আমরা কেন অংক করি?
ছোটবেলা থেকেই আমরা নিজেরা গণিত বই পড়ে থাকি। যতই বড় হচ্ছি, গণিত বইয়ের অংকগুলো তত জটিল হচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই আমরা মনে করি, বা আমাদের বাবা মায়েরা বলেন, গণিত বই পড়ার প্রধান কারণ হল, বড় হলে হিসাবে পাকা হওয়া, যেকোনো হিসাব শেখা। এই একটা জিনিসই আমাদের বলা হয়। কিন্তু গণিত বই পড়ার আরেকটা খুবই গুরুপ্তপুর্ণ কারণ রয়েছে। যেটা আমাদের কখনোই বলা হয় না। যার কারণে আমরা সেটা করিও না। এমনকি আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থাতেও সেরকম করে গণিতের প্রয়োগ হয় না। তাই চলুন, আজকে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ছোটবেলায় হয়তো একটা জিনিস খেয়াল করেছেন যে সকল গণিত বইয়ে কিছু্ উদাহরণ করে দেওয়া থাকে। তারপর শেষে কিছু অনুশীলনী প্রশ্ন দেওয়া থাকে। ছাত্ররা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবে, উদাহরণের চাইতে অনুশীলনীর প্রশ্নগুলো অনেকটা কঠিন হয়। যার কারণেই ছাত্ররা বইয়ের লেখককে মনে মনে গালি দিয়ে থাকেন। আসলেই তো, গণিত বইয়ের লেখকরা নিজেরা সহজ অংকগুলো করে দিয়ে ছাত্রদের উপর কঠিন অংকগুলো চাপিয়ে দেয়। তাদের কি কমনসেন্স বলতেই নেই?
আছে। এক্ষেত্রে বইয়ের লেখককে দোষ দিয়ে কোনো লাভই নেই। উনি সঠিক কাজটাই করেছেন। বরং আমাদের নিজেদেরই বুঝতে সমস্যা হয় এখানে।
ছোটোবেলায় মোবাইলে গেম আমরা সবাই খেলেছি। কিছু কিছু গেম খেলতে অনেক পরিমান মাথা খাটাতে হয়। অনেক চিন্তাভাবনা করে ঠান্ডামাথায় গেমটা খেলে উপরের লেভেলে যেতে হয়। উপরের লেভেলে যাওয়ার জন্য আগে খেলায় জিততে হবে। খেলায় না জিতে কেউ উপরের লেভেলে যেতে পারে না। এর জন্য গেমের ভেতর কোনো শর্টকাট নিয়ম নেই। অনেক মাথা খাটিয়ে গেম জেতার পরেই উপরের লেভেলে যাওয়া যায়। তখন মনের ভেতরে এক ধরনের আনন্দ কাজ করে। নতুন লেভেলের এক্সপেরিয়েন্স আসলেই নিজেক অনেক আনন্দ দেয়। ছোটবেলায় একটা গেমে উপরের লেভেলে ওঠার জন্য কতবার যে খেলেছি আর হেরেছি তা হিসাব করতে পারবো না। একবার একটা গেমে নেক্সট লেভেলে উঠতে আমার তিন মাস সময় লেগেছিলো। যেদিন উপরের লেভেলে উঠলাম সেদিন যে কী পরিমান খুশি হয়েছিলাম তা লেখায় প্রকাশ করতে পারবো না। মনে হয়েছিলো যেনো বুকের ভেতর থেকে এক মণ পাথর সরে গেলো।
কিন্তু গেমগুলো যদি হ্যাক করে বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে ধপাস ধপাস করে উপরের লেভেলে উঠে যেতাম তাহলে আমার দুইটা লস হতো। প্রথমটা হলো, আমি অতটা খুশি কখনোই হতাম না, জেতার আনন্দটা পেতাম না। আর দ্বিতীয়ত গেম খেলার কারণে আমার ব্রেণের এক ধরনের ব্যায়াম হয়েছে। গেম হ্যাক করে উপরে উঠলে ব্রেনের সেই ব্যায়ামটা হতো না। ব্রেন ডেভলপমেন্টের জন্য এই ধরনের ব্যায়ামটা অনেক গুরুপ্তপূর্ণ। এখন আপনি খেয়াল করলে দেখবেন ম্যাথ করাটাও এক ধরনের গেম। যেখানে মাথা খাটিয়ে সেটা সমাধান করতে হয়। সমাধান না করতে পারলে যে বিশেষ কোন ক্ষতি হয়ে যাবে তেমনটা না। বরং ব্রেনের উপকারই হবে। কেউ প্রথম প্রথম খেলতে গিয়েই সেই খেলায় মাস্টার হয়ে যায় না। মাস্টার হতে চাইলে সেই গেম বার বার খেলতে হবে। বার বার হারতে হবে। তবেই আপনি সেই খেলায় মাস্টার হতে পারবেন। এর বিকল্প কোন রাস্তা নেই। দাবা খেলা শেখার অনেক বই আছে। সেগুলো পড়ে অনেক কিছু শিখতে পারবেন। কিন্তু বই পড়েই কেউ দাবায় গ্রান্ড মাস্টার হয়ে যায় না। এর জন্য খেলতে হবে, হারতে হবে বার বার।
গণিত জিনিসটাও ঠিক তেমনই। যারা বড় বড় গণিতবিদ। তারা কখনোই গাইড বই দেখে অংক শিখে আসে নাই। ওরা একটা অংক নিয়ে পারলে সারা রাত বসে থেকেছে, সমাধান করার চেষ্টা করেছে, তবুও হয়তো তারা সমাধান পায় নি। তারা ইচ্ছে করলেই কিন্তু এক ঝটকায় গাইড বইটা খুলে সমাধানটা দেখে নিতে পারতো। কিন্তু তারা করে নি।
আমাদের স্কুলে বা কোচিংয়ে প্রতিদিন যে অংকগুলো সমাধান করে দেওয়া হয়। সেগুলোর নিয়ম আমরা মুখস্থ করি। কোন ধাপের পরে কোন ধাপ করতে হবে এটা আমাদের মুখস্থ রাখতে হয়। এতে মুখস্থবিদ্যা কিছুটা ভালো হলেও ক্রিটিক্যাল থিংকিং উন্নত হবে না।
বইয়ের লেখকরা উদাহরণ বইয়ের মধ্যে সমাধান করে দেন। কিন্তু সেগুলোর চাইতে অনুশীলনীমুলক প্রশ্নগুলো একটু কঠিন করা হয়, যাতে ছাত্রটা সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারে। সেই অংকটা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করে উত্তরটা বের করতে পারে। বইয়ের শেষে উত্তরমালায় কেবল উত্তরটা মিলিয়ে দেখতে পারে অংকটা ঠিক আছে কিনা। অংক বইয়ের সকল অংক গাইড বা টিচারের বোর্ডের নিয়মে সমাধান করে ফেলাই সার্থকতা নয়। একটা অংক নিজের নিয়মে সমাধান করার জন্য একটা বাচ্চা সারা রাত খাতার পেজ নষ্ট করলো, এটাই সার্থকতা। তবে সমাধান একদিন হবেই। একদিনে, নাহয় তিন দিনে সেটা সমাধান হবে।
লেখাঃ মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল
Comments
Post a Comment