একটা ভালোবাসার গল্প
একটা ভালোবাসার গল্প
পর্ব ৬
মিতু বলল, এতো তারাতারি চালানোর কী দরকার? অফিস দেরি আছে তো। আর আপনার মাথায় সমস্যা আছে তো। নাহলে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে কেউ রিকসা চালায়? নিজেকে কী মনে করেন? হাল্ক?
- তেমনটাই।
- আপনার কিছুদিন আসতে হবে না। বাড়িতে রেস্ট নিবেন।
- আচ্ছা। চেষ্টা করবো।
- আস্তে আস্তে চালান।
বিজয় রিকসার গতি কমায়। আস্তে আস্তে চালানোর চেষ্টা করে। বিজয়ের একটা কথা মিতুকে বলতে ইচ্ছে করে। সেটা হচ্ছে, এতোদিন আমাকে এভাবে ইগনোর করলেন কেন? আমার কোন কথায় কি আপনি রাগ করেছিলেন? কিন্তু বিজয় কোনভাবেই মিতুকে সেই কথাটা বলতে পারছে না।
মিতু আবার বলে উঠে, এখন থেকে ভালোভাবে চালাবেন। সেদিন আপনার যে অবস্থা হয়েছিলো। আমি যদি যেখানে না থাকতাম তাহলে কী যে হতো কে যানে।
"সেই জন্যই তো আপনাকে চাই", কথাটা মনে মনে বলে বিজয়।
কিছুক্ষন পর মেয়েটার অফিসের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। মেয়েটা রিকসা থেকে নেমে মুচকি হেঁসে বলে, আশা করি ভাড়া দিতে হবে না। বিজয় মাথা নাড়ায়। ভাঁড়া দিতে হবে না। সে ভাঁড়া নেওয়ার জন্য আসে না। সে শুধু মেয়েটার মুখে এমন হাঁসিটা বার বার দেখতে চায়। এইটুকু দেখার জন্যই সে বার বার আসে।
একরাম হোসের বিজয়কে মাঝে মাঝে বলে, তুই যে দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছিস এটা তুই বুঝতে পারছিস না? বিজয় বুঝতে পারে পাগলামিটা তার বেশিই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও তার এই পাগলামিটা বার বার করতে ইচ্ছে করছে।
একরাম হোসেন বলল, এই কিছুদিন কোথায় যাবি না। তুই কিন্তু অসুস্থ। বিজয় তার বাবাকে বলে, আমি এখন মোটেও অসুস্থ না বাবা। আমি এখন যথেষ্ঠ ঠিক আছি। তুমি কেবল আমাকে নিয়ে শুধু শুধু চিন্তা করছো।
একরাম হোসেন মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলে, তুই যা ইচ্ছা তাই কর। তবে মেয়ে দেখতে তো আমাকেই যেতে হবে তাই না? তখন আমি যেতে পারবো না। বিজয় বলে, যেতে হবে না তোমাকে। আমি নিজে বড় হয়েছি। আমি একাই যেতে পারি।
এভাবে চলতে লাগল কিছুদিন। প্রতিদিনই তাদের দেখা হয়। তবে কথা দুজনের মধ্যে খুব কম হয়। বিজয়ের কথা বলার সাহস হয় না। মেয়েটাকে ভালোবাসার কথা বলার পর থেকে বিজয় মেয়েটার প্রতি যেন আরো দুর্বল হয়ে গেছে। তবে মেয়েটা স্বাভাবিক আছে। যেন তাদের মধ্যে কিছুই হয় নি। মনে হচ্ছে সে সব কিছু ভুলে গেছে। তার আচরণ স্বাভাবিক। অথচ এই মেয়েটাই সেদিন লিখেছিলো, "ভালোবেসে কেউ ভুল করে?" মাঝে মাঝেই ভালোবাসার কথাটা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বিজয় পারে না। বলার সাহস হয় না।
ছুটির দিনে মিতু আসতে বলে। সেদিন মিতু আসতে বলল বিজয়কে। সেদিন সে রেডি হল। মিতুর সাথে দেখা করবে। বিকেলবেলা। বিজয় অপেক্ষা করছে মিতুর জন্য। মিতু আসবে একটু পরে। বিকেল হলে একটু শীত শীত লাগে। কুয়াশা পড়তে আরাম্ব করে চারদিকে। সেই মৃদু কুয়াশার মধ্যেই মিতু আসবে।
বিজয় অপেক্ষা করে অনেক্ষন। বিকেলের আলো যখন অনেকটা কমে আসে তখন মিতু আসে। আজকেও সে একটা শাড়ী পড়েছে। চুলগুলো খোঁপা করা। কালো শাড়ী। বিজয় এক দৃষ্টিতে মিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে। মিতু একসময় তার কাছে এসে তাকে বলে, চলেন আজকে নতুন একটা জায়গায় ঘুড়ে আসি। বিজয় অনিশ্চিত গলায় বলে, কোথায় যাবেন?
- বিশেষ কোন জায়গায় নয়। সেখানেই যাবো যেখানে দুজনে একটু ভালোভাবে কথা বলতে পারবো।
বিজয় আর কিছু বলে না। দুজন একটা রিকসায় উঠে রওনা হয়। মিতু কিছুটা ঘেঁষেই বসেছে বিজয়ের পাশে। রিকসাটা বড্ড চাঁপা। মেয়েটার শাড়ির তিব্র ঘ্রাণ তাকে ক্রমশ বিমোহিত করে দিচ্ছে। মিতুর হাতের স্পর্শ বার বার তার গায়ের লোমগুলোকে প্রভাবিত করছে। কিন্তু সে নিরুপায়।
অনেকটুকু কুয়াশা পড়ে গেছে। তারা যেখানে আসলো আশেপাশে কোথাও কোন ঘড়বাড়ি নেই। সামনে অনেক বড় একটা সবুজ খেলার মাঠ। মাঠের পাশটাতে কয়েকটা বেঞ্চ। আশেপাশেও কয়েকজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। দূরে কয়েকটা ছেলেমেয়ে খেলাধুলা করছে। তাদের বাবা-মায়েরা হয়তো খেলাগুলো কিছুটা উপভোগ করার চেষ্টা করছে। মিতু বলল, আসুন ওখানটাতে গিয়ে একটু বসি।
- কী আছে এখানে?
- শুন্যতার চাইতে বড় জিনিস কী হতে পারে এই পৃথিবীতে। শুন্যতাই আছে ওখানে।
একটা বেঞ্চের উপরে বসলো দুজনে। বিজয় বলল, তা কেন ডাকলেন এখানে? কোন বিশেষ কারণ আছে কী?
- বলতে পারেন আজকে আমার মনটা ভালো। তাই ভাবলাম এখানে কিছুক্ষন কাঁটাই।
- আমাকে ডাকলেন যে?
- বলতে পারেন, সুন্দর মুহুর্তগুলো একা একা কাঁটানোর চেয়ে ভাবলাম আপনাকে নিয়ে আসি। মুহুর্তগুলো আপনার সাথে ভাগাভাগি করি। এটাই।
- অনেক মানুষই তো আছে পৃথিবীতে। সেখানে আমিই কেন? আমি কী আপনার কাছে কোন বিশেষ কিছু?
- বিশেষ তো অবশ্যই। সেটা বুঝতেই পারছেন।
- হুম হতেই পারে। কারো সাথে কথাবার্তা হতে হতে পরিচয় হয়। দেখা হয় নিয়মিত। আস্তে আস্তে তারা তো বিশেষ মানুষ হবেই।
দুজন কিছুক্ষন চুপ। বিজয় কিছুক্ষন দূরে ছেলেমেয়েগুলোর খেলা দেখল। কী খেলা ওইটা? বিজয় নাম মনে করতে পারছে না। মিতুকে জিজ্ঞেস করলে মিতু হয়তো বলতে পারবে। বিজয় তাই মিতুকে উদ্দেশ করে কিছু বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল।
মিতু বলল, যানেন। আমি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি।
কথাটা শুনে বিজয় যেন পুরোটাই থমকে গেল। মিতু বলল, দিন দিন আমি ক্রমশ আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি জানি না এভাবে কারো প্রতি দুর্বলতা আমার জন্য ঠিক হবে কিনা। তবে আমি নিজে অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারছি না। এই কথাটা আমি আপনাকে বলতাম না। তবে বাধ্য হয়েই বলতে হচ্ছে। আমি আর চাই না আপনি কেবল আমার জন্য রিকসা নিয়ে শুধু শুধু বসে থাকেন। পারলে আমাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন প্লিজ। দিন যত যাচ্ছে আপনার প্রতি আমার মায়াটা ক্রমশ বাড়ছেই। আমি চাই না আর সেটা বাড়ুক।
দুজন আবার কিছুক্ষন নিরব। দিনের আলো অনেকটাই কমে এসেছে। কিছুক্ষন পরে হয়তো মাগরিবের আযান হবে। বাবা মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হচ্ছে। কুয়াশার চাদর দিয়ে পুরো এলাকাটা ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছে। বিজয় মনে মনে বলছে, আপনিই তো বলেছিলেন, ভালোবাসা কী অপরাধ? যে, ভুল হয়ে গেলে তার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে?
বিজয় নিরবতা ভেঙে মিতুকে বলে, দুজনেই তো ভুল করলাম। দুজনের ভুলটা শুধরে নেওয়া যায় না?
- আমি সেটা জানিনা।
- আপনি চাইলে তো করা যেতে পারে।
- দেখুন। আপনার আমার জীবনের মধ্যে অনেক তফাৎ। এতোটা তফাত নিয়ে কিভাবে সম্ভব?
- তারমানে আপনি এটাই বোঝাতে চাচ্ছেন যে আমি একজন রিকসাচালক বলে আমার সাথে সম্পর্ক করা যাচ্ছেনা। সেটাই তো।
প্রথম মিতুর চোখে সে পানি দেখেছিলো যেদিন সে কয়েকটা খারাপ ছেলেদের থেকে সে মিতুকে বাঁচিয়েছিলো। আবার পুনারায় বিজয় আজকে মিতুর চোখে পানি দেখতে পেল। ছল ছল করছে তার চোখদুটা।
মিতু বলল, এমনটা বলবেন না প্লিজ। আমি আর এসব নিতে পারছিনা। আমি কোথায় যাবো বলুন তো। আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ।
মিতুর চোখের পানিতে দুই গাল ভিঁজে যাচ্ছে। নিজের জন্য কাউকে সে এভাবে কাঁদতে দেখে নি। কি বলে শান্তনা দিবে মেয়েটাকে। কিছু বলার মতো ভাষা সে খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু বিজয় এতোটুকুই বলল, তো আপনি এখন কী চাচ্ছেন?
- আমি চাচ্ছি আমাকে ভুলে যান প্লিজ। যদিও আমার কিছুটা কষ্ট হবে তবে সেটা অল্প। জানেন তো, একটা গাছ কচি বয়সেই ছেঁটে ফেলে দিতে হয়। গাছটা বড় হয়ে গেলে সেটা আর সম্ভব হয় না। ভালোবাসাটাও তেমনই। সময় যত বেশি হয়। ভালোবাসার গভীরতা তেমনটা বাড়তে থাকে। ভালোবাসা বেশি হয়ে গেলে সেটা আর কমানো সম্ভব না।
- তারমানে আপনি বলতে চাইছেন আমাদের মধ্যে ভালোবাসা হতে পারে না?
মিতু কিছুটা শক্ত গলায় বলল, না। আমাকে মাফ করে দিবেন। আমাকে ভুলে যাবেন প্লিজ।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক্ষন। দিনের আলো এখন বেশি অবশিষ্ট নেই। বিজয় আর মিতু চুপ করে বসে আছে। মাঝে মাঝে দূরে কোথাও একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাছাড়া পরিবেশটাও অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।
একসময় মিতু বলল, তাহলে আমি আজ আসছি। ভালো থাকবেন। আর যদি পারেন আমাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
মিতু চলে গেল। যাওয়ার সময় বিজয় অপলকভাবে মিতুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মিতুর হয়তো ইচ্ছে করছিলো একটু পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখতে। তবে তাকাল না। সোজা সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে সে চলে গেল।
বাসায় এসে কিছু ভালো লাগছে না বিজয়ের। রাতে কিছু খেল না বিজয়। একরাম হোসেন বার বার খাবার জন্য ডাকছেন। কিন্তু বিজয় এক কথা, আজ তার খেতে ইচ্ছে করছে না। অনেকবার ডাকার পরেও যখন বিজয় আসলো না। তখন একরাম হোসেন বিজয়ের রুমে গেল। বিজয় বিছানায় শুয়ে আছে। একরাম হোসেন বলল, বেশি পাগলামি করলে এমনি হয়। কী হয়েছে এখন খুলে বল।
- বাবা। এখানে আর আমার ভালো লাগছে না। আমি আর এখানে থাকতে চাই না। ভেবেছি বিদেশ চলে যাবো।
- অই মেয়েটার জন্য এভাবে তুই চলে যাবি?
- হ্যাঁ বাবা। আমি চলে যাবো।
- এভাবে ইচ্ছে হলেই চলে যাবি? আমার কথা ভাবলি না? ভেবেছিলাম তোকে এইবার বিয়ে দিয়ে তারপরেই তোকে যেতে দেবো।
- আমার কিছু ভাল্লাগছে না বাবা। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। আমি শিগ্রই চলে যাচ্ছি। তুমি ভালো থাকবে আশা করি।
একরাম হোসেন ছেলের মুখের উপরে এই মুহুর্তে কিছু বলতে পারছে না। চেষ্টা সে অনেক করল। কিন্তু বিজয়ের এক কথা, সে আর দেশে থাকবে না।
পাসপোর্ট রেডি করে নেয় বিজয়। বন্ধু করিম আর সালামকে জানায় সে চলে যাচ্ছে। বিষয়টা শুনে অবাক হয় দুজন। বিজয়ের কাছে কারণ জানতে চাইলে যে জানায়, এখানে তার আর ভালো লাগছে না।
করিম আর সামাদ বুঝতে পারল বিজয়ের অবশ্যই কোন একটা ঝামেলা হয়েছে। সামাদ বার বার সমস্যাটার কথা খুলে বলতে বলে। বিজয় কোনভাবেই আসল কাহিনীটা বলে না।
অবশেষে বাবা আর বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় জানিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায় বিজয়। যাওয়ার সময় বার বার চোখ গড়িয়ে কয়েকবার পানি পড়ল। বাবা বার বার বলে দিলো, নিজের যত্ন নিবি। আর কখনোই বাড়তি কোন চিন্তা করবি না।
মিতুর কিছুদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। ভেবেছিলো ছেলেটার সাথে কথা না হলেও রাস্তায় হয়তো মাঝে মাঝে দেখা হবে। কিন্তু তেমনটা হচ্ছে না। মিতু রাস্তায় ছেলেটাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করার পরেও বিজয়কে দেখতে পাচ্ছে না। ব্যাপারটা মিতুকে প্রচণ্ডভাবে হতাস বানিয়ে ফেলে।
একদিন শুক্রবারে মিতু বোরখা পড়ল। মিতুর বাবা বলল, কই যাচ্ছিস? মিতু মিথ্যে বলল। সেদিন মিতু বাজারের সামনে অনেক্ষন অপেক্ষা করল বিজয়ের জন্য। আশেপাশে অনেক দোকানপাট। কয়েকজন হয়তো তাকে খেয়াল করছে। সে বোরখা পরে এভাবে অনেক্ষনযাবৎ দাঁড়িয়ে আছে। লোকে তো খেয়াল করারই কথা। কিন্তু মিতু কোনভাবেই বিজয়কে দেখতে পেল না। হতাস হয়ে ফিরে আসে সে। বুকটা হঠাৎ করে কেমন যেন করে উঠে।
এই কদিনে তার খাওয়াদাওয়া একদম কমে গেছে। মিতুর বাবা-মা এসব জানে না। মিতু তাদের সামনে হাঁসিখুশি থাকে। কথা বলে। একই টেবিলে বসে খাবার খায়। একসাথে টিভি দেখে। তবে তার মনের ভিতরে হাহাকার করছে। ভেতরটা যেন জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। মিতু এসব যেন নিতে পারছে না।
রাইসা ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝতে পারে। একদিন মিতুর সামনে এসে রাইসা বলল, কিছুদিন ধরে দেখছি তুই সারাক্ষন মন খারাপ করে থাকিস। আর কিছুদিন ধরে ওই রিকসাওয়ালা ছেলেটাকেও দেখছিনা। কি হয়েছে তোর?
মিতু আর রাইসা বেঞ্চের উপর বসে আছে। সামনে সেই পুকুরটা। বিজয়ের সাথে সে এই বেঞ্চেই একদিন বসেছিলো। রাইসা বলল, তোদের মধ্যে কি হয়েছে খুলে বল তো?
রাইসা কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল, আমি ছেলেটাকে আস্তে আস্তে ভালোবাসতে আরাম্ব করেছিলাম। আর আমি চাই না আমাদের মধ্যে কোন প্রকার ভালোবাসা হোক।
- তো তুই এভাবে মন খারাপ করে আছিস কেন?
- আমি কিছুদিন ধরে ছেলেটাকে অনেক খুঁজলাম। পাচ্ছি না কোথাও। রাইসা, ভেবেছিলাম ছেলেটা সামান্য রিকসা চালায়। গরিব ফ্যামিলির ছেলে। তার সাথে বিয়ে আমার ফ্যামিলির কেউ মেনে নিবে না। তাই সম্পর্কটা আর আগাই নি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি যেন ভুল করেছি। অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি।
- থাক। এটা নিয়ে তুই আর চিন্তা করিস না। যেটা হয়ে গেছে, সেটা নিয়ে চিন্তা করে তো আর লাভ নেই। এখন নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা কর। তুই তো স্ট্রং পার্সোনালিটির মেয়ে। তোকে এভাবে কারো জন্য ভেঙে পড়তে মানায় না।
- কিন্তু আমি পারছি না। আমার এমন লাগছে কেন রে?
- এমনটা একটু লাগবেই। তোর ফ্যামিলি বন্ধুদের সাথে সময় দেওয়ার চেষ্টা কর। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
- তুই আমাকে ছেলেটাকে ভুলে যেতে বলছিস?
- হ্যা। আমি তাই চাই। আর মনে করি, এটাই তোর জন্য ভালো হবে।
মিতু আর কথা বলে না। রাইসা বলল, মিতু! বলতো কতদিন ধরে আমাদের পুরোনো বন্ধুদের দেখা হয় না?
- কী আর হবে দেখা করে?
- জানি কিছুই হবে না। কী হতে বলিস?
- জানিনা।
- তুই বলতে পারিস পৃথিবীর কোন কিছুতেই কিছু হয় না। একবার ভাব, তুই আমি বেঁচে থেকে পৃথিবীর কিছু হচ্ছে?
- না।
- কোন কিছুতেই আসলেই কিছু হয় না। আমাদের সবকিছু এমনি এমনিই করতে হয়।
সন্ধ্যার সময় মিতু বাসায় আসে। এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়। বিজয়কে খুঁজে পাওয়ার আশা সে প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। কিন্তু ছেলেটার কথা মনে পড়ে তার। মনে পড়ে রিকসায় করে অফিসে যাওয়ার সময়গুলোর কথা। মনে পড়ে সেদিন রাতের কথা। খারাপ ছেলেগুলো মিতুকে এখন বিরক্ত করতে আসে না।
শীতকাল বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই। এখন বৈশাখ মাস। গত রাতেই প্রচন্ড ঝড় হয়েছে। আজকে আকাশ মেঘলা। ছাতা হাতে নিয়ে অফিসে যেতে হয়। একটু পর পরই হালকা বৃষ্টির ফোঁটা গা ভিজিয়ে দিতে আসে। মিতু মনে মনে বলে, এই মেঘলা সময়টাতে আপনার সাথে আর দেখা হচ্ছে না। রাস্তায় দাঁড়ালে এখনো মিতু উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। একদিন হয়তো ছেলেটা আসবে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই আসবে। এসেই বলবে, আমরা যে ভুলটা করেছি তা শুধরে নেওয়া যায় না? আসুন না, আমরা এক হয়ে যাই।
মিতু বলবে, যাবে। অবশ্যই যাবে। সমাজের বানানো নিয়মকানুন ভেঙে আমরা এক হবো।
কিন্তু ছেলেটা আসে না। অফিসে মনোযোগ নেই আগের মতো। মাঝে মাঝেই মিতু ভাবে, তার জীবনটা অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। মিতু শুকিয়ে যাচ্ছে। চোখ দুইটা আস্তে আস্তে কোটরের ভিতর দিকে চলে যাচ্ছে।
মিতুর বাবা- মা প্রায় হতাস। এভাবে নিজের মেয়েকে আর সে কতদিন নিজের ঘড়ে রাখবে? বাইরে থেকে নানান ধরনের কথা কানে আসছে। অনেকে নাকি বলছে, নিজের মেয়ের কামাই তো অনেক খাওয়া হয়েছে। এইবার মেয়ের একটা ব্যাবস্থা করতে হবে না?
কথাটা মিথ্যে নয়। এইভাবে আর কতদিন? নিজেদের স্বার্থের জন্য মেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট করা যাবে? মিতুর বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ। মিতুর ভাই যখন বেঁচে ছিলো তখন মিতু অনেকটা ছোটোই ছিলো। তখন তার অনেক বিয়ের সম্বন্ধ আসতো। অনেক ভালো ঘড়ের ছেলে, ছেলে দামি চাকরি করে। কিন্তু মিতুর ভাই তখন বিয়েতে রাজি ছিলো না। তার ইচ্ছে ছিলো মিতুকে সে অনেক লেখাপড়া করাবে। তার ভাইয়ের চাকরি হলে মিতু কিছুটা আশা ফিরে পেয়েছিলো। ভেবেছিলো, নিজের স্বপ্নটা সে পুরণ করতে পারবে। কিন্তু সেটা আর হলো কোথায়? এদিকে মিতুর বয়স দিন দিন বাড়ছে। এখন আর আগের মতো বিয়ের সম্বন্ধ আসে না। মাঝে মাঝে কয়েকটা সম্বন্ধ আসে। কিছু মিতুর বাবা বুঝতে পারে ছেলেপক্ষ একটা বড় অংকের যৌতুক চাচ্ছে। এতো টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের।
মিতু নিয়মিত অফিসে যাচ্ছে। মিতু ভাবার চেষ্টা করে, এতোদিন তার সাথে যেটা হয়েছে সেটা শুধুমাত্র একটা স্বপ্ন। বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই। সেটাই বার বার ভাবার চেষ্টা করে। সবটা চেষ্টাই সফল হয়ে উঠে না। রাতে মাঝে মাঝেই তার ঘুম হয় না। রাইসা মাঝে মাঝে বলে, তুই নিজে খুব ইনট্রোভার্ট। কারো সাথে মিশিস না, কথা বলিস না, সেই কারণেই তোর এতো ডিপ্রেশন। একা থাকলে তুই এই সমস্যা সহজে কাঁটিয়ে উঠতে পারবি না। সবার সাথে মেলামেশা কথাবার্তা বলা আরাম্ব কর। দেখবি কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে গেছে। তবে মিতু বার বার বলে, আমি পারি না। অনেক চেষ্টা করি, পারি না। হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাকে এভাবেই বানিয়েছে। আমি ইনট্রোভার্ট।
মিতুর বাবা মিতুকে নিয়ে রাগ করে না। তার বাবা-মা কখনোই তাদের মেয়েকে সংসারের বোঁঝা মনে করে না। মিতুই তো পরিবারটাকে আগলে রেখেছে নিজের মধ্যে।
মিতুর বাবা আব্দুস সালাম মেয়ের কাছে গিয়ে চুপ করে বসে থাকে। অনেক্ষন বসে থাকার পর সে বলে, তোর জন্য একটা ছেলে দেখেছিলাম। অনেক বড় লোক। ছেলের ব্যাবহারও ভালো। মিতু চুপ করে থাকে।
অনেক্ষন পরে মিতু বলে, ছেলেমেয়ে কয়জন এইবার?
- একটা ছেলে, ২ বছর। ছেলেকে জন্ম দেওয়ার সময় মা মারা গিয়েছিলো। বয়স বেশি না। তুই একবার দেখতে পারিস। মিতু কিছু বলে না। মিতুর বাবা বলে, ছেলেটা তোর সাথে একটু দেখা করতে চায়। তুই না বলিস না।
পরদিন মিতু ছেলেটার দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে পৌছালো। একটা রেস্টুরেন্ট। মিতু যাওয়ার পরেই ছেলেটাকে চিনতে পারলো। ছেলেটার নাম রাসেদুজ্জামান। বয়স যদিও কম তবে চেহাড়ায় বয়সের ছাপ পড়েছে। মিতু চেয়ারটাতে বসতে বসতে বলল, তো কেমন আছেন?
- ভালো আছি। আপনি?
- হুম। আমিও ভালো আছি।
মিতু চুপ করে আছে। ছেলেটার কেবল নামটা জানে আর জানে তার একটা ২ বছরের ছেলে আছে। এর বাইরে সে আর কিছু জানে না। কী বলবে আর?
ছেলেটাই কিছুক্ষন পরে বলল, তো কিসের চাকরি করছেন যেন?
- একটা কম্পানিতে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসাবে কাজ করছি।
- অহ্। মনে হচ্ছে আপনি খুব ক্রিয়েটিভ। ডিজাইনিং যারা করে তাদের তো সৃজনশীলতা থাকে।
মিতু চুপ করে থাকে।
ছেলেটা বলে, আমার আগের একজন স্ত্রী ছিলো এবং আমার একটা ছেলেও আছে, আশা করি জানেন।
- হ্যাঁ, জানি।
- ছেলেটার মায়ের খুব অভাব। আমি একটা স্ত্রী খুঁজছি এর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমি আমার ছেলের জন্য একটা ভালো মা খুঁজছি।
মিতু আবার চুপ করে থাকে। ছেলেটা বলে, কফি খাবেন?
দুজনের জন্য দুইটা কফি দেওয়া হয়। মিতু কফিতে চুমুক দেয়। তারপর একসময় মিতু বলে, আপনার পরিকল্পনা ভালো। ছেলের জন্য একটা ভালো মা খোঁজা অবশ্যই জরুরি। তবে আমি আসলে বিয়েটা করতে চাচ্ছিনা। এর কারণটা হয়তো আপনি জানেন। আমি আমার ফ্যামিলির একমাত্র মেয়ে। আপনার ছেলেকে দেখাশোনা করতে গিয়ে আমার বাবা-মায়ের থেকে দূরে চলে যেতে চাই না। আমাকে মাফ করে দিবেন প্লিজ। আমি দোয়া করবো আপনি একজন ভালো স্ত্রী পাবেন এবং আপনার ছেলে ভালো একজন মা পাবে।
মিতু চলে আসে সেদিন। ছেলেটা কোন প্রকার বাঁধা দিলো না। কিছুক্ষন হয়তো মিতুর চলে যাওয়ার দিকে তাঁকিয়ে ছিলো।
চলবে....
Comments
Post a Comment