বিচার

হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি গত তিন দিন ধরে। নাহ্। আমি কোন বৃদ্ধ মানুষ নই। আমি একজন প্রবীণ। বয়স বেশি না। দুর্দম চলাফেরা। সকালে অফিসে বের হই। অফিসে সারাদিন কাজ করি। সন্ধ্যায় বাসে ঝুলতে ঝুলতে বাসায় আসি। শহরের মেইন রোডের কাছে তখন বাসা ভাড়া আকাশচুম্বী। এতো সাধ্য না থাকায় বাসাটা নিয়েছি শহড় থেকে একটু ভিতরের দিকে। বাস থেকে নেমেই আবার শুরু হয় পায়ের যুদ্ধ। হেঁটে যেতে হবে প্রায় এক মাইল পথ। রাস্তায় নেই কোন ল্যাম্পপোস্ট। মাটির রাস্তা। কোথাও উচু কোথাও নিচু। মোবাইলের মৃদু আলোতে চলতে হয়। মাঝে মাঝে পায়ে হোচট খাই। তখন মনে হয়, টাকা বেশি লাগলে লাগুক। সামনের মাসে মেইন রোডের কাছে একটা নতুন বাসা খুঁজে নিবো। আর এভাবে হাঁটতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু সেই চিন্তা মাথা থেকে চলে যায়, যখন বাজারের সামনে গিয়ে দ্রব্যের মূল্য জিজ্ঞাস করি। মনে হয়, এখানেই দিব্যি সুখে আছি। একটু ভালো থাকতে হলে তো কষ্ট করতেই হবে। বিলাসবহুল বাসায় থেকে যদি পেটে অন্ন না পাই। তাহলে ব্যাপারাটা কেমন না? একজনের গায়ে শার্ট নেই। খালি গা। তাই সে নিজের লুঙ্গী খুলে গায়ে পেচিয়ে নিল।

অন্ধকারে হাঁটছিলাম সেদিনও। পথে জনমানব বলতেই নেই। আশেপাশে কিছু কুকুরের সাথে দেখা হয়। ওরা বিরক্ত হয় না। ওরা আমাকে চিনে। এখান দিয়ে চলতে চলতে ওদের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। হয়তো ওরা মনে মনে বলে, কীরে! আজকেও এতো লেট? আমি এর উত্তরে কিছুই বলি না বা, মনে মনেই দেওয়ার চেষ্টা করি।
হঠাৎ একটা জিনিস ঘটে গেল আমার সাথেই। যেই ঘটনার ভয় আমি প্রতিদিন করতাম। সেই ঘটনাটাই ঘটে গেল আমার সাথে। মুখ বাঁধা তিনটা ছেলে। আমার চেয়ে খাটোই ওরা। বয়সো কম। হঠাৎ করে আমার গলায় ছুড়ি ধরে বলল, যা আছে, ভালোয় ভালোয় বের করে দে। নইলে এটা দিয়েই গেম অভার করে দিবো।  আমি তখন নিরুপায়। সাধারনত অফিসে যাওয়া-আসার সময় আমার কাছে গাড়িভাড়া আর বাজারের বাজেট ব্যতিত কোন টাকা থাকে না। কিন্তু আজকে তো আছে। মাসের শুরু। তাই আজকে কেবল বেতন হয়েছে। ব্যাগে পুরো ১ মাসের টাকা। এই টাকা বেহাত হয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ছিনতাইকারীরাও বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে বের হয়েছে। ওরা হয়তো অনেক দিন ধরেই আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। যেদিনই আমার বেতন হবে, সেদিনই খপ করে ধরবে। করেছেও তাই।
আমি ছুটে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করছি। তিনজনের সাথে পেরে ওঠা কঠিন। তবুও ওরা হিমসিম খাচ্ছে। ওদেরকে ইচ্ছা করলেই আঘাত করতে পারতাম। কিন্তু গলায় ছুড়ি ধরে আছে। তাই সাহস হয় না। ওরা তো কোন সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ না। মাতাল ওরা। ঠিক-ভুলের জ্ঞান নেই। তবে চেষ্টা করতে হবে। ছুড়িটা নিজের হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করলাম। তখনই শুরু হলো ওদের আর আমার মধ্যে ধস্তাধস্তি। দুজনেই চেপে ধরলো আমাকে। আরেকটা ছেলের হাতে মোটা একটা লাঠি। ছেলেটা হাতের লাঠি দিয়ে আমার হাটুর মধ্যে সজোরে দুইটা বারি দিলো। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। মাটিতে নুইয়ে পড়লাম সাথে সাথে। পায়ের নিচের অংশে কোন শক্তি নেই। নিজেকে তখন কেমন যানি বড্ড অসহায় মনে হচ্ছিলো। আমার চোখের সামনে ওরা আমার ব্যাগ হাতিয়ে সব টাকাপয়সা নিয়ে চলে গেল। আমার মোবাইল, এমনকি মানিব্যাগে থাকা খুচরা টাকাও ছাড়লো না। সিগারেট খাবে বলে নিয়ে চলে গেল। আমি শুধু অপলকভাবে তাকিয়ে ছিলাম ওই ছেলেগুলোর দিকে। ওদের মনে কি একটু দয়াও নেই? একটু জ্ঞানও কি প্রভু ওদের দেয় নি? আমার ফ্যামিলি এই একমাস চলবে কিভাবে? আমার ছেলেমেয়েদের আবদার, স্ত্রীর কথা বাদই দিলাম। খাওয়ার খরচটাও হবে নাকি কে জানে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ। কতকিছু চলে এই বেতনের মাধ্যমে। সব নিয়ে গেল। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছি আমি।

পথ দিয়ে আরো কিছু লোক আসার সময় আমাকে পড়ে থাকতে দেখে। ওরা আমাকে পরবর্তীতে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার ফ্যামিলিতে জানানো হয় ঘটনা। ওরা দেখতে এসেছে। হাটুতে অনেক জখম হয়েছে। একটু আগেও প্রচন্ড ব্যথা ছিলো। এখন অসুধ দিয়েছে। তাই ব্যথাটা কমেছে। এক্স-রে করতে হবে। ভেবেছি হাসপাতাল থেকে বের হয়েই অই অচেনা সন্ত্রাসগুলোর পাত্তা নিবো। খুঁজে বের করে পুলিশে দিবো ওদের।

রাত হয়ে গেছে। হাসপাতালের বিছানায় এখনো শুয়ে আছি। ঘুম তো আসবে না। সারাদিন শুয়ে থাকলে রাতে কিভাবে ঘুম আসবে? নানান ধরনের চিন্তা মাথায় আসছে। এত্তোগুলো টাকা ওরা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। টাকা নিবি নে, পায়ে আঘাত করলি কেন? মানুষ কত নিষ্ঠুর। নিজের ভালোর জন্য মানুষ সবই করতে পারে। অন্যের ক্ষতি করতেও সে দ্বিধাবোধ করে না।
হঠাৎ মনের ভিতর থেকে ধুলোপড়া একটা স্মৃতি জেগে উঠলো। একবার ভাবলাম, আচ্ছা! আমিও কি অই খারাপ ছেলেদের মতোই? আমিও কী নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের ক্ষতি করি না? করিই তো।

আজ থেকে প্রায় দশ-বারো বছর আগের ঘটনা। তখন চাকরী শুরু করি নি। বিয়ে হয় নি। লেখাপড়া করি সবে। তেমনি একদিন বিকেলবেলা বাসায় বসে ভার্সিটির এসাইনমেন্ট কমপ্লিট করছি। কালকের মধ্যেই জমা দিতে হবে। এতোগুলো কাজ কিভাবে করবো ভেবেই মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। ভাবলাম, একটু দুধ গরম করে খেয়ে নেই। মাথা ঠান্ডা হবে। পাতিলে দুধ গরম করতে দিলাম। ঠান্ডা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, চুলাতেই থাক। আবার টেবিলে বসে এসাইনমেন্ট করতে বসলাম। খুব বিরক্ত লাগছে ভার্সিটির টিচারের উপর। এতো লেখালেখির কোন মানে হয়? আজকে টিউশনিতে যাওয়ার কথা ছিলো। যাই নি। যত তারাতারি পারি এসাইনমেন্টটা শেষ করলেই বাঁচি। তারপর আরামের একটা ঘুম দিবো। মনে মনে অনেক কিছুই ভাবছি, হঠাৎ করে রান্নাঘড় থেকে একটা কিছু পড়ার শব্দ আসলো। চমকে উঠলাম। লেখালেখি বাদ দিয়ে দ্রুত রান্নাঘড়ে গেলাম। তারপর গিয়ে যা দেখলাম, সেটা দেখে আমার চোখ পুরো ছানাবড়া। সাদাকালো ডোড়াকাঁটা বিড়ালটা জানালা দিয়ে রান্নাঘড়ের ভিতরে ঢুকেছে। ঢুকেই আমার দুধের পাতিল নিচে ফেলে দিয়ে ফ্লোরে ছড়িয়ে থাকা দুধ চোখ বন্ধ করে চেঁটে চেঁটে খাচ্ছে। পুরো ফ্লোর দুধে ভিঁজে আছে। আমার মাথায় যেন মনে হচ্ছে তখন পারমানবিক বোমা বিস্ফোরক ঘটছে। মাথা গরম হয়ে গেল মুহুর্তে। রাগে সেদিন নিজেকে সামলাতে পারি নি। ঝুড়ির উপরে ১ কেজি ওজনের একটা বাটখারা দেখতে পেলাম। হাতে নিয়ে সেই বাটখারা দিয়ে জোড়ে একটা ঢিল ছুড়লাম বিড়ালটার দিকে। সেটা গিয়ে লাগলো বিড়ালটার ঠিক ঘাড়ে। সাথে সাথে বিড়ালটা ফ্লোরে নুয়িয়ে পড়লো। ওখানে শুয়েই অনেক্ষন কাতরালো। বুঝতে পারলাম হাড়ের মধ্যে লেগেছে। বিড়াল এমনিতে প্রচন্ড আঘাতও সহজে মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু সে সহজে পারছে না। আমার মুখে তখন বিজয়ের হাঁসি। এই শয়তান বিড়াল আর আমার বাড়ির চৌকাঠে পা রাখার সাহস পাবে না। বিড়ালটা বাইরে যেতে পারছিলো না। তাই বিড়ালটার ঘাড়ে ধরে বাসার জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলাম।

পরদিন ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় দেখলাম, গতকাল যেই বিড়ালটাকে আঘাত করেছি, সেটা আজ রাস্তার সামনে মরে পড়ে আছে। মুখের সামনে মাছি ভন ভন করছে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম এটা দেখে যে, একটা ছোট্ট বিড়ালছানা বিড়ালটার আশেপাশে ঘোড়াঘুড়ি করছে। মাঝে মাঝে মৃত বিড়ালটার স্তনে মুখ লুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। শরির শক্ত হয়ে গেছে বিড়ালটার।
সেদিন আমি ঘটনাটা স্বাভাবিক মনে করেছিলাম। শুধু বিড়াল কেন? পায়ের তলায় পিষে কতো হাজার হাজার পিপড়া মারা যায়। ওদেরও তো সন্তান থাকে। প্রকৃতির নিয়মই হচ্ছে, শক্তিশালীরা দুর্বলদের উপরে আক্রমণ করে টিকে থাকবে। এটা একটা রুল। সুতরাং দোষ থাকলে সেটা হবে প্রকৃতির। আমার তো দোষ থাকার কথা না।

আজকে হাসপাতালে শুয়ে মনে হল, তাহলে ডাকাতেরা আমাকে ধরে আঘাত করল, আমার সব কিছু নিয়ে গেল, এটাও কি তাহলে প্রকৃতির নিয়ম? এখানে সব দোষ কি প্রকৃতির? ডাকাতদের কোন দোষই নেই? ওরা নিষ্পাপ? আমার মতে নিশ্চই না। ওরা অপরাধী। এই হিসেবে আমিও অপরাধী। আমিই অপরাধ করেছিলাম। আমি খুনী। মার্ডার করেছি আমি। সেই মার্ডারের কোন পোস্টমর্টেম হয় নি। তদন্ত হয় নি। পুলিশের রেকর্ডে কোন নালিশ নেই। কিন্তু প্রকৃতির রেকর্ডে সেই নালিশ লিখে রাখা হয়েছিলো। আজকে সেটার বিচারও হয়েছে।

গল্পঃ বিচার
লেখাঃ মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল
০৩ এপ্রিল ২০২৫

Comments

Popular Posts