালকে সকালের মধ্যেই রওনা হয়ে যাবো। সেদিন রাতেই আমাদের ব্যাগপত্রগুলো গুছিয়ে রেখে দিলাম। ক্যামেরা, চার্জার, কিছু জামাকাপড় ইত্যাদি তুলে রাখলাম সেদিনই।
আমরা তিন বন্ধু ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি। ছোটবেলায় রাজিবও আমাদের অনেক ভালো বন্ধু ছিলো। কিন্তু তার বাবা তাদের ফ্যামিলি নিয়ে অন্য শহরে চলে যায়। এখন মাঝে মাঝে ফোনে আলাপ হয়। দেখা তেমন একটা হয় না। তাই এইবার রাজিবের বোনের বিয়ের দাওয়াতটা আমরা কেউ মিস করতে চাই না। মাসুদের গাড়িতে আমরা যাবো। ছেলেটা ভালোই ড্রাইভ করে। যেতে আনুমানিক তিন ঘন্টার মতো লাগতে পারে। আড্ডা দিতে দিতেই তিন ঘন্টা পার হয়ে যাবে।

সকাল বেলা খেয়েদেয়ে আমরা বের হয়ে পরলাম। শীতের সকাল। কুয়াশাটা এখনো বেশি কাঁটে নি। চারদিকে তাকালে এখনো ধু ধু সাদা। এই আবহাওয়ায় গাড়ি চালাতে হবে আস্তে আস্তে। তিন ঘন্টার জায়গায় ৪-৫ ঘন্টাও লাগতে পারে। বিসমিল্লাহ্‌ বলে মাসুদ গাড়ি স্টার্ট করল। মাসুদ আর সোহাগ একসাথে সামনে বসেছে। আর আমি একা পেছনে। একটু পর পর হর্ণ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে মাসুদ। গাড়িতে বন্ধুরা মিলে নানান ধরনের কথাবার্তা বলছি আমরা।
সোহাগ একসময় বলে উঠল, বুচ্ছিস ছেলেদের জীবনটা কতো ঝামেলার।
- কেন? ঝামেলার আবার কী দেখলি?
- রাজিবের ছোট বোন রাজিয়া। এই দু দিন আগেই পিচ্চি আছিলো। মনে আছে?
- হ্যা। তো?
- আজকে নাকি তার বিয়ে? আর এদিকে আমরা ছেলেরা? এখনো আমাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। আর বিয়ে তো দূরের কথা। বাবা-মায়েরা এখনো আমাদের শিশুই মনে করে বুচ্ছিস?
আমি বললাম, এতোই যখন চিন্তা হচ্ছে তাহলে বিয়েটা করছিস না কেন? তোকে আটকিয়ে রেখেছে কে?
রাজিবের মনটা এক্কেবারে চুপসে গেল। আমি আবার বললাম, কাউকে পছন্দ করে থাকলে বল, আমরা ব্যাবস্থা করে দিতে পারি।
- আর পছন্দ। তেমন কেউ নেই রে।
- আহারে! কী কষ্ট কী কষ্ট...
- এমন করছিস কেন? তর কী একটা মুরোদ হবে?

এভাবে অনেক্ষন আলাপ হলো আমাদের মধ্যে। কুয়াশার পরিমান আস্তে আস্তে কমছে। যাক! একটু ভালোই গতিতে গাড়ি চালানো যাবে। তিন বন্ধু গান গাইতে গাইতে এগোতে লাগলাম। সবকিছু ঠিকভাবেই চলছিলো। কিন্তু একটু পরেই হলো ঝামেলাটা। সামনে নাকি লম্বা জ্যাম। জ্যামের কারন জানতে পেরে বুঝতে পারলাম রাস্তার মাঝখানে দুইটা ট্রাকের ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছে। সবকিছু স্বাভাবিক হতে নাকি অনেক সময় লাগবে।
এদিকে রাজিব বার বার ফোন করে বলছে, আর কতোক্ষন লাগবে রে? তারাতারি আয়। তোদের জন্য অনেক্ষন ধরে অপেক্ষা করছি।
আরে! চিন্তা করিস না। রাস্তায় জ্যাম। সামনে ট্রাক অ্যাকসিডেন্ট করেছে। আসতে একটু দেরি হতে পারে। তুই চিন্তা করিস না।
- দুপুর হয়ে এলো। একটু পরে অতীথিদের খাওয়ানো হবে। ভেবেছিলাম তোদের সাথে কয়েকটা পিক তুলবো। তা মনে হয় এইবার হবে না।
- আরে পাগল। তুই চিন্তা করিস না তো। আমরা ঠিক সময়ই এসে যাবো।

মাসুদ গাড়ি ঘুড়িয়ে ফেলল। আমরা বললাম, কী রে, কোথায় যাবি?
মাসুদ সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, শর্টকাট। এই রাস্তা দিয়ে গেলে আজকে রাত হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং আমার একটা রাস্তা জানা আছে। সেখান দিয়ে যাবো।
আমি বললাম, ভালো তো। চল তাহলে। এই জ্যামের মধ্যে বসে থেকে সময় নষ্ট করে কোন লাভ নেই। তার চেয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে যাওয়াটাই ভালো।
সোহাগ বলল, মুভিতে দেখেছি শর্টকাট রাস্তাগুলো সবসময় ভয়ানক হয়। আবার যেন মুভির সাথে আমাদের মিলে না যায়।
মাসুদ সোহাগকে থামিয়ে দিয়ে বলল, যত্তসব ফালতু কথা। মুভির সাথে বাস্তবের তুলনা করবি না। মুভির ঘটনাগুলো হতে হয় জটিল। জটিল না হলে সেটা গল্প হয় না। কিন্তু মানুষের বাস্তব ঘটনাগুলো হয় সরল। বুঝেছিস?
আমরা মাথা নাড়ালাম।

মাসুদ ড্রাইভ করতে করতে আমাদেরকে একটা জঙ্গলের সামনে নিয়ে আসলো। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চিকন রাস্তা। মাসুদ বলল, এই রাস্তা দিয়ে গেলে অন্তত আমাদের দু ঘন্টা সময় বেঁচে যেত।
আমি বললাম, তুই এই রাস্তা চিনলি কিভাবে?
- কিভাবে আবার? ম্যাপ দেখে।
ফোনের লোকেশন বের করে দেখতে পারলাম সামনের জঙ্গলটাকে। বিশাল বড় জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে একটা রাস্তা দেখা যাচ্ছে। ছত্রিশ কিলোমিটার লম্বা জঙ্গলের রাস্তাটা। একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এতো ঘণ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এতো লম্বা রাস্তা। ব্যাপারটা আমার কেমন যেন লাগতে লাগল।
মাসুদ গাড়ি স্টার্ট করল। গাড়িটা জঙ্গলের রাস্তায় প্রবেশ করল। যাক। রাস্তাটা খারাপ না। মাটির রাস্তা। চারদিকে ঘণ গাছপালা। সুর্যের আলো বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। গাড়ির স্পিড ভালোই ছিলো। তিনজনে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছি। মাসুদ হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করায় আমরা একটু চমকে গেলাম। গাড়ির পাশে একটা পাগল মতো লোক দাঁড়িয়ে আছে। গ্লাসটা নামানোর পরে পাগল লোকটা বলল, এইখানে কী চাই? এই রাস্তায় এসেছেন কেন?
- বিয়ের দাওয়াতে যাবো সবাই। আপনিও চলুন আমাদের সাথে। একসাথে মজা করা যাবে।
কথাটা বলার পর সবাই হো হো করে হেঁসে দিলাম।
লোকটা বলল, হাঁসি পাচ্ছে? আমার কথা শুনে হাঁসি পাচ্ছে?
- বলি রাস্তাটা কি আপনার? যে আপনাকে জিজ্ঞাস করে এখানে ঢুকতে হবে?
লোকটা ভয়ানক ক্ষেপে গিয়ে বলল, সবাই মরবে এই রাস্তা দিয়ে গেলে। অনেক বছর ধরে শোনা যাচ্ছে এই জঙ্গলটাতে মানুষ খেকোর আগমন হয়েছে। জবাই করে নাকি মানুষের মাংস খায়।
লোকটার কথা শুনে মাসুদ বলল, ভালোই তো জোক্স বলতে পারেন আপনি। আমাদের এভাবে ভয় দেখালেই কি আমরা চলে যাবো? যত্তসব পাগল কোথাকার। কোথা থেকে যে আসে এগুলা। গিয়ে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করগে। এই জঙ্গলে কী?
এই কথা বলে মাসুদ গাড়িটা স্টার্ট করে রওনা হল। পাগল মতোন লোকটা তাদের গাড়ির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে আতংকের একটা ছাপ দেখা গেল। আমি খোয়াল করলাম লোকটা পেছন থেকে এখনো আমাদের ডাকছে। নাহ্‌! লোকটার সাথে এরকম খারাপ ব্যাবহার করা ঠিক হয় নি। ভালোভাবে বুঝালেই হত।

সবাই গাড়িতে গান শুনতে শুনতে যাচ্ছিলাম। লোকটার কথা ভুল প্রমানিত হল। এতো সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ না দেখলে তারা অনেক কিছুই মিস করত। এখান দিয়ে এসে ভালোই হয়েছে। আমরা গানের সাথে তাল মিলিয়ে গলা ছেরে গান করছি।

"আমি এসেছি আবার তোমার কাছে ফিরে,
হাতটা ধরেছি যেতে দেব না দুরে।
বুকের মাঝে আগলে লাগতে চাই তোমাকে..."

গানের তালে তালে আর বাইরের প্রকৃতির মোহে যেন কিছুক্ষনের জন্য সবাই অন্ধ হয়ে গেছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষন পরে একটা জিনিস খেয়াল করে আমার কেমন যেন লাগতে লাগল। আমি খেয়াল করলাম, আমাদের চারপাশের জঙ্গলটা আস্তে আস্তে কেমন জানি অন্ধকার হয়ে যেতে আরাম্ব করল। জঙ্গলের গাছপালা যেন ক্রমশ আরো ঘণ হয়ে যাচ্ছে। আকাশটাই ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না এখন। মাসুদকে বললাম, কিরে? এটা কোথায় আসলি? আমরা ঠিক পথে যাচ্ছি তো?
মাসুদ বলল, দূর পাগল। চিন্তা করিস না। আমরা তো হাইওয়ে দিয়ে আসছি না। আসছি জঙ্গল দিয়ে। একটু ঝামেলা তো সহ্য করতেই হবে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ২ টা বাঁজে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম, একটু নেটওয়ার্কও নেই। নো সার্ভিস লেখা। মাসুদকে বললাম, আসলেই লোকটার কথা মনে হয় আমাদের শোনার দরকার ছিলো রে। আমার বিষয়টা সুবিধার লাগছে না।
মাসুদ আয়নায় আমাকে দেখে বলল, অসুবিঝার কি পেলি?
- জঙ্গলটায় একটু নেটওয়ার্কও নেই। কারো সাথে যে যোগাযোগ করব, তার উপায়টা নেই।
- সালা। এই ঘণ জঙ্গলে টাওয়ার বসাবে কে? তোর শ্বশুর? এখানে কি জন্তু জানোয়াররা মোবাইল ইউজ করে? যে টাওয়ার লাগিয়ে তারা কথা বলবে? জঙ্গলেই যদি সব সুবিধা পাওয়া যেত তবে আর কেউ বড় বড় অট্টালিকা বানাতো না। এই জঙ্গলেই থাকত।
- হয়েছে হয়েছে। বড্ড ভুল হয়ে গেছে আমার।

সোহাগ এতক্ষন কানে ইয়ারফোন দিয়ে গান শুনছিলো। গান শুনতে শুনতে হয়তো ঘুমিয়েও গিয়েছিলো। তাই ধরমর করে উঠে আমাদের জিজ্ঞেস করল? কিরে পৌছাই নি এখনো? সন্ধ্যা হয়ে গেছে নাকিরে? কয়টা বাঁজে? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, প্রায় তিনটা বেঁজে গেছে।
সোহাগ মোচর দিয়ে বলল, কিরে মাসুদ? বড্ড খুধা লেগেছে। বন্ধুর বাড়িতে খাবো বলে সকালে সামান্য নাস্তা করে এসেছিলাম। এখন পেটের অবস্থা কাহিল। আশেপাশে কোন হোটেল আছে নাকি রে? থামাস তো তখন।
মাসুদ বিরক্ত হয়ে বলল, হুম। সামনেই একটা হোটেল বানিয়ে রেখেছে তোর জন্য। এই জঙ্গলে তুই হোটেল পাবি কোথায় রে বাছা? এখানে কে আসে?
- কেউ যদি নাই আসতো তাহলে এই রাস্তাটা কিসের জন্য? কত সুন্দর ইট বিছানো আছে দেখছিস? এতো সুন্দর রাস্তা। কিন্তু একটা গাড়িও আসছে না। অইদিগের মেইন রাস্তায় তো জ্যাম। সেই উসিলায় তো কিছু গাড়ি এদিকে আসারও কথা ছিলো। নাকি এই সুন্দর রাস্তাটা কেউ চিনেই না। শুধু খালি তুই-ই চিনিস।
সোহাগের কথায় মাসুদের মুখেও চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল। আসলেই তো। এইরকম রাস্তা থাকতে কেউ কেন এই রাস্তা দিয়ে আসছে না?
পরক্ষনেই সে বলল, আসবে কিভাবে? অই পাগল লোকটা যদি ড্রাইভারদের অমন করে ভয় দেখায় তাহলে তো না আসাটাই স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষ তো সত্যি মনে করে পালাবে।
মাসুদকে বললাম, হয়েছে বাদ দে। কয়টা বাঁজে দেখেছিস? বিয়ের দাওয়াত তো খেতেই পারলাম না। পরে গিয়ে খেতে হবে। সবাই পোলাও মাংস খেয়ে ঢেকুর তুলছে। আর আমাদের জন্য রেখেছে মাংসের হাড্ডি। গিয়ে সেগুলো চিবানো যাবে।
সোহাগ বলল, আমি আর তোদের কথাবার্তা শুনতে চাই না। আমার বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে। যত তারাতারি পারিস মেইন রোড়ে যা। তাও অন্তত কিছু খেতে পারবো।
মাসুদ বলল, কেন? এখানেও কিছু খেতে পারবি। খাবার অনেক কিছুই আছে।
- কী আছে রে?
- অইযে বাইরে তাকিয়ে দেখ। গাছে যেন গোটা গোটা কিসের ফল। গাছে উঠে কয়েকটা পেরে আন। দেখ, খেতে পারিস কিনা।
- বাজে কথা বন্ধ করে তারাতারি গাড়ি চালা।
- পারছিনা তো। রাস্তা অতোটা ভালো না। দেখছিস না। কতোটা চিকন হয়ে আসছে রাস্তাটা।

আমরা তাকিয়ে দেখলাম, সত্যি রাস্তাটা ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। এদিকে বিকাল হয়ে এসেছে। শীতের দিন। দিনের দৈর্ঘ ছোট। একটু পরে কুয়াশা পরবে। তারপর আস্তে আস্তে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
আচমকাই আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি ধক করে উঠল। ফোনের লোকেশনে দেখা যাচ্ছে, আরো অনেকটা পথ বাকি। সামনের দিকে এই গতিতে এগিয়ে যেতে আরো দেড় ঘন্টার মতো লাগতে পারে। মাসুদকে বললাম, তুই আমাদের কোথায় নিয়ে আসলি? এদিকে একটু পরে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আশেপাশে একটা লোকজনের চেহারাও এতোক্ষনের ভাসে নি। কেউ থাকে না এদিকে। তার চেয়ে জ্যামে বসে থাকাটাও ভালো ছিলো। আর এতোক্ষনে জ্যামটাও মনে হয় ছেরে গেছে।
সোহাগ বলল, বলেছিলাম না? শর্টকার্ট রাস্তাগুলো সবসময় ভয়ংকর হয়। আমার কথায় তো তখন কেউ পাত্তা দিলো না। এখন বুঝো ঠেলা।
মাসুদ গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এখন গাড়ি ঘুড়িয়ে নেওয়াও বুদ্বিমানের কাজ হবে না। কারণ অলরেড়ি তারা অর্ধেক রাস্তার বেশি পার করে ফেলেছে।
মাসুদ আর কিছুক্ষন সামনে যাওয়ার পর আরেকটা খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পরে গেল। রাস্তা এতোটাই সরু হয়ে গেল যে, একটু বেশি গতিতে গেলেই আশেপাশের গাছের সাথে লেগে যাবে। আস্তে আস্তে কোনরকম পাশ কাটিয়ে গাড়ি গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাসুদ।

সোহাগ বিরক্ত হয়ে বলল, এই স্পিডে গাড়ি চালিয়ে গেলে সকাল হয়ে যাবে। তার চাইতে বরং চল ফিরে যাই। তোর শর্টকাটের নিকুচি করেছি।
মাসুদ বলল, এই রাস্তাটায় গাড়ি ঘুড়ানোটাও অসম্ভব। আর গাড়ি পিছিয়ে নেয়াটা আরো ঝুকিপুর্ণ। গাছের ডালগুলো দেখেছিস? কতো নিচে। এভাবে যেতে আজকে সারা রাত লেগে যাবে।
কী একটা বিপদের মধ্যে পড়লাম সবাই। না পারছি সামনের দিকে যেতে, আবার না পারছি পেছনের দিকে যেতে। আজকে আর আমাদের বন্ধুর বাসায় যাওয়া হবে না মনে হয়। ফোনে নেটওয়ার্ক নাই বলে রক্ষা। অলরেড়ি কমপক্ষে ১০০ বারের বেশি ফোন দিয়ে ফেলেছে রাজিব।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। আমাদের গাড়িটা ভয়ানকভাবে ফেঁসে গেল। মাসুদ না পারল পিছনের দিকে আর না পারল সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। সামনের দিকের রাস্তাটা পুরোটাই অদৃশ্য হয়ে গেছে। হ্যা। আগে হয়তো রাস্তা ছিল। কিন্তু এখন সেই রাস্তাটা আর নেই। কোন কারণে রাস্তাটা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই হয়তো এখান দিয়ে কেউ আসে না।
সোহাগ বলল, গুগল ম্যাপের প্রতি অন্ধভাবে বিশ্বাস করা ঠিক না। আগে হয়তো রাস্তা ছিলো। তাই ম্যাপে রাস্তা এড করেছে। এখন রাস্তাটা নেই। কিছু রাস্তাটা মোছার কথা কেউ ভাবেনি হয়তো।
মাসুদ বলল, এখন এখান থেকে বের হবি কিভাবে এই চিন্তা কর। আর আমারো অনেক ক্ষুধা লেগেছে। কিছু না খেয়ে ড্রাইভ করতে পারবো না।
মাসুদের কথায় সোহাগ হাসতে হাসতে বলল, কেন? অইযে গাছে ফল দেখতে পাচ্ছিস না? গাছে উঠে সেগুলা পেরে নিয়ায়। সোহাগের কথা শুনে মাসুদ ভয়ানক ক্ষেপে গিয়ে বলল, মজা করছিস আমার সাথে?
- আরে আমি কই মজা করলাম। মজা তো তুই আমার সাথে করছিস। শর্টকাটের কথা বলে আমাদেরকে এই বাঘ ভাল্লুকের দুনিয়ায় ফাঁসিয়ে দিলি। আমি আগেই বলেছিলাম, শর্টকাট রাস্তাগুলো ভয়ঙ্কর হয়। তখন তো আমাকেই উলটা জ্ঞ্যান দিলি। এখন শিক্ষা হয়েছে? এদিকে ক্ষুধার জ্বালায় মনে হচ্ছে তোর গাড়িটাই চিবিয়ে খেয়ে ফেলি।
- গাড়ি খাবি কেন? আমাকেই খা। আমাকেই চিবিয়ে খা। যদি শান্তি পাস। বিপদে পরেছি। কোথায় বন্ধুরা একটু সাহাজ্য করবে। কোথায় একটু সাজেশন দিবে। তা না করে ঝগড়া করছিস। মাথা গরম করছিস কেন?
- Sorry. ভুল হয়ে গেছে। এখন ভাব কী করা যেতে পারে। অন্তত একটা খাবারের ব্যাবস্থা করতে হবে। তার পর যা হবার হবে। 

এতো বিশাল এলাকায় কোন মানুষ আমরা দেখতে পেলাম না। আর কেই বা আসবে এখানে? চারদিকে পাখির ডাক আর কিছু শেয়াল কুকুরের ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এদিকে ক্রমাগত শীতের তিব্রতা বেড়েই যাচ্ছে। ব্যাগে থেকে সোয়েটার বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। শহড়ের চাইতে জঙ্গলে অনেক বেশি ঠান্ডা। মাঝে মাঝে গায়ে কাপুনি দিয়ে উঠছে।
হঠাৎ আমার একটা জায়গার দিকে তাকিয়ে আমার চোখ আটকে গেল। হালকা কুয়াশার ভেতর দিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি, একটা হলুদ আলোর আভা। অনেক দূরে মনে হয়। মাসুদকে ডেকে জিনিসটা দেখালাম। মাসুদ দেখে বলল, কী ওখানে? আমি বললাম, অখানে মানুষ পাওয়া যেতে পারে। আর চল গিয়ে দেখি। যদি মানুষ পাই, তবে কিছু খেতে দিয়ে সাহাজ্যও করতে পারে।
সোহাগ আগ্রহের সাথে বলল, চল চল যাওয়া যাক। আর কিছুক্ষন না খেয়ে থাকলে নির্ঘাত মারা যাবো।

আল্লাহর নাম নিয়ে সেদিকে এগোনো শুরু করলাম। খুব সাবধানেই এগোচ্ছি। জঙ্গলে প্রচুর শুকনো পাতা পরে থাকে। পাতার খচ খচ শব্দ করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। খুব সাবধানে। জঙ্গলে পাতার নিচে নাকি সাপেদের আড্ডা। কামড় দিলে রক্ষা নেই। শহর এখান থেকে অনেক দূরে। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে হুস হুস শব্দ করছি। সাপ থাকলে ভয়ে পালাবে।
অনেক্ষন হাঁটার পর খেয়াল করলাম আলোর তিব্রতা অনেকটা বেড়েছে। হ্যা। ওখানে নিশ্চই কোন মানুষ আছে। পায়ের গতি আরো বাড়ালাম। পাঁচ মিনিট হাঁটার পর সত্যিই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। চারদিকে অনেক মশাল জ্বলছে।
আমরা আরো কাছে এগিয়ে গেলাম। সেখানে কিছু অদ্ভুত ধরনের লোক দেখতে পারলাম। যেমন, আমাদের সামনে একটা বৃদ্ধ লোক বসে ধ্যান করছে। এমনকি লোকটার গায়ে কালো রঙের একটা কাপড় জরানো। আর কয়েকটা জুয়ান জুয়ান লোক সেই বৃদ্ধ লোকটার আশেপাশ দিয়ে ঘুড়ছে আর এক অদ্ভুত ধরনের গান গাইছে। আশেপাশটা অন্যরকম একটা গন্ধ। আমরা কেবল সেদিকটায় তাকিয়ে ছিলাম। কতক্ষন তাকিয়ে ছিলাম জানিনা, তবে আর কিছুক্ষন পরে খেয়াল করলাম, সব লোকগুলো একসাথে একত্রিত হয়ে সেখানে বসে পরল।
এখানে কী হতে যাচ্ছে তার কিচ্ছুই আমাদের মাথায় ঢুকছে না। আর লোকগুলোর ব্যাবহারও আমাদের কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। একবার ইচ্ছা হলো, এখানে থেকে লাভ নেই। বরং চলে যাওয়া ভালো। কিন্তু গিয়ে লাভ কী? যদি এখান থেকে কিছু হেল্প পাওয়া যায়, তবুও খারাপ কীসের?
আরো কিছুক্ষন বসে থাকার পর যখন লোকগুলো নিজেদের তাবুর মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছিল তখন কিছু লোক আমাদের দেখে ফেলল। লোকগুলোকে দেখে একটু যেন ভয় ভয়ই করতে লাগল। কারণ আগে থেকেই শুনে আসছি, জঙ্গলের মধ্যে অন্য জাতির মানুষ থাকার কথা। অনেক উপজাতি আছে যারা অনেকটা হিংস্র। কোনভাবে যদি আক্রমন করে বসে তবে ঝামেলা হয়ে যাবে।

কিন্তু তেমনটা হল না। সেই দলের কিছু লোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসল। আমাদের শরিরটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করল। তারপর আমাদের অবস্থা দেখে মনে হয় বুঝতে পারল, যে আমরা খুদার্থ। বিশেষ করে সোহাগ, গাছে হেলান দিয়ে এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলো যে, মনে হচ্ছে এখনি মাথা ঘুড়ে পড়ে যাবে।
লোকটা আমাদের হাতের ইশারায় আসতে বলল। বাধ্য হয়ে আমরা লোকটার পেছনে পেছনে রওনা দিলাম। আমরা খেয়াল করলাম, লোকটা এখনো আমাদের সাথে একটা কথা বলে নি। লোকটা কি তাহলে বোবা? হতেই পারে। কিন্তু লোকটার চোখে সরলতার ছাপ। ভালো মানুষের মতোই মনে হচ্ছে।

আমাদের একটা তাবুর ভিতরে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে গিয়ে দেখলাম প্রায় ১০-১২ জনের মতো লোক। সবার গায়ে অদ্ভুত ধরনের পোষাক। আমার মাথায় শুধু এই চিন্তাটাই ঘুড়পাক খাচ্ছে যে, এই লোকগুলো কারা? আসলো কোথা থেকে?
মাসুদ একটা লোকের কাছে গিয়ে বলল, আপনারা কারা? এই ঘণ জঙ্গলে আপনারা কী করছেন? মাসুদের কথা শুনে লোকগুলো একে অপরের দিকে কিছুক্ষন চাওয়াচাওয়ি করল। সোহাগ বলল, দয়া করে আমাদের কিছু খেতে দিন প্লিজ। সকাল থেকে আমরা কিছু খাই নি।
কিন্তু আসল কথা হল, লোকগুলো আমাদের কারো কথাই বুঝতে পারে নি। উনাদের সাথে ইশারায় কথা বলা ছাড়া আর কোন নাই। তাই আমি হাত দিয়ে খাওয়ার মত ভঙ্গি করলাম। আমার ইশারা লোকগুলা হয়তো বুঝতে পারল।

মোবাইলের ঘড়িতে দেখলাম এখন প্রায় ৭টা বাঁজে। শীত পরেছে প্রচন্ডরকম। চারদিকে ঘণ কুয়াশা। যদিও এখানে আগুন জ্বালানো হয়েছে, তাই শীতটা একটু উপশম হচ্ছে।
কিছুক্ষন পর আমাদের তিনজনকে অবাক করে দিয়ে আমাদের জন্য একটা লোক কিছু খাবার আনল। কিছু রুটি আর কিছু মাংস। সাথে একটা পাত্রের মধ্যে পানি। পাত্রটা মাটি দিয়ে বানানো। কয়েকটা রুটি আর মাংস খেয়ে দেহে যেন প্রাণ ফিরে এল।

হঠাৎ কেন যানি একটা চিন্তা আমার মাথার মধ্যে ঢুকে খাওয়াটা নষ্ট করে দিল। আমরা যেই মাংসটা খাচ্ছি, এমন মাংস জীবনে কখনো খাইনি। নরম মাংস। স্বাদটাও কেমন যেন। ব্যাপারটা সুবিধার লাগল না।
আসার সময় সেই বৃদ্ধ লোকটার কথা মনে হল, “অনেক বছর ধরে শোনা যাচ্ছে এই জঙ্গলটাতে মানুষ খেকোর আগমন হয়েছে। জবাই করে নাকি মানুষের মাংস খায়।” তাহলে বৃদ্ধ লোকটার কথাই কি সত্যি? আসলেই কি তারা নরমাংস গ্রহণ করে? আমি তাদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। লোকগুলোর আচরণ আমার কাছে স্বাভাবিক লাগল না।

মাসুদ আর সোহাগকে বললাম, হয়েছে, খাওয়া বাদ দে। আর এখানে থাকা যাবে না। যত দ্রত পারি এখান থেকে চলে যাবো।
সোহাগ প্রথমে বলল, এখানে থেকে গেলে কী সমস্যা? আজকে রাতটা এখানে থেকে যাই।
আমি বললাম, জায়গাটা আমার কাছে সুবিধার লাগছে না। গাড়িতে ঘুমাবি চল। সকালে ভেবে দেখা যাবে কী করা যায়।

তিনজন উঠে পরলাম। তারপর তাবুর বাইরে গিয়ে সবাইকে বললাম, আমার মনে হচ্ছে সেই পাগল লোকটার কথাগুলো সত্যি। এখানে আসলেই কোন বিপদ আছে। রুটির সাথে দেওয়া মাংসটা আমার কাছে মোটেও সুবিধার মনে হয় নি।
মাসুদ বলল, তারমানে তুই বলতে চাচ্ছিস, লোকগুলো আমাদের মানুষের মাংস রান্না করে খিলিয়েছে?
আমি মাথা নিচু করে বললাম, সেটা জানি না। তবে আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে। মাংসের স্বাদটা অন্যরকম। আর তাছাড়া জায়গাটাও আমার কাছে ভালো ঠেকছে না। সুযোগ পেলে আমাদের উপরেও হামলা করতে পারে।

তিনজন সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। শীতের তিব্রতা অনেক বেড়েছে আগের চেয়ে। গাছের পাতা থেকে টপ টপ করে গায়ে পানি এসে পরছে। সেই তাবুটার থেকে অনেক দুড়ে চলে এলাম। তখন মাসুদ বলল, এই দাড়া। বড্ড ইয়ে পেয়েছে। তোরা দাঁডা আমি আসছি।
মাসুদ আমাদের থেকে একটু দূরে গেল। আর এদিকে আমি আর সোহাগ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
অনেক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু মাসুদ আসছে না কেন? আবার কোথাও হাড়িয়ে গেল নাকি? জোরে জোরে কয়েকটা ডাক দিলাম। কিন্তু মাসুদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
বিরক্ত হয়ে বললাম, পেশাব করতে কখনো এত্তো সময় লাগে?
কিছুক্ষন পর মাসুদের দেখা পেলাম। কিন্তু মাসুদের মুখটা স্বাভাবিক না। মুখে যেন আতঙ্কের ছাপ লেগে আছে। মাসুদ হন্তদন্ত হয়ে আমাদের কাছে এসে বলল, একটা ভয়ানক জিনিস দেখে আসলাম ভাই।
মাসুদের কথায় চিন্তায় পরে গেলাম। কী এমন ভয়ঙ্কর জিনিস দেখেছে ও। জিজ্ঞাস করলাম, কী দেখেছিস রে?
- চল আমার সাথে।
অগত্যা আমি আর সোহাগ মাসুদের পেছনে পেছনে যেতে আরাম্ব করলাম। খুব সাবধানে এগুচ্ছি আমরা। আশেপাশের পরিবেশটাও কেমন জানি থমথমে। কোন সারাশব্দ সেই। এখানটাতে যেন কোন ঝি ঝি পোকার ডাকটাও শোনা যাচ্ছে না। আশেপাশের গাছগুলোকে দেখেও কেমন জানি ভয়ানক লাগছে। আর মাসুদ কোন একটা ভয়ানক কিছু দেখাবে, সেই চিন্তায় আমার বুকটা কেমন ধপ ধপ করছে। একবার বলতে ইচ্ছা হলো, মাসুদ! দেখতে হবে না তোর সেই ভয়ানক জিনিস। আয় চলে যাই এখান থেকে। কিন্তু পারলাম না। এগিয়ে চললাম মাসুদের পেছন পেছন।

কিছুক্ষন পরে মাসুদ আমাদেরকে একটা জায়গায় নিয়ে আসল। একটা বাড়ির সামনে। পাকা বাড়ি। সিমেন্টের আবরণ খসে গেছে প্রায়। কিন্তু দরজাটা আটকানো। মাসুদ বলল, জানালার কাছে চল।
- কী আছে জানালার কাছে?
- গেলেই দেখতে পারবি।

মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটটা অন করলাম। একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম সেখানে। জানালার কাছে যেতেই একটা গোংরানির আওয়াজ পেলাম। ফ্লাশলাইটটা জানালার কাছে ধরতেই যেটা দেখলাম, সেটা দেখার আশা আমি কল্পনাতেও করি নি। একটা লোক। গায়ে শার্ট। ভদ্র লোকের মতো মনে হচ্ছে। কিন্তু লোকটার হাত পা শক্ত কোন দড়ি দিয়ে বাঁধা। লোকটাই কিছুক্ষন পর পর গোংরাচ্ছে।
মাসুদকে বললাম, দ্রুত এই লোককে এখান থেকে উদ্বার করতে হবে। বেশিক্ষন থাকলে মারাও যেতে পারে।

দরজাটা খুলে সেই ঘড়ের ভেতরে ঢুকলাম তিনজনে। লোকটার হাতের ও পায়ের বাঁধন খুলে দিলাম। লোকটা একটু পানি খেতে চাইল। কিন্তু এখানে পানি পাবো কোথায়।
সোহাগ ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করে বলল, বোতলে কিছু পানি রেখে দিয়েছি। এটা খেতে দে।
লোকটা পানি খাওয়ার পর যেন একটু সুস্থ হল। তারপর কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে শান্ত হয়ে বলল, কে তোমরা? এখানে কী করছো?
- আমরা জঙ্গলে এসে খুব বাঁজে ভাবে ফেঁসে গেছি। সকাল না হলে বের হওয়া কঠিন হবে। কিন্তু আপনার এই অবস্থা কে করেছে?
- অইযে অই লোকগুলাকে দেখেছো না? অরা বন্দি করেছিলো আমাকে। মানুষ খেকো ওরা। আশেপাশে কোন মানুষ দেখলেই বন্দি করে ফেলে।
সোহাগ বলল, কিন্তু আমরা তো সেখানে গিয়েছিলাম। কই, আমাদের তো কিছু করলো না। আরো উলটা আমাদের আপ্যায়ন করলো।
- বলো কী? ভাগ্য ভালো যে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে চলে এসেছ। নইলে আমারই মতো বন্দি হতে। আর তারপর জবাই করতো আমাদের। তোমাদের ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারবো না। তোমাদেরকে যে কী বলে ধন্যবাদ দিবো, সেটার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছি না।
আমি বললাম, থাক। ধন্যবাদ দিতে হবে না। একজনকে বিপদ থেকে বাঁচানো আরেকজনের কর্তব্য। আমরা শুধু আমাদের কর্তব্য পালন করেছি। কিন্তু এই ঘণ জঙ্গলে আপনি কী করছিলেন?
- এখানে আমি একটা গবেষণা করতে এসেছি। জঙ্গলের প্রানীদের নিয়ে। কিন্তু এখানে আসার পরেই ওই ভয়ংকর লোকগুলো আমাকে সুযোগ পেয়ে বন্দি করে ফেলে। তারপর এই ঘড়টাতে আঁটকে রাখে। আর তোমাদেরও এখানে থাকা মোটেও নিরাপদ না। যে কোন সময় আবার আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। ওরা কিন্তু সংখ্যার অনেকগুলো। তারচেয়ে আজকে রাতটা তোমারা আমার ঘড়ে থাকতে পারো। 
অবাক হয়ে বললাম, আপনার ঘড় মানে?
- মানে আমার ল্যাব। অস্থায়ী ল্যাব আরকি। কোনরকম থাকি, আর গবেষণার কাজ করি।

আমাদের কাছে সেটাই নিরাপদ মনে হল। এই জায়গাটা মোটেও সুবিধার না। কোন হিংস্র প্রাণীও যেকোন সময় আক্রমণ করতে পারে। তার চেয়ে লোকটার ঘড়েই আজকে রাতটা কাঁটিয়ে সকালে এখান থেকে বের হওয়ার চিন্তা করতে হবে।
এতোক্ষনে বেচারা রাজিব হয়তো হাজার বার ফোন করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। ছেলেটার জন্য আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে। বেচাড়া কতো আশা করেছিলো যে, আমরা ওর বোনের বিয়েতে গিয়ে সারাদিন একটু মজা করবো। কিন্তু ভাগ্য যে এতোটা খারাপ হবে সেটা তো আমরা জানতাম না। সকল সমস্যার মূল হচ্ছে মাসুদ। না জেনে না শুনে গাড়ি একটা অচেনা রাস্তায় ঢুকিয়ে দিল।
তাছারা আমরা যেই লোকটাকে পাগল বলে উপহাস করে এসেছি, তার সাথে এমন ব্যাবহার করাটা বড্ড ভুল হয়ে গেছে। পুনারায় তার সাথে দেখা হলে তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। যদি সেই লোকটার কথা শুনে এখানে না আসতাম, তবেই ভালো ছিলো।

জঙ্গলের ভিতরে সেই লোকটার দারুন একটা ঘড়। কে বা কারা এই ঘড়গুলা তৈরি করেছিলো তার কোন হদিস পাওয়া যাবে না। তেমনই একটা পুরোনো ঘড়ে আসলাম আমরা। তবে ঘড়টাকে লোকটা দারুনভাবে সাজিয়েছে। একটা শেল্ফের মধ্যে কিছু প্রাণীদের অর্গান। দেখতে একটু বিদঘুটে দেখা গেলেও সেটা ভালো লাগছে। পাশের একটা টেবিলে কিছু বইপত্র আর কিছু ফাইল সাজানো। মাথার উপরে যে বাল্বটা জ্বলছে সেটা সোলার চালিত।

লোকটার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম। তার নাম ড. ইসতিয়াক হোসেন। তবে তার ঠিকানা জানতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম, ভদ্রলোক নিজের ঠিকানাটা গোপন করতে চাইছেন।
লোকটা আমাদের শোয়ার জন্য বিছানা তৈরি করে দিলো। আমি বললাম, আপনিও তো অনেক ক্লান্ত। ঘুমাবেন না?
লোকটা জবাব দিল, আজকে অনেক ভয় পেয়েছিলাম, জানো। আজকে রাতে হয়তো আমার ঘুমই আসবে না। তোমরা বরং ঘুমিয়ে পরো।
এই কথা বলে লোকটা ওপাশের ল্যাবরেটরি রুমে চলে গেল। যাওয়ার আগে বাতি নিভিয়ে দিয়ে বলল, গুড নাইট সবাইকে।

ঘুমিয়ে গেছিলাম। কিন্তু কেন জানি ঘুমটা ভেঙে গেল। কারণটা বুঝতে পারলাম না। কী হতে পারে? আচ্ছা। পাশের রুম থেকে কিসের যেন একটা শব্দ আসছে। ঘুম ঘুম ভাব থাকায় আমার মাথায় কোন কিছুই ঢুকছে না। কেমন জানি সব আবলতাবল লাগছে। শব্দটা আমার কানে আসছে ঠিকই। কিন্তু সেটা কিসের শব্দ, সেটা আমি আন্দাজ করতে পারছি না। অন্ধকার ঘড়। পাশের ল্যাবের রুম থেকে হালকা আলো চোখে আসে বলেই একটু একটু দেখা যায়। এখন রাত কয়টা বাঁজে সেটাও জানি না, জানার প্রয়োজনবোধও করছি না।
হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, একটা ছায়ামুর্তি। হ্যা। ঠিক আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সেই হালকা আলোটার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকার কারণে, তাই অবয়বটাই শুধু দেখা যাচ্ছে। কে ইনি? ড. ইশতিয়াক হোসেন? এখানে কী করছেন? আমাদের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ কী? তার তাছাড়া তার হাতে অইটা কী? কী হাতে নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন?
লোকটাকে দেখে আমার ঘুমের ভাবটা আস্তে আস্তে কাঁটতে লাগল। আমি খেয়াল করলাম, হ্যা। এটা ড. ইসতিয়াক হোসেনই। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা বিশাল বড় দা। সেটা দেখে আমার শরীর হিম হয়ে গেল। লোকটা আমাদের দিকে গুটি গুটি পায়েএগিয়ে আসছে। আমি ঘুমিয়েছি সবার বাম পাশে। আর সবার ডানপাশে সুমন।
ড. ইশতিয়াক সুমনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার প্রচন্ড ভয় করছে। হাত পা নাড়াতে গিয়েও খেয়াল করলাম হাত পা নাড়াতে পারছি না। আর ওদিকে লোকটা সুমনের বুকের উপরে উঠে আসল। এর পরের ঘটনাটা কী হতে যাচ্ছে সেটা আন্দাজ করতে পারলাম। কিন্তু আমার চিৎকার করার শক্তিটাও আমি পাচ্ছি না।

লোকটা তার হাতের ধাড়ালো দা টা আস্তে আস্তে উচু করছে। সামান্য আলোয় দা টা চক চক করছে। আমি ভাবলাম, যেভাবেই হোক আমাকে শরীরে শক্তি ফিরিয়ে আনতে হবে, তা না হলে আজকের রাতটাই হবে আমাদের জীবনের শেষ রাত। যখনি ড. ইসতিয়াক দা টা সম্পুর্ণ উচু করল তখন আমার শরিরে ভয়ানক একটা ঝাঁকি অনুভব করলাম।
লোকটা ভয়ানক একটা নিশ্বাস টেনে নিয়ে সুমনকে যেই সুমনের বুকে কোপ দিয়ে গেল, তখনি ভাবলাম এখন আর হাতে সময় নেই। সাথে সাথে নিজের পা দিয়ে শরীরের সম্পুর্ণ শক্তি দিয়ে লোকটার ডান কাঁধে দিলাম একটা লাথি। লোকটা দুড়ে ছিটকে গিয়ে পড়ল।

সাথে সাথে উঠে পড়লাম। মাসুদকে ধাক্কা দিলাম। মাসুদও উঠে পরল। এদিকে লোকটা দা নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। লোকটার ব্যাবহার এখন হিংস্র। মাসুদ উঠে পরিস্থিতি কিছুটা পর্যবেক্ষন করল। তারপর, লোকটাকে পেছন দিক থেকে চেঁপে ধরল। কিন্তু লোকটা তবুও ক্ষান্ত হল না। হাতের দা টা আমার দিকে ছুড়ে দিল। অন্ধকারে সবকিছুই আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। দা টা এসে আমার কাঁধের একপাশে লাগল। প্রায় এক ইঞ্চির মতো ঢুকে গেল। ব্যাথায় একটা চিৎকার দিলাম। চিৎকারের শব্দ শুনে সোহাগ উঠে পড়ল।
মাসুদ লোকটাকে এখনো ধরে আছে। সামন থেকে সে বলছে, ছেরে দে বলছি। ওর রক্ত খাবো আমি। ছেরে দে শুয়রের বাচ্চা।
আমি আর নিজের রাগকে কন্টোলে রাখতে পারলাম না। সোজা গিয়ে নাকের মধ্যে কয়েকটা ঘুষি লাগিয়ে দিলাম। লোকটার নাক ফেঁটে রক্ত বের হতে লাগল। মাসুদ বলল, "তোকে ভালো মনে করেছিলাম, অথচ এই ছিলো তোর মনে? এখন বুঝতে পারলাম, অই লোকগুলো তোকে কেন আঁটকে রেখেছিল। আসলে সকল সমস্যার মূল হচ্ছিস তুই। আমরা তোকে ছেরে দিয়ে বড্ড ভুল করে ফেলেছি।

আমি রুমের লাইকটা অন করলাম। ড. ইশতিয়াকের চেহারা এখন আর আগের মতো নেই। হিংস্র হয়ে গেছে সেই চেহারা। আমার কাঁধ থেকেও ঝরঝড়িয়ে রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু এখন যেভাবেই হোক, এই লোককে বেঁধে ফেলতে হবে। পুলিশের কাছে দিতে হবে একে।
ড. ইশতিয়াক হাঁসি মুখে বলল, কোন প্রমাণ আছে তোর কাছে?

আমি আর নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারছি না। কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছে আমার। যে লোকটা আমাকে ও আমার বন্ধুকে আক্রমণ করতে চেয়েছে। এমনকি আরো কত মানুষকে হত্যা করেছে।

আমার পাশে পরে থাকা দা টা হাতে নিলাম। আর বললাম, তোর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। এই বলে লোকটার ঘাড়ে দা দিয়ে শরিরের সম্পুর্ণ শক্তি দিয়ে একটা কোপ মারলাম।
মাসুদ ভয়ে লোকটাকে ছেড়ে দিল। আর বলল, এটা কী করলি? লোকটাকে খুন করে ফেললি?
আমি বললাম, এটাই ওর প্রাপ্য ছিল।
- পুলিশ কেস হয় যদি?
কিছুক্ষনে ভেবে বললাম, দা টাকে দূরে কোন জায়গায় ফেলে দিতে হবে। আর লাশটাকে পুতে ফেলতে হবে।

সেদিন রাতে আর ঘুম হল না। এই ঘণ জঙ্গলে এমনিতেও কেউ আসবে না। লাসটাকে একটা বস্তায় তুলে সেই বাড়িটার পেছনে গর্ত করে পুতে রেখে দিলাম।

সকাল হয়ে আসছে। এখন চলে যেতে হবে। আবার ক্ষুধা লাগছে। রাতেও সবার অনেক খাটুনি হয়েছে। গাড়িটার কাছে যেতেও অনেকটা সময় লাগল। সবাই গাড়িতে চড়ে বসলাম। মাসুদ খুব সাবধানে গাড়িটা পিছিয়ে নিচ্ছে।

আরো তিন ঘন্টা গাড়ি চালানোর পর আমাদের সেই পাগল লোকটাকে দেখার সৌভাগ্য হল। আমরা লোকটাকে পাগল মনে করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু আমরা কিছু বুঝতে পারি নি। লোকটার কাছে ক্ষমা চাইলাম। বললাম, আপনাকে গতকাল অনেক খারাপ ভাষায় গালি দিয়েছি। দয়া করে আমাদের কথায় কোন কিছু মনে করবেন না। আমরা ভুল বুঝতে পারছি।

লোকটা নরম গলায় বলল, হয়েছে বাবা। ভুল হতেই পারে। ভুলটা বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক। কিন্তু তোমাদের কোন ক্ষতি হয় নি তো?
- না। আমাদের কোন ক্ষতি হয় নি।
- কে বলেছে ক্ষতি হয় নি? তোমার কাঁধে এখনো আঘাতের দাগ। তারাতারি দাক্তার কাছে যাও। অনেকখানি কেঁটে গেছে।
লোকটা ঠিকই বলেছে, হাসপাতালে যেতে হবে। ক্ষতস্থানে সেলাই করতে হবে।

ফোনটা একটু নেটওয়ার্ক পেতেই মেসেজের শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। ৭২ টা sms. ২৫৩ টা মিসড কল। আজকে আমাদের খবর আছে।

লেখাঃ মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল

Comments

Popular Posts