একটা ভালোবাসার গল্ল
ইউ-টার্ন
পর্ব ০৫
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখটা ধুয়ে বারান্দায় বসে চা খান বিজয়ের বাবা একরাম হোসেন। এটা তার অভ্যাস। চা-টা খেয়ে তিনি গোছলে যাবেন। তারপর গোছল করে নিজে কিছু রান্নাবান্না করেন। বিজয় তাকে অনেকবার বলেছে, একটা কাজের লোক রেখে নিতে। কিন্তু একরাম হোসেন সেটা করবেন না। তার মতে এটা একটা বাড়তি ঝামেলা। নিজে একা একা রান্না করে খায় এটাই তার কাছে অনেক ভালো লাগে। বিজয় কিছু বললে একরাম হোসেন বলবেন, সারা জীবন তোকে রান্না করে খিলিয়েছে কে? বিজয় এর কোন উত্তর দেয় না।
চা খেয়ে কাপটা বেসিনে ধুয়ে নেয়। তারপর লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকার সময় বিজয় পেছন থেকে এসে বলে, বাবা আমি বের হলাম। একরাম হোসেন ছেলেকে আর কিছু বলে না। শুধু বলে, যা। বিজয় চলে যায়। সে বাথরুমে ঢুকে। তারপর গোছল সেরে নাস্তা তৈরি করে কিছু খেয়ে নেয়। তারপর রেড়ি হয় স্কুলের জন্য।
সে স্কুলে বাচ্চাদের ইংলিশ ক্লাশ নেয়। কারণ সে খুব ভালোভাবে গ্রামার বুঝাতে পারে। অল্পদিনের মধ্যে সে বাচ্চাদের এবং অভিভাবকদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। কিছুদিন পড়ানোর পর অনেক অভিভাবকরা ফোন দিতে লাগলে, আমার ছেলেকে টিউশনি করাতে হবে। ভালো টাকার অফার। কিন্তু তার তাতে ইচ্ছা নেই। কোন টিউশনি নেন নি। একরাম হোসেন মনে মনে ভাবেন, এখানে তিনি টাকার জন্য পড়ান না। তার কাছে যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে। যেটা নেই, সেটা হচ্ছে ভালোবাসা। বিজয় চলে গেলেই তিনি একা হয়ে যান। কোথাও তার ভালো লাগে না। তাই সে কিছুটা সময় বাচ্চাদের সাথে কাঁটান। এই কারণ ছাড়া তার অন্য কোন কারণ নেই। পড়াতে তার ভালো লাগে। কাউকে একটা নতুন কিছু শেখাতে পারলে মনের ভিতর শান্তি লাগে।
ঝকঝকে রোদ আশেপাশে। একরাম হোসেন বাড়িতে যাবে। যদিও রোদটা খুব দারুন। শীতের তিব্রতা কাঁটিয়ে রোদটা যেন আশীর্বাদ স্বরুপ। গা টা ঝড়ঝড়ে হয়ে যায়। শ্যামপুর স্টেশনের কাছে এসে দেখল আশেপাশে রিকশাটিকশা বেশি নেই। সকালবেলা আর বিকেলবেলা এদিকে প্রচুর ভিড় থাকে। দূরে একজন রিকসাওয়ালা রিকসার উপরে বসে উদাস হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে মাক্স। একরাম হোসেন রিকশাওয়ালার কাছে গিয়ে বলল, নবীনগর বাজারে যাবে? ছেলেটা প্রথমে তার দিয়ে ঢ্যাপঢ্যাপ করে তাকি তারপর বলল, যাবোনা অইদিকে এখন। একরাম হোসেন বলল, টাকা ডাবল দিবো তারাতারি যাও। দরকারি কাজ আছে। এই কথা বলেই সে রিকসায় উঠে বসল। অগত্যা ছেলেটা রিকসা নিয়ে ছুটে চলল বাজারের দিকে।
একরাম হোসেন ছেলেটাকে বলল, তা বাসা কই তোমার?
- আজ্ঞে, বাড়ি ময়মনসিংহ।
- ও। মনে হচ্ছে তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি, তাই ভাবলাম তোমার বাড়ি হয়তো এখানেই হবে।
রিকসা এগিয়ে চলল। একরাম হোসেন ছেলেটার সাথে কথা বলেই যাচ্ছে।
- তোমার মতো আমার একটা ছেলে আছে। তা সারাদিন যে কই কই থাকে তার হিসাব জানি না। থাকে দেশের বাইরে। এইবার এসেছে। ভেবেছি কিছুদিনের মধ্যে ওর বিয়ে দিয়ে দিবো। এতো বড় হয়ে গেছিস, বিয়েশাদি করবি না? তা আমার কথা শুনতেই চায় না। হয়েছে ওর মায়ের মতো। কথা শুনতে চায় না। তা বাবা তুমি বিয়ে করো নি?
ডানেবামে মাথা নাড়ালো ছেলেটি। একরাম হোসেন আবার বলল, ও। তাহলে তুমিও আমার ছেলের দলে। সমস্যা নেই। যাও। আমার বাবা বিয়ে করেছিলো দশ বছর বয়সে। আর আমি বিয়ে করেছিলাম উনিশ বছর বয়সে। কিন্তু নিজের ছেলের বয়স যে কতো হয়েছে আমি নিজেই ভুলে গেছি।
একরাম হোসেন কিছুক্ষন পরে বাজারে আসলেন। রিকসা থেকে নেমে ছেলেটাকে ভাড়া দিয়ে গিয়ে তিনি বললেন, তোমাকে বড় বেশিই চেনা চেনা লাগছে। আমার মাথায় কিছু আসছে না।
ভাড়াটা হাতে দিয়ে তিনি চলে যেতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেলেন। ছেলেটাও রিকশাটা নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সরে যেতে চাইছিলো। কিন্তু একরাম হোসেন পেছন থেকে বলল, এই ছেলে দাঁড়াও। একরাম হোসেন ছেলেটার দিয়ে এগিয়ে গেল। তারপর ভালোমতো ছেলেটার কাছে গিয়ে কী একটা লক্ষ করল। তারপর বলল, তোমার গায়ে যে শার্টটা, এটা তো আমার। কিছুদিন ধরে খুঁজে পাচ্ছি না। এই শার্ট তোর কাছে আসলো কিভাবে? কথা শুনে ছেলেটার চোখ দুইটা মার্বেলের মতো বড় বড় হয়ে গেল। একরাম হোসেন ছেলেটার কলার ধরে রিকসা থেকে নামাল। তারপর বলল, বল! এটা শিউর যে এই শার্ট আমার। কবে চুরি করলি বল। সালা চোর।
ঘটনাটা আশেপাশের মানুষ দেখছিলো। একটা রিকসাওয়ালা ছেলের শার্টের কলারে হাত দেওয়াতে ঘটনাটা অনেকেই দেখছিলো। রিকসাওয়ালার গায়ে হাত তোলাটা বড্ড অন্যায়। কিন্তু যিনি হাত তুলেছেন তিনিও বয়স্ক। সুতরাং সাধারণ লোক কার পক্ষ নিবে সেটা তারা ভাবে পাচ্ছে না। একরাম হোসেন ছেলেটাকে বলল, কে তুই? তোকে এখনি পুলিশে দেব। তারপর সে ছেলেটার মুখের মাক্সটা টান মেরে খুলে ফেলে দিল।
পুরো শহড়টা যেন এক মুহুর্তের মধ্যে নিরব হয়ে গেল। সুদীর্ঘ ৩-৪ মিনিট দুজনের ঝগড়ার পর যখন একে অপরের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখলো, তখন আশেপাশের দর্শকরা সবাই অবাক হয়ে গেল। একরাম হোসেন নিজের ছেলের দিকে অবাক হয়ে বলল, বিজয় তুই?
- অপরিচিত কোন মানুষের সাথে পরিবারের ব্যাক্তিগত কথাগুলো না বললে হয় না তোমার?
চুপ করে ছোফায় বসে আছে বিজয়। তার বাবা ফ্লোরে পায়চারি করছে। নিজের ছেলেকে এতো কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছে সে। নিজের টাকায় সে বিদেশে দামী চাকরী করতে পাঠিয়েছে। আর সেই ছেলে কিনা একটা সামান্য মেয়ের জন্য রিকসা নিয়ে মেয়ের পিছনে পিছনে ঘুড়ছে।
বিজয় বলল, মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয় বাবা। ওকে তুমি সামান্য বলবে না। অনেক পরিশ্রমী মেয়ে। এতো পরিশ্রম করার পরেও সে নিজের বাবা মাকে কেয়ার করে। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।
- আমি তো নিষেধ করি নি। বিয়ে করতে চাইলে বলতি। আমি মেয়ের পরিবারের সাথে কথা বলতাম। রিকসা নিয়ে মেয়ের পিছে পিছে ঘুড়ার কী দরকার ছিলো?
- আমি শুধু মেয়েটাকে কাছে থেকে দেখতে চেয়েছি বাবা। ওর সাথে কিছুটা সময় কাঁটিয়েছি। ওকে চিনেছি। আর সব যখন জেনেই গেছো তাহলে আর কী করার। ইচ্ছে হলে তুমি মেয়ের বাবার সাথে কথা বলতে পারো।
একরাম হোসেন ছেলের কথা নিয়ে মোটেও বেশি কিছু ভাবছে না। রিকসা চালিয়েছে বলে যে ছেলে আহামরি খারাপ কাজ করে ফেলেছে সেটা মোটেও না। কিন্তু রিকসা? একরাম হোসেন বিজয়কে ডাক দিয়ে বলে, রিকসার পেছনে কত টাকা খরচ করেছিস?
- আনুমানিক হাজার পাঁচেক হবে হয়তো।
- ইদানিং গাছ থেকে টাকা ফলাচ্ছিস নাকি? এতো টাকা খরচ করার কোন মানে আছে?
বিজয় কোন কথা বলল না। চুপ করে ওয়াশরুমে চলে গেল। একরাম হোসেন টিভিটা চালু করল। তারপর আরাম করে সোফায় বসল।
পরদিন সকালে একরাম হোসেন চা খাওয়ার সময় বিজয় বলল, বাবা আমি চললাম। একরাম হোসেন অবাক হয়ে বলল, আজকেও যাবি? বিজয় মাথা নিচু করে বলল, সরি বাবা। আজকেও যাবো। একরাম হোসেন বলল, সাবধানে যাস। বিজয় বের হয়ে গেল।
রিকসা নিয়ে বসে আছে বিজয়। একটু পরেই মেয়েটা আসবে। শীত অনেকটা কমে আসছে। শীত চলে যাবে কী? কিছুক্ষন পরে মেয়েটাকে দেখা গেল। একটা শাড়ী পড়েছে সে। চুল বাঁধা। বিজয়কে সে দেখেছে। তবুও না দেখার ভান করলো কেন? বিজয়ের কেমন যেন লাগতে লাগলো। মেয়েটা এমন করছে কেন? মিতু অন্য একটা রিকসা দাঁড় করিয়ে সেটাতে উঠে চলে গেল। বিজয়ের বুকের ভিতরটা কেমন যেন লাগতে লাগল। মনে মনে সে ভাবতে লাগল, সে কী মেয়েটার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেছে? কিন্তু তার জানা মনে তো সে তার সাথে কোন খারাপ ব্যাবহার করে নি। তবুও মেয়েটা এমন করছে কেন।
বিজয় মিতুর রিকসাটার পেছনে পেছনে যাচ্ছে। আশেপাশে তার খেয়াল নেই। মিতু তার সাথে এমন করল কেন। ভেবে বিষয়টা সমাধান করতে পারলো না সে। বিজয় পেছন থেকে বার বার হর্ণ দিচ্ছে। মিতু একটিবারের জন্যও তাকিয়ে দেখছে না। হঠাৎ এরকম পাষাণ হয়ে গেলে হয়। একটা ছেলের সাথে কতো ভালো ব্যাবহার করে হঠাৎ ইগনোর করলে অন্যজনের কেমন লাগে সেটা কি এই মেয়ে যানে না? কিছু ভালো লাগছে না বিজয়ের। হাত পা কাঁপছে তার। মনে মনে ভাবছে, নাহ। আর আসবো না। কী লাভ একটা মেয়ের জন্য এভাবে ঘুড়ে ঘুড়ে। মাথায় তার অসংখ্য চিন্তা। হঠাৎ একটা প্রাইভেটকার বিজয়ের রিকসার সামনে চলে আসলে বিজয় সেটা কোনভাবেই খেয়াল করে নি। গাড়িটা এসে বিজয়ের রিকসার মধ্যে সরাসরি ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। বিজয় রিকসা থেকে ছুটে গিয়ে রাস্তায় পড়ে তার জ্ঞান হাড়ায়। প্রাইভেট কারটা একটু সময়ের জন্য থেমেছিলো। কিন্তু ড্রাইভার পেছনে তাকিয়ে দেখল অবস্থা খুব খারাপ। তখন গাড়িটা সে আর দাঁড় করায় না। সাথে সাথেই সেই জায়গা থেকে পালিয়ে যায়।
বিজয়ের যখন জ্ঞান আসে তখন আনুমানিক বিকেল। সে আসেপাশে তাকিয়ে দেখে একটা হাসপাতলে আছে সে। উঠতে গিয়ে উঠতে পারলো না। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল হাতে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। মাথা প্রচন্ড ভাঁড়ি। মাথার মধ্যে ব্যান্ডিস করা হয়েছে। বিজয় বুঝতে পারল তার শরির অনেক দুর্বল। কিছুক্ষন পর একটা নার্স রুমে আসলো। স্যালাইনের গতিটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছেন তো এখন?
- হ্যাঁ।
- চিন্তা করবেন না। কোন সমস্যা হয় নি। আপনি সম্পুর্ণ সুস্থ আছেন। তবে কিছুদিন রেস্ট নিতে হবে।
- আমি এখানে আসলাম কখন? কে এনেছে এখানে?
- একটা মেয়ে এসেছিলো। আপনাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেছে। মাথায় তো অনেক আঘাত পেয়েছিলেন আপনি। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। এক ব্যাগ রক্ত লেগেছে আপনার। রক্তটাও অই মেয়ে দিয়ে গেছে।
কে দিতে পারে রক্ত? নার্স কোন মেয়ের কথা বলছে? মিতু? তাছাড়া আর কে?
বিজয় নার্সকে বলল, আমি বাসায় যেতে পারবো কখন?
- চিন্তা করবেন না। সন্ধ্যার মধ্যে আপনি চলে যেতে পারবেন।
বাবা নিশ্চই অনেক চিন্তা করছে আমাকে নিয়ে। বাসায় গেলে তো আরেকটা ঝামেলা হবে। বাবার হাতে যে বকা খেতে হবে সেটা নিশ্চিত। কী করা যায়? নাহ। আজকে বিজয় বাসায় যাবে না। বাবাকে ফোন করে জানাবে, আজকে বন্ধুর বাসায় থাকতে হচ্ছে। কার বাসায় থাকবে সে? জাভেদকে বলে দেখলে ভালো হবে।
শুয়ে শুয়ে এসব চিন্তা করতে করতে বিকেল হয়ে আসল। সারে চারটা বাঁজে। কিছুক্ষন পরেই বিজয় দেখল দরজার পাশে মিতু দাঁড়িয়ে আছে। মিতু আস্তে করে বলল, আসতে পারি ভেতরে?
বিজয় একটু সময়ের জন্য যে চমকে গেল। তারপর বলল, হুম।
মিতু ভেতরে এসে পাশে রাখা চেয়ারটাতে বসল। তারপর বলল, ঠিক আছেন তো?
- হুম। ঠিক আছি। আপনাকে ধন্যবাদ আমার জীবন বাঁচানোর জন্য।
- জীবন বাঁচানোর মালিক তো একমাত্র আল্লাহ। আমি শুধু চেষ্টা করেছি বলতে পারেন।
বিজয় মিতুর দিয়ে তাকিয়ে দেখল, মিতুর মুখটা আগের চাইতে অনেকটা ফর্সা হয়েছে। কথা বলার ভঙ্গিটা কেমন মলিন হয়ে গেছে।
"আমার জন্য এতো কিছু করতে গেলেন কেন?", বিজয় মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল। মিতু বলল, কী আর করলাম? মানুষ হিসেবে তো এতটুকু উপকার করতে পারি।
দুজনে কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়ে রইলো। বিজয় কী বলবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না। মিতুই তার জীবনের একমাত্র মেয়ে যার সাথে কথা বলার মতো ভাষা সে মাঝে মাঝে হাড়িয়ে ফেলে।
মিতু নিরবতা ভেঙে বলল, কিছুদিন ধরে দেখছি আমাকে ফলো করছেন? আমার পেছনে পেছনে অফিস পর্যন্ত যাচ্ছেন। কারণটা কি জানতে পারি?
মিতুর এই কথার জবাব সে কিভাবে দিবে? বিজয়ের বুকটা ধরফর করছে। কী জবাব দিবে সে? বিজয় নিজের চোখটা বন্ধ করল। তারপর বলল, আমি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। আপনাকে যেদিন আমি প্রথম দেখেছিলাম। সেদিনই আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?
আবারো কিছুক্ষন নিরবতা। মিতু হয়তো এই কথাটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে। এ কী বলল বিজয়? মেয়েটাকে এভাবে লজ্জায় ফেলা কী ঠিক হলো। এখন কি করবে সে? মিতু চেয়ার থেকে উঠে বলল, আজ আসি।
তারপর দ্রুতপদে নিজের কাঁধের ব্যাগটা ঠিক করে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। সন্ধ্যার দিকে বিজয় হাসপাতাল থেকে বের হল। সবচেয়ে বেশি অবাক হলো এটা শুনে যে বিজয়ের হাসপাতলের বিল মিতু দিয়ে গেছে।
বিজয় বাসার দিকে যাচ্ছে। হেঁটেই যাচ্ছে। ইচ্ছা ছিল জাভেদের বাসায় যাবে। কিন্তু যাবে না। নিজের বাসায়ই যাবে। একরাম হোসেন নিশ্চই রাগ করবেন। একটু রাগ হজমই করতে হবে।
বাসায় আসতে আসতে রাত হয়ে গেল। দরজা খুলতেই একরাম হোসেন দেখল ছেলের মাথায় ব্যান্ডেজ পেচানো। বিষয়টা দেখে সে চমকে গেল। তারপর বলল, এসব কিভাবে হল? বিজয় বলল, কিছুই হয়নি বাবা। সামান্য একটু ব্যথা পেয়েছিলাম।
- মনে তো হয় না সামান্য।
- মাথায় একটু ব্যথা পেয়েছি। আর হাতের কুনুইয়ে একটু পেয়েছি।
- তোকে কতোবার বলি এভাবে অই মেয়ের পেছনে ঘুড়ে ঘুড়ে এভাবে সময় নষ্ট করিস না। এখন বড় হয়েছিস বলে তুই যা ইচ্ছা করবি? আমি বলে দিলাম, কাল থেকে তোর রিকসা নিয়ে যাওয়া বন্ধ।
বিজয় মাথা নিচু করে বলল, ঠিক আছে বাবা। আর যাবো না।
মাথার পেছনে এখনো ব্যথা করছে। রাতে বিজয় ভালোমতন ঘুমাতে পারলো না। হাতের কব্জির মধ্যে ব্যথায় টন টন করছে। তবে বিজয়ের বার বার মিতুর কথা মনে পড়ছে। একটা জিনিস ভেবেই বিজয়ের গা শিউরে উঠছে। মেয়েটার ভালোবাসা বিজয়ের শিরা-ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে। মেয়েটাও কি বিজয়কে ভালোবাসে? বিজয় সত্যিটা জানে না।
পরদিন সকালে বিজয় গেল রিকসা হাউজের সামনে। সেখানে যাওয়ার পর বিজয়কে কয়েকটা গা/লী শুনতে হলো। রিকসার মালিক বিজয়কে যাচ্ছেতাই বকছেন। বিজয় কাছে গিয়ে বলল, আংকেল! গা/লী দিয়ে নিজের চরিত্র প্রকাশ করার দরকার নেই। আমি ইচ্ছে করে একসিডেন্ট করি নি। কত টাকা লাগবে দিয়ে দিচ্ছি। রিকসা হাউজের মালিক রেগে ফোস ফোস করে বিজয়ের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। বিজয় লোকটাকে বলল, কত টাকা লাগবে? লোকটা বলল, ৫০০০ টাকা লাগবে। রিকসার এক সাইট তো এক্কেবারে শেষ। বিজয়ের আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। লোকটার হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসলো।
আজকে আর রিকসা নিবে না সে। হেঁটেই যাবে বাজারের দিকে। হাটুতে একটু ব্যথা আছে। তবে হাঁটতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। অনেক দিন ধরে বন্ধুদের সাথে কথা হচ্ছে না। ওরা কেমন আছে কোন খবর নেই তাদের। প্রথম দিনের মতো গাছের নিচের বৈঠক আর বসে না। অনেক দিন ধরে চা-টাও খাওয়া হচ্ছে না। বিজয় হাঁটতে হাঁটতে বাজারের সামনে গেল। একটু পরেই মিতু আসবে। আগের মতো আর শীত নেই। আস্তে আস্তে শীত চলে যাবে। বিজয়ের আফসোস গ্রীষ্মকালটা তার দেখা হবে না। অনেক দিন ধরে সে কালবৈশাখী দেখে না। ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভেঁজা। চারদিকে আকাশ কালো হয়ে আসাটা সে অনেক মিস করে। এর পরেরবার যখন আসবে তখন কালবৈশাখীর কোন ঝড়ের দিনে ঘুড়তে আসবে।
বিজয় রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল মিতু নামের মেয়েটা আসছে। আজকে তাকে এতো সুন্দর লাগার কারণ কী? মিতু আশেপাশে তাকানোর পর বিজয়ের দিকে তাকাল। অল্প কিছুক্ষন। আজকে বিজয় রিকসা নিয়ে আসে নি। দুজনের কিছুক্ষনের জন্য চোখাচোখি। কাছে আসা, কথা বলা কিছুই হলো না। মিতু একসময় একটা রিকসায় উঠে অফিসের দিকে রওনা হয়ে গেল। এর চেয়ে বেশি কিছু আর হলো না। বিজয় মেয়েটার চোখের ভাষা বুঝতে পারে না। সে কী বলতে চায়? বিজয় রাস্তা পার হয়। মিতু যে জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে যায়। একটা জিনিসের জন্য। যাওয়ার পর নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা চিরকুট। রাস্তায় পড়ে আছে। বিজয় সেটা হাতে নিল। তারপর দেখে, মিতুর হাতের লেখা। সে লিখেছে, "ভালোবেসে কি কেউ কখনো ভুল করে?" এতোটুকুই লেখা।
আজকে বিকেলবেলা জাভেদ ফোন করল। বলল, বন্ধু। ইনশাআল্লাহ! কালকে আমি আর আরিফ চলে যাচ্ছি। তাই ভাবলাম আজকে বিকেলে তোদের সাথে একটিবারের জন্য দেখা করে যাই। বিজয় বলল, আসবো।
সময় কতো দ্রুত ফুরিয়ে যায়। আর কিছুদিন পরে তাকেও চলে যেতে হবে। বিজয় আকাশের দিকে তাকায়। খুব ইচ্ছে করে এই দেশে থেকে যেতে। একদিন সে বাবাকে বলবে, বাবা! আমি আর বিদেশ যাচ্ছি না। এই দেশেই কোন কাজ করবো। কী লাভ এতো টাকা দিয়ে? যদি ভালোবাসার জিনিসগুলো না থাকে?
বিজয়ের যখন সাত বছর। তখন তার মা চলে গেল। জীবনের অর্ধেক সুখ তো জীবন থেকে তখনি চলে গেছে।
বিকেলবেলা আজকে আবার সব বন্ধুরা একত্রিত হলো। তবে প্রথমদিনের মতো ভালোলাগা আজকে নেই। মনে হচ্ছে এখানে না আসতে পারলেই হয়তো ভালো হতো। বিজয় জাভেদকে বলল, তা কখন বের হবি?
- কাল ইনশাআল্লাহ্ ভোরে রওনা হবো। আমি আর আরিফ একসাথেই রওনা হবো।
- অহ। তাহলে কালকে আর দেখা হচ্ছে না। আজকেই শেষ দেখা।
- হয়তো। তবে আমরা তো মাঝে মাঝে আসি এখানে। কিন্তু এটা ভেবেই খারাপ লাগছে যে তোর সাথে আবার কবে দেখা হবে কে জানে।
- ধুর। এসব নিয়ে চিন্তা করিস না। দেখিস আবার দ্রুতই দেখা হবে। আর তাছাড়া ফোনে তো কথা হবেই। এতো চিন্তা কিসের? সন্ধ্যার দিকে আড্ডাটা ভেঙে গেল। ভালো থাকিস, নিজের শরিরের যত্ন নিস, এসব কথা ছাড়া যাওয়ার সময় আর কোন কথা হলো না। বিজয়ের ইচ্ছা ছিলো আড্ডাটা আরেকটু লম্বা করতে। জাভেদ বিজয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, ব্যাগপত্র গোছানো হয়নি। অনেক কাজ। অন্য আরেকদিন দেখা হবে।
বাসার আসার পরে বিজয় কিছুক্ষন বিছানায় শুয়ে রইল। তার বিশ্রাম নেওয়া উচিৎ। আজকে হাঁটাহাটি একটু বেশিই হয়ে গেছে। পায়ে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। একটু ঘুমাতে পারলে ভালো লাগতো। মাথায় একটু একটু যন্ত্রনা হচ্ছে। মাথায় ভালোই আঘাত পেয়েছিলো সে। প্রচুর র/ক্তক্ষরণ হয়েছে। মাঝে মাঝে মাথায় কিছু কিছু জায়গাতে ঝিম ঝিম করছে।
পরদিন সকালে বিজয় ঘুম থেকে উঠল। তারপর হালকা কিছু নাস্তা করে তার বাবাকে বলল, বাবা। আমি বাইরে যাচ্ছি।
- কোথায় যাবি?
- সরি বাবা।
- তাহলে আমার কথা শুনছিস না।
বিজয় প্রথমে রিকসা হাউজে গেল। তারপর সেখান থেকে একটা রিকসা নিল। রিকসার মালিক বলে দিল, সাবধানে চালাবেন। কালকের মতো রাস্তায় শুয়ে থাইকেন না, বুচ্ছেন। "চেষ্টা করব", বলে বিজয় বাজারের দিকে রওনা হয়ে গেল। আর কিছুক্ষন পরে মিতু আসবে। মেয়েটা আজকে তার জন্য অপেক্ষা করবে কিনা জানা নেই। তবুও বিজয় যাচ্ছে। কেন জানি মনে হচ্ছে আজকে মিতু আসবে। কালকের চিরকুটটাতে অনেক কথা লুকানো আছে। অবশ্যই বিজয় ভালোবেসে ভুল করে নি। এটা তার কথা না। এটা মেয়েটার কথা।
বাজারে যাওয়ার পর বিজয় সত্যি অবাক হয়ে দেখল মিতু রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দেখেই বুঝা যায় সে কারো জন্য অপেক্ষা করছে।
চলবে...
Comments
Post a Comment