জাল পর্ব ০৩

 ৩।

আশেপা‌শে ক‌তো মানুষ। আরিফ প্রথমে ম‌নে করত গ্রা‌মে কত নি‌রি‌বি‌লি প‌রি‌বেশ। জনমানব অ‌নেক কম। কিন্তু বাজা‌রে আসার পর তার ধারণাই পু‌রোপু‌রি পাল্টে গে‌ছে। এতো মানুষ গ্রা‌মে। সবাই কত ব্যস্ত। আলী মা‌ঝে মা‌ঝে পেছ‌নের দি‌কে ত‌া‌কি‌য়ে দে‌খে তার না‌তি ঠিক আছে কিনা। বাজা‌রের একপাশটায় অ‌নেক খাবা‌রের দোকান। আলী সামন থে‌কে বলল, এখন তো তুই বড় হ‌য়ে গে‌ছিস। এসব বাচ্চা‌দের জি‌নিস দেওয়া তো‌কে মানায় না। তবুও তুই আমার একমাত্র না‌তি। তুই ছোট হ কিংবা বড় হ। তা‌তে আমার কিছুই যায় আসে না। তুই সারা‌জীবন আমার কা‌ছে ছোটই থাক‌বি। এখন বল তো কী খে‌তে ইচ্ছা কর‌ছে?
- আহ্ দাদা। এতো উতলা হ‌য়ে‌ছো কেন? আমি কি ব‌লে‌ছি আমি খা‌বো না। ত‌বে এখন যে কা‌জের জন্য এসে‌ছি সেটা অন্তত ক‌রি। আগে চ‌লো জাল দে‌খে আসি।
- সে‌দিকেই ‌তো যা‌চ্ছি। এম‌নি বললাম কিছু খা‌বি কিনা।
- আসো তারাতা‌রি, রোদ উঠে‌ছে অ‌নেক।
- হুম। আকাশ মেঘলা থাক‌লে যতটা শা‌ন্তি এখন রোদ উঠায় ততটা আযাব।

বাজা‌রের একটা কো‌নে একটা লোক জাল বি‌ক্রি কর‌ছে। আলী বলল, তুই একটা পছন্দ কর।
- আমি এসব জা‌লের কি বুঝ‌বো দাদা।
- তবুও একটু দেখ, তোর কোনটা ভা‌লো লা‌গে।
- আচ্ছা। দেখ‌ছি।
অ‌নেক দেখা‌দে‌খির পর ওরা একটা জাল কি‌নে নেয়। তারপর বা‌ড়ির জন্য কিছু বাজার ক‌রে নেয়। সা‌থে নানান ধর‌নের খাবার। আরি‌ফের কিছু সম‌য়ের জন্য ম‌নে হ‌লো সে যেন আবার আগের ম‌তো ছোট হ‌য়ে গে‌ছে। দাদার সা‌থে মজা ক‌রে কথা বল‌ছে। এম‌নি‌তে বাসায় থাক‌লে এরকম ক‌রে কা‌রো সা‌থে কথা হয় না। ভা‌র্সিটি‌তেও বন্ধুরা নানান কা‌জে ব্যাস্ত এখন। আড্ডা আর আগের ম‌তো দেওয়া হয় না। তাই একসময় ভাবল, নিজের গ্রা‌মের বা‌ড়ি থে‌কে ঘু‌রে আসা যাক। তাই সে চ‌লে আসে। এখা‌নে আসার প‌রে যে তার মনটা এতো ভা‌লো হ‌য়ে যা‌বে সেটা সে নি‌জে‌ও কল্পনা কর‌তে পা‌রে নি।

আরিফ ব‌লে, এই পু‌রো মাসটাই তোমার কা‌ছে থাক‌বো। এখান থে‌কে আমার মো‌টেও যে‌তে মন চা‌চ্ছে না দাদা। আলী মজা ক‌রে ব‌লে, তাহ‌লে আমা‌দের গ্রা‌মেই থে‌কে যা। আমা‌দের সা‌থে মাছ ধর‌বি। ক্ষে‌তে যা‌বি। আর পার‌লে এখা‌নেই তো‌কে বি‌য়ে দি‌বো।
- ধুর। কী ব‌লো এসব?
- কেন? কী বললাম? এখা‌নে থাক‌তে চাস, ত‌বে তো এখা‌নেই বি‌য়েশা‌দি কর‌তে হ‌বে।
- য‌দি থা‌কি ত‌াহলে ‌তো অবশ্যই কর‌বো। সেটা নি‌য়ে তোমা‌কে আবার ভাব‌তে হ‌বে?
- আমি ভাব‌বো না তো আর কে ভে‌বে দি‌বে? তুই আমার একমাত্র নাতি। আচ্ছা, তো‌কে একটা কথা ব‌লি, আজ‌কে একটা মে‌য়ে‌কে দেখ‌লি না? আজা‌দের একমাত্র মে‌য়ে, নাঈমা। ও‌কে কেমন দেখ‌লি?
- দাদা। তু‌মিও দে‌খি আমার বন্ধু‌দের ম‌তো‌ই। দাদা হ‌য়ে তু‌মি আমা‌কে এসব কেমন কথা বলছ?
- আরে! অমন করছিস কেন? নাঈমা আমা‌দের গ্রা‌মের মে‌য়ে। তুই ও‌কে দেখিস ‌নি? আজ‌কে যে মে‌য়েটা আজাদের ব‌া‌ড়ি‌তে মাছ কুট‌ছি‌লো।
- হুম। চি‌নে‌ছি। দেখ‌তে তো খারাপ না। শ্যামলা।
- তোর পছন্দ হয় কিনা?
- বাদ দাও তো দাদা। আর একটা কথাও বল‌বে না।

আলী চুপ হ‌য়ে যায়। এই বিষয় নি‌য়ে আর কথা বাড়ায় না। তারপর ওরা র‌াতের ‌বেলা খে‌য়ে‌দে‌য়ে ঘু‌মি‌য়ে প‌ড়ে। আজ‌কে সারা‌দিন অনেক ‌কিছু ক‌রে‌ছে তারা। আলী শোয়ার সা‌থে সা‌থেই ঘু‌মি‌য়ে গেল। ত‌বে আরি‌ফের ঘুম আস‌ছে না। ম‌নের ম‌ধ্যে নানান ধর‌নের চিন্তা আসে। বিছ‌ানা এপাশ ওপাশ কর‌তে থা‌কে। একটা মে‌য়ে, মাছ কুট‌ছি‌লো। আরিফ যখন মে‌য়েটার দি‌কে তাকা‌লো মে‌য়েটাও তখন আরি‌ফের দি‌কে তা‌কি‌য়ে‌ছি‌লো। দুজ‌নের চোখা‌চো‌খি। তারপর মে‌য়েটার লজ্জা পাওয়া মুখ। আরিফ স‌ত্যি মে‌য়েটার কথা ভুল‌তে পার‌ছে না।

আরো অ‌নেক দিন পার হ‌য়ে গেল। তারপর থে‌কে আলী আর ওইসব বা‌জে স্বপ্ন দে‌খে নি। সব‌কিছু ঠিক হ‌য়ে গে‌ছে। আরিফও বর্তমা‌নে দাদার সা‌থেই আছে। এই সপ্তাহটাই থাক‌বে। তারপর চ‌লে যা‌বে। অ‌নেক দিন ছিল এখা‌নে। ভা‌র্সিটি‌র ছু‌টি শেষ হ‌বে। তারপর প‌রিক্ষা। থাক‌তে চাইলেও চ‌লে যে‌তে হ‌বে এখান থে‌কে। এই ক‌দি‌নে গ্রামের অ‌নে‌কের সা‌থেই প‌রিচয় হ‌য়ে‌ছে। ত‌বে এই গ্রা‌মে আরি‌ফের সমবয়সী কাউকেই পেল না। যা‌দের সা‌থে প‌রিচয় হ‌য়ে‌ছে, তারা বয়‌সে অ‌নেক ছোট।
বাচ্চা‌দের সা‌থে থাকার আলাদা একটা মজা আছে। ও‌দের সা‌থে থাক‌লে অ‌নেক কিছু শেখা যায়, আবার ও‌দের‌কে কোন কিছু শেখা‌লে ওরা অ‌নেক খু‌শি হয়। আরিফ এই কয়‌দি‌নের ম‌ধ্যে ও‌দের মন জয় ক‌রে ফে‌লে‌ছে। কোন জ‌টিল সমস্যার সমাধান পাওয়ার জন্য সবাই আরি‌ফের কা‌ছে ছু‌টে আসে।
তাছাড়া আরো একজন মানু‌ষের সা‌থে তার বন্ধুত্ব হ‌য়ে‌ছে। মতলব চাচা। আলীর সা‌থেই মাছ ধর‌তো। ত‌বে তি‌নি মা‌ঝে মা‌ঝে অন্যান্য গ্রা‌মেও কাজ কর‌তে যান। দেখা হ‌লে মা‌ঝে মা‌ঝে দেখা হয়। মতলব চাচা মজার একজন মানুষ। আরি‌ফের সা‌থে বস‌লে নানান ধর‌নের আলোচনা হয়। বি‌শেষ ক‌রে ভু‌তের গল্প বলা‌তে তি‌নি ওস্তাদ। গল্পগু‌লো স‌ত্যি কিনা সেটা কা‌রো জানা নেই। ত‌বে বা‌নি‌য়ে বা‌নি‌য়ে গল্প বলাও একটা প্রতিভা। সবার দ্বারাই বা‌নি‌য়ে বা‌নি‌য়ে এরকম রোমাঞ্চকর গল্প বলা সম্ভব নয়। কিন্তু মতলব চাচা পা‌রেন। আরিফ ভ‌া‌বে, চাচার ভেত‌রে লেখক হওয়ার সুপ্ত মেধা আছে। তি‌নি এতো‌দি‌নে হয়‌তো বড় মা‌পের কোন লেখক হ‌য়ে যে‌তেন। ত‌বে দুর্ভাগ্য মতলব চাচা লেখাপড়া জানে না। পড়‌তে পা‌রেন না। আরিফ ভা‌বে, সে য‌দি আরো কিছু‌দিন থাক‌তে পার‌তো, তাহ‌লে মতলব চাচা‌কে বাংলা লেখা শি‌খি‌য়ে দি‌য়ে আস‌তেন। এরকম একটা মেধা মানু‌ষের অজা‌ন্তেই নষ্ট হ‌য়ে যা‌বে সেটা আস‌লে মে‌নে নেয়া যায় না।

পর‌দিন আলি খবর আন‌লো ক‌য়েকজন লোক মি‌লে একটা ট্রলার ভাড়া করা হ‌বে। সারারাত মাছ ধরা হ‌বে। আলী যে‌তে চা‌চ্ছে। তাই আরিফ‌কে বলল, তাহ‌লে যা‌বি আমা‌দের সা‌থে মাছ ধর‌তে? আরিফ বলল, প্রতিবারই তো তোমার সা‌থেই যাই। সুতরাং আজ‌কেও এর ব্যা‌তিক্রম হ‌বে না। আমি তোমা‌দের সা‌থেই যা‌বো। ত‌বে মাছ ধর‌তে নয়। মাছ ধরা দেখ‌তে।

দু‌দিন পর বি‌কেল‌বেলা। বি‌কে‌লের দি‌কে বাতাস শুরু হ‌লো। যে কোন সময় ঝড় আস‌তে পা‌রে। ত‌বে যেভা‌বেই হোক, আজ‌কে মাছ ধর‌তে যে‌তেই হ‌বে। ক‌য়েকজনে ‌মি‌লে ট্রলার ভাড়া করা হ‌য়ে‌ছে। মাছ না ধর‌তে পার‌লে পু‌রো টাকাটাই বৃথা। সন্ধ্যার দি‌কে বাতা‌সের ম‌ধ্যেই রওনা দি‌লো সক‌লে। ট্রলা‌রে প্রায় নয়-দশ জ‌নের ম‌তো মানুষ। সা‌থে আরিফও আছে। দুজ‌ন ‌লোক ট্রলারটা চালা‌নোর দা‌য়িত্ব পে‌য়ে‌ছে। আর বা‌কি সবাই জাল ফেল‌বে। অ‌নে‌কেই আছে প‌রি‌চিত। আজাদ ভাই এসে‌ছেন। শ‌ফিকুল কাকা, সামাদ ভাই এসে‌ছেন। এই ক‌দি‌নে অ‌নে‌কের সা‌থে ভা‌লোই প‌রিচয় হ‌য়ে‌ছে। সবাই আরিফ‌কে চে‌নে। সামাদ ভাই বল‌লেন, আরিফ! আজ‌কে তো‌কে জাল ফালা‌নো শি‌খি‌য়ে দি‌বো। শিখ‌বি?
- অবশ্যই শিখ‌বো ভাই। তোমা‌দের ম‌তো আমা‌রো অ‌নেক ইচ্ছা ক‌রে মাছ ধরার।
আজাদ ব‌লে, ও‌কে মাছ ধরা শি‌খি‌য়ে কি গ্রা‌মে রে‌খে দেওয়ার ধান্দা কর‌ছিস? ওসব শি‌খে তোমার কোন লাভ নেই দাদু। তু‌মি শুধু দে‌খো আমরা কিভা‌বে মাছ ধ‌রি।
আরিফ আজাদ ভাইকে উদ্দেশ্য ক‌রে ব‌লে, শি‌খে রাখ‌লে তো কেন সমস্যা ‌নেই ভাই। শহ‌রে গি‌য়ে আমি অন্তত বল‌তে পার‌বো যে আমি জাল দি‌য়ে মাছ ধর‌তে পা‌রি। আমার তখন আলাদা একটা দাম হ‌বে।
আলী বলল, ও শহ‌রে থা‌কে তো কী হ‌য়ে‌ছে? ওর বাপ দাদারা সবাই থে‌কে‌ছে গ্রা‌মে। ওর শেকড়টাই তো গ্রা‌মের। ও মাছ ধরা শিখ‌বে না তো আর কে শিখ‌বে? আর ওরা য‌দি না শি‌খে। তাহ‌লে আমরা ম‌রে যাওয়ার পর আমা‌দের এই পেশা বিলুপ্ত হ‌য়ে যা‌বে। ওরাই আমা‌দের ভরসা। ও‌দের‌কে শি‌খি‌য়ে দি‌লে য‌দি ওরা শি‌খে রা‌খে, তাহ‌লে ও‌দের যে ছে‌লে‌মে‌য়ে হ‌বে, তা‌দের‌কেও ওরা শেখা‌তে পার‌বে।
- তু‌মি ঠিক ব‌লে‌ছো দাদা। আজ‌কেই আমা‌কে মাছ ধরা শি‌খি‌য়ে দি‌তে হ‌বে। আমিও তোমা‌দের সা‌থে মাছ ধর‌তে পারবো তাই। ট্রলার এগি‌য়ে চল‌ছে। আজ‌কে আকা‌শে কেন আলো নেই। চা‌দের দেখা পাওয়া যা‌বে না। পু‌রে‌া আক‌শটাই মে‌ঘে ঢাকা। এখন বাতা‌সের প‌রিমানটা একটু ক‌মে‌ছে। কিন্তু দূ‌রে আকা‌শে বিজ‌লী চমকা‌চ্ছে। বিদ্যু‌তের আলো পা‌নি‌তে প্রতিফ‌লিত হ‌য়ে একটা চমৎকার দৃশ্য তৈ‌রি ক‌রে। ম‌নে হয় খুব কা‌ছেই বিদ্যু‌তের ঝলক দি‌লো। ম‌নে হল সেটা হাত দি‌য়ে ধর‌া যা‌বে। মৃদু ইঞ্জি‌নের শ‌ব্দ এবং সা‌থে ঠান্ডা বাতাস। যেন দু‌নিয়ার বু‌কেই এক ফোঁটা সর্গ।

নৌকা আরো নদীর গ‌ভি‌রে চ‌লে যা‌চ্ছে। আশেপা‌শে কোন তীর চো‌খে পড়‌ছে না। বাতা‌সের বেগ আরো বাড়‌ছে। এদি‌কেও বৃ‌ষ্টি আস‌তে পা‌রে। আলী বলল, এখ‌নি যতটুকু পা‌রো সবাই জাল ফালাও। এখান দি‌য়েও বৃ‌ষ্টি হ‌তে পা‌রে। আলীর কথা শু‌নে সবাই জাল নি‌য়ে প্রস্তুত হল। বিশাল বড় একটা জাল। আরিফ এতো বড় জাল এর আগে কখ‌নোই দে‌খে নি। একজন মানু‌ষের প‌ক্ষে সেই জাল তোলা অসম্ভব। অ‌নে‌কে মি‌লে জালটা আস্তে আস্তে ন‌দি‌তে ফেল‌তে হয়। ট্রলার এগি‌য়ে যায়, জালটাও নদীর বু‌কে বি‌ছি‌য়ে যায়। কিছুক্ষন অ‌পেক্ষা করার পর সেটা সবাই মি‌লে উপ‌রে টে‌নে তু‌লে। আরিফও সাহায্য ক‌রে কা‌জে। মা‌ছে জালটা ভারী হ‌য়ে যায়। জালটা উপ‌রে তু‌লে আনার পর সেখানে নানান ধর‌নের মাছ লাফা‌তে থা‌কে। মাছগু‌লো জাল থে‌কে ছাড়া‌নো হয়। আরিফ জাল থে‌কে মাছ ছাড়া‌তে গে‌লে আলী ব‌লে, সাবধা‌নে আরিফ! একটু অসতর্ক হ‌লেই কিন্তু কাঁটা দি‌য়ে বস‌বে।
প্রথম টা‌নেই ভা‌লো মাছ পাওয়া গেল। এইবার সক‌লেই চিন্তা কর‌লো। ট্রলারটা আরো গভী‌রে নি‌য়ে যা‌বে ওরা। আক‌াশে মে‌ঘেরা আনা‌গোনা কর‌ছে। বৃ‌ষ্টি হ‌চ্ছে না। বাতাস একবার ক‌মে, আবার বা‌ড়ে। ট্রলার আবার এগি‌য়ে চলল। আবার সাম‌নে জাল ফেল‌বে ওরা। আজ‌কে রা‌তে কেউ ঘুমা‌বে না। তাছাড়া ঘুম আসারও কথা না। মাছ ধরা একটা নেশার ম‌তো। নেশা ধ‌রে গে‌লে সেটা থে‌কে আর বের হওয়া যায় না। যত মাছ পাওয়া যা‌বে, ততই ধর‌তে ইচ্ছা কর‌বে। এখন রাত আনুমা‌নিক কত বাঁজ‌তে পা‌রে? ত‌বে বে‌শি না। প্রায় দশটার ম‌তো বাঁ‌জে। গ্রা‌মে এই দশটা মা‌নেই অ‌নেক রাত। অ‌নে‌কেই এইসময় নিশ্চই ঘু‌মে ত‌লি‌য়ে গে‌ছে। এদি‌কে ট্রলা‌রের লোক‌দের কা‌ছে রাতটা কেবল শুরু। মা‌ঝে মা‌ঝেই কোথাও যেন বজ্রপাত হয়। খুবই জো‌রে শব্দ হয় তখন।

- আজাদ ভাই! নাঈমা তো ঘ‌ড়ে একা। ও‌কে একা রে‌খে আপ‌নি মাছ ধর‌তে চ‌লে আস‌লেন?
আজাদ ভাইয়ের মুখের গঠনটা কেমন জা‌নি পা‌ল্টে গেল। হয়‌তো ভাব‌লেন, এর কী উত্তর দেওয়া যে‌তে পা‌রে। তারপর বললেন, মে‌য়েটা‌কে নি‌য়ে হ‌য়ে‌ছে ঝা‌মেলা। আল্লাহ্ কেন যে আমা‌কেই একটা মে‌য়ে দি‌লো। অন্য কা‌রো ঘড়ে জন্ম নি‌লেই বোধয় ভা‌লো হতো।
- এভা‌বে বল‌ছেন কেন ভাই?
- বল‌বো না‌তো কী। আজ‌কে য‌দি একটা ছে‌লে হ‌তো, তাহ‌লে ও‌কে নি‌য়ে এখা‌নে মাছ ধর‌তে নি‌য়ে এসে পরতাম। মে‌য়ে ব‌লে ও‌কে আন‌তে পা‌রি না। আবার বা‌ড়ি‌তে রে‌খে আস‌তেও ভয় লা‌গে।
- থাক চিন্তা কর‌বেন না। আল্লাহ্ রক্ষা কর‌বে। কিন্তু ও তো ভয়ও পে‌তে পা‌রে অন্ধকার রা‌তে।
- না। ভয় পা‌বে না। আস‌লে ছোট‌বেলা থে‌কেই অভ্যাস হ‌য়ে গে‌ছে। আমার মে‌য়েটা খুব শক্ত ম‌নের। ওর জন্ম হওয়ার প‌রেই ওর মা ম‌রে গে‌ছে। তাই এখ‌নো ও ওর মা‌য়ের মুখ দে‌খে‌নি। অ‌নেক কষ্ট ক‌রে ওকে লালনপালন ক‌রে‌ছি। তারপর ও যখন বড় হ‌লো, ওই নি‌জের ক‌াজ নি‌জে করা শি‌খে গেল। পু‌রো সংসা‌রের ভাড়টা ও একাই নি‌য়ে নি‌লো। ও‌কে এখন আমি সারাক্ষন কাজই কর‌তে দে‌খি। ত‌বে বাবা হিসা‌বে আমি ব্যার্থ হ‌য়ে‌ছি। ওর শখ আল্লাদ আমি পুরণ কর‌তে পা‌রি না। ওর সা‌থে ক‌বে যে ভা‌লোভা‌বে কথা ব‌লে‌ছি সেটাই ম‌নে পড়‌ছে না।
কথাটা ব‌লে তি‌নি খোলা আকাশের দি‌কে তা‌কি‌য়ে রইলেন। হয়‌তো তি‌নি ভাব‌লেন, "আজ য‌দি তু‌মি চ‌লে না যে‌তে, তাহ‌লে এমনটা হ‌তো না।"
আজাদ ভাইয়ের সা‌থে অ‌নেক্ষন কথা ব‌লে অ‌নেকটা সময় পার হ‌য়ে গেল। আকা‌শের অবস্থাও অতটা ভা‌লো না। বাতাস অ‌নেকটা বে‌ড়ে‌ছে। ঠান্ডা বাতাস। বাতাস ঠান্ডা মা‌নে আশেপা‌শে বৃ‌ষ্টি হ‌চ্ছে কোথাও। এদি‌কেও হ‌বে হয়‌তো। সবাই ডাক‌তে শুরু কর‌লো। তারাতা‌রি আব‌ার জাল ফেল‌তে হ‌বে। আবার সক‌লের ব্যাস্ততা। সবাই জাল ফেল‌তে আরাম্ব কর‌লো। এবা‌রো ভা‌লো মাছই পাওয়া যা‌বে আশা করা যায়। আরিফ গ্রা‌মের এই লোকগু‌লোর শ‌ক্তি দে‌খে অবাক হয়। এই বয়‌সেও তারা ক‌তোটা উদ্যমী। নি‌জেরও এতোটা শ‌ক্তি হয়‌তো নেই। এদি‌কে শহ‌রের মানু‌ষেরা বয়স বাড়ার কিছু‌দিন প‌রেই এরা আর বিছানা থে‌কেই উঠ‌তে পা‌রে না। অথচ, এদের বয়স সমান। আস‌লে, তার দাদা ঠিকই ব‌লে‌ছি‌লো। সে গ্রা‌মে যা‌বে না। তার দাদা য‌দি শহ‌রে গি‌য়ে থাকা শুরু ক‌রে, একম‌া‌সের ম‌ধ্যেই তার ডায়‌বে‌টিস, হা‌র্টের সমস্যা ধরা পড়‌বে। তার‌চে‌য়ে দাদা এখা‌নেই ভা‌লো আছে। এখানকার মানু‌ষেরা আস‌লেই অ‌নেক সু‌খি। রোগবালাইয়ে কোন হিস‌াব নেই। বে‌শিরভাগ মানুষ দিন আনে দিন খায়।
আস‌লেই কি সবাই সু‌খি? নাঈমা? ও কি সু‌খে আছে? আজাদ ভাই? আলী? সবাই ক‌ি সু‌খেই আছে। সুখ একটা আপে‌ক্ষিক জি‌নিস। এক মাত্রা দি‌য়ে এটা বি‌বেচনা করা যায় না।
এইবা‌রো জা‌লে খ‌ুব ভা‌লো মাছ উঠ‌লো। আবার সক‌লেই ম‌াছ ছাড়া‌তে ব্যাস্ত হ‌য়ে গেল।

রাত ১ টার ম‌তো বা‌জে। অ‌নেকবার জাল ফালা‌নো হ‌য়ে‌ছে। ট্রলারভ‌াড়া মি‌টেও অ‌নেকটা লাভ হ‌বে সবার। সুতরাং চিন্তামুক্ত হ‌লো সবাই। কিন্তু মাছ ধরা থামা‌নো যা‌বে না। যতটা সম্ভব এখা‌নে মাছ ধরবে ওরা। বাতা‌সের মাত্রা আরো বে‌ড়ে গেল। সা‌থে আবা‌রো কা‌ছে কোথাও যেন প্রবল শব্দে বাজ পড়ল। কা‌নে হাত দি‌লো সবাই। আলী সবাইকে ছাউনির নি‌চে আস‌তে বলল। সবাই জালটা‌কে বাইরে রে‌খে ছাউনির ভিতর আশ্রয় নিল। ক‌য়েক মি‌নিট যাওয়ার প‌রেই শুরু হল প্রবল বৃ‌ষ্টি। আর সা‌থে বাতাস। অ‌নেক জো‌রেই বাতাস বইছে। নৌকা প্রচণ্ডভা‌বে ঢুল‌তে লাগল। ম‌নে হ‌চ্ছে এখ‌নি যেন নৌকা উল্টে যা‌বে। সবাই একসা‌থে জড় হ‌লো। আরিফ এই প্রথম ভয় পা‌চ্ছে। গ্রা‌মের অ‌নেকগু‌লো সুন্দ‌রের মা‌ঝে এই একটা ভয়ংকর জিনিস।
আলী সবাইকে বলল, আমা‌দের এখ‌নি রওনা দেওয়া উচিৎ ছি‌লো। কতক্ষণ এভা‌বে বৃ‌ষ্টি হ‌বে কে জা‌নে? এদি‌কে নৌকার অবস্থাও তো ভা‌লো দেখ‌ছি না। কখন জানি আবার উল্টে যায়।

ঝড় থামার কোন নাম নেই। আরিফ ম‌নে ম‌নে দোয়া দরুদ পড়‌তে আরাম্ব করল। আশেপা‌শে ভয়াবহ বৃ‌ষ্টি শুরু হ‌য়ে‌ছে। আরিফ একসময় দূ‌ড়ে ত‌া‌কি‌য়ে দেখ‌লো, একটা হেডলাইটের ম‌তো কিছু। কেউ কি আস‌ছে তাহ‌লে তা‌দের নি‌য়ে যাওয়ার জন্য? প্রচন্ড গ‌তি‌তেই আস‌ছে। এক পল‌কের ম‌ধ্যেই ও‌দের ট্রলা‌রের কা‌ছে চ‌লে আস‌ছে। আরিফ আলী‌কে ব্যাপারটা জানা‌লো। আলী ও‌দি‌কে তা‌কি‌য়ে দে‌খে অ‌নেক্ষণ চিন্তা করল। এই এতো রা‌তে এবং প্রবল ঝড়বৃ‌ষ্টির মা‌ঝে কে আস‌তে পা‌রে এদি‌কে? আলী ব্যাপারটা সবাইকে জানাল। কে হ‌তে পা‌রে?
হেডলাইটের প্রবল আলো। লাইটের পেছ‌নে কে আছে সেটা কিছুই দেখা যা‌চ্ছে না। ওরা কারা! এটা  ভাবার আগেই ওরা ট্রলা‌রের উপ‌রে উঠে আস‌লো। একটা স্পিড‌বোটে চ‌ড়ে এসে‌ছে ওরা। একজন দুজন না। ওরা এখা‌নে পাঁচ জন। আরিফ ও‌দের‌কে দে‌খে ভয় পে‌য়ে গেল। প্রত্যে‌কের হা‌তেই একটা ক‌রে বিশাল বড় দা। কী ভয়ানক চেহাড়া ও‌দের। ও‌দের ম‌ধ্যে থে‌কে একজন হঠাৎ ক‌রে গরগ‌রে গলায় বলল, ভেত‌রে কেউ নড়‌বি না। য‌দি ন‌ড়িস, একটা‌রো ঘা‌ড়ের উপর মাথা থাক‌বে না। চুপচাপ যেখা‌নে আছিস সেখা‌নে দা‌ঁড়িয়ে থাক‌বি।

আরিফ আশেপা‌শে তা‌কি‌য়ে দেখ‌লো। সবার মু‌খেই ভ‌য়ের ছাপ। সোজা হ‌য়ে দা‌ঁড়ি‌য়ে আছে সবাই। একটুর জন্যও নড়‌ছে না কেউ। আরিফ ফিস ফিস ক‌রে ওর দাদার কা‌নের কা‌ছে গি‌য়ে ব‌লে, এরা কে দাদা? আলী কাঁপা কাঁপা গলায় ব‌লে, ন‌ড়িস না। ডাকাত এরা। যা মাছ ধ‌রে‌ছি তা নি‌তে এসে‌ছে। চুপচুপ দাঁ‌ড়ি‌য়ে থাক। একটুও নড়‌বি না।
- এদের তু‌মি চে‌নো?
- হ্যাঁ। পা‌শের এলাকার ডাকাত। অ‌নেক পাওয়ার ও‌দের। কেউ কিছু বল‌তে পা‌রে না।
- তাই ব‌লে কেউ কিছু বল‌বে না?
- কে বল‌বে। দেখ‌ছিস না? হা‌তে কত বড় দা।
- দা‌-য়ের ভয় দে‌খি‌য়ে ওরা আম‌া‌দের সব মাছ নি‌য়ে চ‌লে যা‌বে। আর আমরা কোন প্রতিবাদ কর‌বো না?
- চুপ থাক। ওদের সা‌থে পে‌রে উঠ‌বি তুই?
- কেন পার‌বো না? ওরা মাত্র পাঁচ জন। আর আমরা দশ জন। ও‌দের ডাবল। ইচ্ছা কর‌লেই তো ও‌দের শিক্ষা দি‌তে পা‌রি।

ডাকাত‌দের ম‌ধ্যে একজন ওদের কা‌ছে এসে বলল, এই, মাছ কই রে‌খে‌ছিস? আজাদ ভাই আংগুল দি‌য়ে ইশারা ক‌রে মা‌ছগু‌লো দে‌খি‌য়ে দি‌তে যা‌চ্ছি‌লো তখন আরিফ আজা‌দ ভাইয়ের হাত না‌মি‌য়ে দি‌য়ে ডাকাত লোক‌টি‌কে উদ্দেশ্য ক‌রে বলল, আমা‌দের মাছ কেউ নি‌তে পার‌বে না। আমরা মে‌রে‌ছি, আমরাই বাজা‌রে তুল‌বো। ডাকাত লোকটা হয়‌তো এই কথা আজ‌কে নতুন শু‌নছে। এভা‌বে ও‌দের মু‌খের উপর কথা বলার সাহস আগে কেউ দেখায়‌ নি। জাম‌াল শেখ সহ সবাই আরি‌ফের দি‌কে এগি‌য়ে আস‌লো। আলী ওর কা‌নে কা‌নে ধমক দি‌য়ে বলল, তো‌কে না বললাম, চুপ ক‌রে থাক‌তে। ওরা কতটা ভয়ানক সে সম্প‌র্কে তুই কিছুই জা‌নিস না। 
জামাল শেখ আরি‌ফের কা‌ছে এসে বল‌তে লাগল, শহ‌রের ছে‌লে ম‌নে হ‌চ্ছে। ও হয়‌তো আমা‌দের সম্প‌র্কে কিছু জা‌নে না। তাহ‌লে শু‌নে রা‌খো ছে‌লে, আমরা ডাকাত। আরি‌ফের কা‌নের কা‌ছে এসে জামাল শেখ বলল, আমার হা‌তে যে দা টা দেখ‌ছিস, এইটা দি‌য়ে ক‌তজ‌নকে জবাই ক‌রে‌ছি তার কোন হিসাব নেই। ভা‌লোয় ভা‌লোয় মাছ‌গু‌লো দি‌য়ে দাও, তারপর আমরাও বিদায় হ‌য়ে যা‌বো। কিন্তু আরি‌ফের ম‌ু‌খে একটাই কথা, সে ডাকাত‌দের উদ্দেশ্য ক‌রে বলল, এইখান থে‌কে একটা মাছও ও‌দের নৌকায় যা‌বে না।
আরি‌ফের কথায় জামাল শেখ রা‌গে গজ গজ কর‌তে লাগল। ম‌নে হ‌লো সে এখ‌নি একটা ঘটনা ঘ‌টি‌য়ে ফেল‌বে। তারপর আরিফ ট্রলা‌রের সকল‌কে উদ্দেশ্য ক‌রে বলল, ও‌দের দে‌খে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। আমরা সংখ্যায় ও‌দের চাইতেও বে‌শি। সামান্য ভয় দে‌খি‌য়ে ওরা আমা‌দের কিছুই কর‌তে পার‌বে না। তোমরাও দেখি‌য়ে দাও, তোমরাও ও‌দের থে‌কে কম না।

বাইরে প্রচন্ড‌বে‌গে বাতাস এবং তার সা‌থে বৃ‌ষ্টি। এই আবহাওয়ায় কা‌রো মুখটাও ভা‌লোভা‌বে দেখা যায় না। ত‌বে জামাল শে‌খের অবয়বটা দে‌খেই বোঝা যায়। সবার চে‌য়ে লম্বা। মাথায় চুলগু‌লো ছোট ছোট ক‌রে ছাঁটা। ট‌র্চ লাইটের চার্জ শেষ হ‌য়ে আস‌ছে। বজ্রপা‌তের আলো‌তেই সামান্য দেখা যায় জামাল শে‌খের সেই তীব্র রা‌গি চেহাড়া। জামাল শে‌খের দুই সহকা‌রি আরিফ‌কে ধ‌রে ফে‌লে। দুহা‌তে দুজন ধ‌রে। আরিফ নি‌জে‌কে ছাড়া‌নোর চেষ্টা ক‌রে, কিন্তু ও‌দের সা‌থে পে‌রে ও‌ঠে না। তারপর জামাল শেখ, বা‌কি লোক‌দের উদ্দেশ্য ক‌রে ব‌লে, য‌দি ভা‌লোয় ভা‌লোয় সব‌কিছু ব‌লে দাও, তাহ‌লে আমি আর এতো ঝা‌মেলা কর‌বো না। আর তোমরাও কতটা বোকা, সামান্য কয়টা মা‌ছের জন্য তোমা‌দের জান চ‌লে যাক, এটা কি কেউ চাইবে? আমি তোমা‌দের ভা‌লোর জন্যই বল‌ছি।

ক‌য়েকজ‌নে তখন হাত দি‌য়ে ইশারা ক‌রে দে‌খি‌য়ে দেয়। প্রবল বৃ‌ষ্টি‌তে কিছুই ভা‌লোভা‌বে দেখা যায় না। তারপর জামাল শে‌খ এবং ওর দুই সহকা‌রি সেই ঘ‌ড়ের ভিত‌রে ঢু‌কে যায়। তারপর ওরা সেখা‌নে মা‌ছের সন্ধান কর‌তে থা‌কে। আবার আশেপা‌শের কোন একটা জায়গায় বাজ পড়ল। প্রচন্ড শব্দ‌ে সবার গা একবার ঝা‌কি দি‌য়ে উঠল। আরিফ‌কে যেই লোকগু‌লো ধ‌রে‌ছি‌লো, তারা কা‌নের কা‌ছে গি‌য়ে বলল, জীবন বাঁচা‌তে চাইলে চুপ ক‌রে থাক‌বি। একটা কথাও বল‌বি না।


চলবে....

Comments

Popular Posts