জাল পর্ব ০৫

 ৫।

বিচা‌রে অ‌নে‌কেই অ‌নেক রকম কথা বলল। কিন্তু কেউ প্রমান দি‌তে পার‌লো না স‌ঠিকভাবে। কিন্তু ঘটনাটা পু‌রোই ঘু‌রে যায় পাঁচ ভাই আসার প‌রেই। এলাকার সকল মানুষের সাম‌নেই পাঁচ ভাই জোর গলায় ব‌লে দি‌লো, চেয়ারম্যান‌কে ওরাই খুন ক‌রে‌ছে। আমরা গতকাল নি‌জে‌দের চোখেই সব দে‌খে‌ছি। আমরা মাছ ধরার সময় খেয়াল কর‌ছিলাম নদীর ঘা‌টে ওরা কিছু একটা কর‌ছে। জামাল শেখ কিছুটা চম‌কে গে‌লেন। প‌রি‌স্থি‌তিটা ঠিক রে‌খে তি‌নি বল‌লেন, আরে মিয়া, তোমরা অন্ধকা‌রে কা‌রে না কা‌রে দেখ‌ছো। ওইটার দোষ এখন আমা‌দের দিতা‌ছো।
পাঁচ ভাইয়ের ম‌ধ্যে ছোটজন আবার শক্ত গলায় বলল, আমরা ভুল দে‌খি‌নি ভাইয়েরা। আমা‌দের চেয়ারম্যান‌রে ওরাই খুন কর‌ছে। খুন কইরা বস্তায় তুইলা ন‌দী‌তে ভাসাই দি‌সে। তোমা‌দের য‌দি বিশ্বাস না হয় তাইলে একজন ডুবু‌রি খবর দাও। এখ‌নো লাশটা ওখা‌নেই পাবা। জামাল শেখ ঠান্ডা মাথায় উত্তর দেন, দেখা যা‌বে তাহ‌লে। আমিও ওই কথাই রাখলাম।

সে‌ রা‌তে দরবার শেষ হয়। জামাল শে‌খের মু‌খে চিন্তার ছাপ। তারা য‌দি স‌ত্যিই ডুবু‌রি এনে খোঁজ নেয়, নি‌শ্চিৎ ওরা ফে‌সে যা‌বে। সেটা হ‌তে দেওয়া যা‌বে না। যেভা‌বেই হোক কিছু একটা তো কর‌তেই হ‌বে। ওস্তাদ! আজ‌কে রা‌তেই সময়। আজ‌কে রা‌তের ম‌ধ্যেই চেয়ারম্যা‌নের লাশটা সরা‌নোর ব্যাবস্থা কর‌তে হ‌বে। কাল সকা‌লে নি‌শ্চিৎ এলাকার মানুষ ডুবু‌রি আন‌বে। তাই যা করার আজ‌কে রা‌তেই কর‌তে হ‌বে। জামাল শেখ সবাইকে বল‌লেন, চল সবাই। ঘা‌টের কা‌ছে যা‌বো। লাশটা স‌রি‌য়ে ফেল‌তে হ‌বে। সা‌থে একটা জাল নি‌য়ে আয়। জাল ফেল‌বো নদী‌তে।
রা‌তের বেলায়ই রওনা হয় ওরা। সা‌থে সাত জন সহকা‌রী। দুরে একট‌া মাঝির নৌকা দেখা যা‌চ্ছে। ওরা নৌকাটা খু‌লে নি‌য়ে ওই লা‌শের দি‌কে রওনা হয়। যখ‌নি নৌকাটা চালা‌নো শুরু কর‌তে যা‌বে ঠিক তখ‌নি ওরা দেখ‌লো নৌকা চল‌ছে না। নৌকার দ‌ড়ি ধ‌রে আছে পাঁচ ভাই। বকুল, রাজু, শ্যামল, সুবাস আর পলক।
বকুল বলল, কি ম‌নে ক‌রে‌ছিস? এতো রা‌তে লাশটা স‌রি‌য়ে ফেল‌বি? তা আমরা হ‌তে দি‌বো না। আমরা জা‌নি তোরাই চেয়ারম্যান‌কে খুন ক‌রে‌ছিস। আর এলাকার সাম‌নে তুই ভা‌লো হ‌তে চাইছিস। আমরা থাক‌তে তোরা এমনটা কখ‌নোই কর‌তে পার‌বি না।
জামাল শেখ প্রবল হা‌সি দি‌য়ে বলল, ম‌নে ক‌রে‌ছিলাম আমাদের খু‌নের ঘটনা কেউ দে‌খে‌নি। কিন্তু এখন দে‌খি ওরা সব দে‌খে ফে‌লে‌ছে। সমস্যা নেই। এখন বল কী পে‌লে তো‌দের মুখটা বন্ধ রাখ‌বি?
- আমা‌দের‌কে কি‌নে নি‌চ্ছিস? তেমনটা করার চেষ্টা কর‌লে ভুল কর‌বি। আজ‌কে আমরা এর স‌ঠিক বিচার ক‌রেই ছাড়‌বো।
- কী কর‌বি তোরা? পু‌লি‌সে দি‌বি আমা‌দের? খুন কর‌বি চেয়ারম্যা‌নের ম‌তো? কি কর‌বি বল শু*রের বাচ্চা। জামাল শে‌খের রা‌গের মাত্রা এখন স‌র্বোচ্চ। তখন বকুল বলল, পার‌লে আজ‌কে তো‌কে খুনই কর‌বো। আমা‌কে খুন কর‌বি? তোর এতো বড় সাহস? তুই জামাল শেখ‌তে খুন কর‌তে চাস। এই কথা বলার সা‌থে সা‌থেই নি‌জের দা-টা হা‌তে নি‌য়ে দ্রুত‌বে‌গে বকু‌লের ঘ‌া‌ড়ের উপর চা‌লি‌য়ে দি‌লো। গল গল ক‌রে রক্ত বের হ‌তে লাগ‌লো বকু‌লের গলা থে‌কে। সা‌থে সা‌থে বকুল ধপ ক‌রে পা‌নি‌তে প‌ড়ে গেল। বা‌কি চার ভাই চিৎকার ক‌রে উঠল, বকুল ভাই। বকু‌লের র‌ক্তে আশেপা‌শের পা‌নি লাল হ‌য়ে গেল। বকুল ছটফট কর‌তে কর‌তে সেখা‌নেই মারা গেল। বা‌কি চার ভাই সেখা‌নেই চিৎকার ক‌রে কান্না আরাম্ব করল। জামাল শেখ নি‌জের লুং‌গি‌তে ভা‌লোভা‌বে একটা গিট দিল। তারপর রাজুর পেছ‌নে গি‌য়ে রাজুর ঘা‌ড়েও একটা কোপ দিল। বেচারা সে‌দি‌কে তাকা‌নোর সময়টাও পেল না। সা‌থে সা‌থে রাজুও ধপাস ক‌রে পা‌নি‌তে প‌ড়ে গেল। ফিনকি দি‌য়ে রক্ত বের হ‌তে লাগল। রাজু জামাল শে‌খের দি‌কে চোখ বড় বড় ক‌রে তাকা‌লো। জামাল শেখ আজ‌কে যেন মৃত্যুর খেলায় মে‌তে উঠে‌ছে। বা‌কি তিন ভাই এখন বকুল‌কে ছে‌রে রাজুর লা‌শের কা‌ছে গেল। দুজ‌নেই সা‌থেই মারা গে‌ছে। ওরা বুঝ‌তে পার‌লো সামান্য তিনজন এদের সাথে পার‌বে না। বা‌কি দুই ভাইয়ের লাশ ছে‌ড়ে ওরা পালা‌বেও না।
জামাল শেখ ওর লো‌কে‌দের বলল, ও‌দের ধ‌রে ফেল। আমার সা‌থে লড়‌তে আসার ফলাফল ওরা হা‌রে হা‌রে টের পা‌বে আজ‌কে। জামাল শে‌খের লো‌কেরা ও‌দের তিনজন‌কে ধ‌রে ফে‌লে। ছোটার জন্য অ‌নেক চেষ্টা ক‌রে ওরা। কিন্তু ওই লোক‌দের সা‌থে পে‌রে ওঠা যায় না। জামাল শেখ শ্যাম‌লের কা‌ছে গি‌য়ে বলল, তোরা আমার কা‌জে বাঁধা দি‌য়ে‌ছিস। তোরা‌ জা‌নিস আমার সা‌থে যারা লড়‌তে আসে ও‌দের বা‌ঁচিয়ে রা‌খি না। তবুও তোরা কোন সাহ‌সে গ্রা‌মের ম‌ানুষের সাম‌নে সত্য কথাটা বল‌তে গে‌লি? তো‌দের কি জা‌নের প্রতি মায়া নাই? শ্যামল ছোটার জন্য ছটফট কর‌ছে। জামাল শেখ নি‌জের রক্তমাখা দা টা উচু ক‌রে ধরল। তারপর শ্যাম‌লের দি‌কে এগি‌য়ে আস‌তে লাগল। শ্যাম‌লের বুক বরাবর ক‌য়েকটা কোপ দেওয়ার পর শ্যাম‌লের বুক থে‌কে তাজা রক্ত বের হ‌তে লাগল। শ্যামল তবুও মরল না। নি‌চে প‌ড়ে ছটফট কর‌তে লাগল। জামাল শেখ পা‌নি‌তে ব‌সে অব‌শে‌ষে শ্যাম‌লের গলা‌তেও দা চা‌লি‌য়ে দি‌লো।
সুবাস আর পলক চিৎকার ক‌রে আশেপা‌শের মানুষ‌দের ডাকার চেষ্টা কর‌ছে। কিন্তু তারা জা‌নে আশেপা‌শে এদি‌কে কোন বা‌ড়িঘর নেই। ডাকা‌তের ভ‌য়ে রা‌তের বেলা এদিকটায় কেউ তা‌ঁকি‌য়েও ‌দে‌খে না। তাই চিৎকার ক‌রে যে খুব একটা লাভ হ‌বে তেমনটা ভাবাও যায় না। ওরা বুঝ‌তে পা‌রে যে ও‌দের সময় ফু‌রি‌য়ে আস‌ছে। দুজ‌নে জামাল শে‌খের কা‌ছে ক্ষমা চে‌য়ে ব‌লে, আমা‌দের এইবা‌রের ম‌তো মাফ ক‌রে দিন ভাই। আর আমা‌দের এমন ভুল হ‌বে না।
দুজ‌নের কথ‌া শু‌নে জামাল শেখ বলল, এই কথাটা তো‌দের অ‌নেক আগেই বলার দরকার ছি‌লো। কিন্তু অ‌নেক দে‌রি ক‌রে ফে‌লে‌ছিস। র‌ক্তের লোভ ধ‌রে গে‌ছে আজ‌কে। তারপর জামাল শেখ যেন আরো অ‌নেকটা হিংস্র হ‌য়ে গেল। তারপর বলল, বল এখন কে মর‌তে চাস?
দুই ভাই কাতরা‌তে কাতরা‌তে বলল, আমরা অ‌নেক বড় ভুল ক‌রে ফে‌লে‌ছি। এইবা‌রের ম‌তো আমা‌দের মাফ ক‌রে দিন দয়া ক‌রে।
জামাল শেখ বলল, না না। তোরা ভুল কাজ ক‌রিস নি। আমি খারাপ লোক হ‌তে পা‌রি, কিন্তু ভা‌লো‌কে কখ‌নো খারাপ আর খারাপ‌কে কখ‌নো ভা‌লো ব‌লি‌নি। এদিক থে‌কে আমি বল‌তে পা‌রি তোরা ঠিক কাজই ক‌রে‌ছিস। তো‌দের বড্ড সাহস আছে। এরকম সাহস নি‌য়ে কতজ‌নেই বা জন্ম‌ায় বল তোরা। কিন্তু তো‌দের এই সৎ সাহস আমা‌দের ম‌তো খারাপ মানু‌ষেরা সহ্য কর‌তে পা‌রে না। এখন আর কি করা যাবে। আমরা তো খারাপ মানুষ। মড়‌তে তো‌দের হ‌বেই। শু‌নে‌ছি বড় ভাইয়ের সাম‌নে ছোট ভাই মড়‌তে দেখ‌নে জি‌নিসটা দারুন লা‌গে। আজ‌কে একটু দেখা যাক তো।
জামাল শেখ পল‌কের দি‌কে এগি‌য়ে গেল। পলক ভাইদের ম‌ধ্যে সব‌চে‌য়ে ছোট। বয়স স‌তে‌রো আঠা‌রো হ‌বে প্রায়। ওর হাত-পা কাঁপ‌ছে। জামাল‌ শেখ এগি‌য়ে গি‌য়ে বলল, তো‌কে রক্তাত্ব ক‌রে মার‌তে চাই না। আল্লার গজব পড়‌বে আমা‌দের উপর। তারপর জামাল শেখ পল‌কের গলা‌তে হাতটা রে‌খে জো‌রে চাপ দি‌য়ে ধর‌লেন। প্রচন্ড চাপ। পলকের চোখগু‌লো গোল গোল হ‌য়ে গেল। যেন চোখ দু‌টি খু‌লে আসার চেষ্টা কর‌ছে। হাত-পা ছোড়াছু‌ড়ি কর‌ছে প্রচন্ডভা‌বে। অ‌নেক্ষন গলায় চাপ দি‌য়ে ধ‌রে রাখার পর পলক নি‌স্তেজ হ‌য়ে গেল। সুবাস নি‌জের চো‌খের সাম‌নে চার ভা‌ইয়ের লাশ দে‌খে নি‌জে‌কে আর সাম‌লে রাখ‌তে পার‌লো না। আস্তে আস্তে তার শ‌রির ক্রমশ দুর্বল হ‌য়ে আস‌তে লাগল। সুবাস জ্ঞান হারা‌নোর আগে হয়‌তো বুঝ‌তে পা‌রে তার জ্ঞান হয়‌তো আর কখ‌নোই ফির‌বে না।

জামাল শে‌খের লো‌কেরা লাশগু‌লো নৌকায় তুল‌তে আরাম্ব কর‌ল। ন‌দীর স্রো‌তে সব রক্তগু‌লো ধু‌য়ে যে‌তে লাগল। জামাল শেখ লাশগু‌লো নি‌য়ে রওনা হল। এখন তা‌দের একটাই লক্ষ, সকা‌লের ম‌ধ্যে চেয়ারম্যা‌নের লাশটা তুল‌তে হ‌বে। তু‌লে আরো দূ‌ড়ে ফে‌লে আস‌তে হ‌বে, যা‌তে কেউ খু‌ঁজে পেতে না পা‌রে।

অব‌শে‌ষে নৌকার সক‌লেই নি‌শ্চিৎ হয় যে চেয়ারম্যা‌নের লাশটা এখা‌নেই ফে‌লে‌ছে। ওরা বড় আর শক্ত জালটাই এনে‌ছে। এ জাল ফেল‌লে বস্তাসহ উঠে আস‌বে। জালটা ফালা‌নো হল। কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয়বা‌রে বস্তাটা উঠল না। কিন্তু তৃতীয়বা‌রে জালটা ভা‌ড়ি ম‌নে হল। সবাই টে‌নে টে‌নে বস্তাটা নৌকায় তুলল। জামাল শেখ বস্তার মুখটা খু‌লতে বলল। বস্তাটা খোলার পর দেখা গেল লা‌শের অবস্খা খুব ভয়ানক। লাশটা সাদা ধবধ‌বে হ‌য়ে শু‌কি‌য়ে গে‌ছে। মা‌ছের ম‌তো আঁশটে একটা গন্ধ ও‌দের না‌কে আসে।
জামাল শেখ তার লোক‌দের বলল, একটা কাজ কর সবাই। চেয়ারম্যা‌নের লা‌শের সা‌থে এই পাঁচটা লাশ এই জাল দি‌য়ে পে‌ঁচি‌য়ে ফেল। ওরা তাই ক‌রে। প্রতিটা লাশ এক‌ত্রিত ক‌রে জাল দি‌য়ে গিট দি‌য়ে ফে‌লে। তারপর ওরা নৌকাটা আরো অ‌নেকটা দূ‌রে নি‌য়ে গেল। যে‌দি‌কে জে‌লেরা বা অন্য কেউ বে‌শি একটা যায় না। আকা‌শে সে রা‌তেও থালার ম‌তো রুপা‌লি চাঁদ ও‌ঠে‌ছে। প্রতিটা লাশ তখ‌নো তা‌কি‌য়ে আছে। প্রতিটা লা‌শের মুখ দে‌খে বোঝা যায় ওরা তীব্র নিন্দা জানা‌চ্ছে বিষয়টার। ম‌নে হয় মরার প‌রে হ‌লেও এর প্রতি‌ষোধ তারা নে‌বেই। জামাল শে‌খে সে‌দিনই জি‌নিসটা আঁচ কর‌তে পে‌রে‌ছি‌লো। তার লো‌কেরা সবাই মি‌লে, ছয়জন মানুষসহ সেই জালটা নদীর পা‌নি‌তে ফে‌লে দিল। ডু‌বে গেল সা‌থে সা‌থেই। জামাল শেখ কিছুটা যেন চিন্তামুক্ত হল। এবার য‌দি গ্রা‌মের লোক নদীর ঘাট তন্ন তন্ন ক‌রেও খুঁ‌জে, তবুও চেয়ারম্যা‌নের লাশ খুঁ‌জে পা‌বে না।


বৃ‌ষ্টি কিছুটা ক‌মে‌ছে। আরিফ এতোক্ষন জামাল শে‌খের কথাগু‌লো ম‌নো‌যোগ দি‌য়ে শুন‌ছি‌লো। বুঝ‌তে পার‌লো, এসব কিছুর জন্য দায়ী জামাল শেখ নি‌জে। তার জন্য অ‌নেক সৎ ও নিরপরাধ মানু‌ষের প্রাণ গে‌ছে। সুতরাং একে বা‌ঁচি‌য়ে ‌রে‌খে আর অন্য কা‌রো জীব‌নকে হুম‌কি‌তে ফেলা যা‌বে না। আলী সবাইকে উদ্দেশ্য ক‌রে বলল, আজ‌কে আর ও‌দের আমরা ছাড়বো না। সবাইকে একে একে শেষ কর‌বো। এই আমা‌দের ব‌টিগু‌লো কই।
জামাল শেখ‌কে শক্ত ক‌রে বাঁধা হ‌য়ে‌ছে সা‌থে ও‌র সহকারী‌দের‌কেও। সবাই ভ‌য়ে চোখ বড় বড় ক‌রে তা‌কি‌য়ে আছে। আরিফ বলল, এতো‌দিন যেভা‌বে মানুষ খুন ক‌রে এসে‌ছিস, আজ‌কে প্রতিটা খু‌নেরই বদলা নেওয়া হ‌বে। আলী জামাল শে‌খের সেই দা-টাই শান দি‌তে থা‌কে।
আকা‌শের মেঘ কেঁ‌টে গে‌ছে। মেঘ স‌রে গি‌য়ে চাঁদ উঠল, পু‌র্নিমার চাঁদ। তারপর,,,,
ওরা এরকম কাজ আগে কখ‌নেই ক‌রে‌নি। ত‌বে আজ‌কে কর‌তেই হ‌বে। যেভা‌বেই হোক। রাতও বে‌শি বা‌কি নেই। বে‌শি দে‌রি কর‌লে ও‌দি‌কে ফজ‌রের আজান প‌ড়ে যা‌বে। আরিফ বলল, একাজ আমা‌কেই কর‌তে দাও। আমি নি‌জের হা‌তে ও‌দের মার‌বো। কিন্তু ট্রলা‌রের সক‌লেই বলল, না দাদু। তু‌মি শহ‌রের মানুষ। তু‌মি আমা‌দের গ্রা‌মে কিছু‌দি‌নের জন্য ঘুড়‌তে এসে‌ছো, তোমার হাত দি‌য়ে আমরা একাজ হ‌তে দি‌বো না। য‌দি কখ‌নো জেল জ‌রিমানা হয় ত‌বে আমরা খাট‌বো, তু‌মি বাবা ছোট মানুষ।
আরিফ কিছু বলল না। তা‌দের যেটা ভা‌লো ম‌নে হয় করুক, তার দা‌য়িত্ব সে ঠিকই পালন ক‌রে‌ছে। আরিফ শে‌ষে ব‌লে, আজ‌কে রা‌তে যা ঘট‌বে, তা যেন এই ট্রলা‌রের বাইরে আর কা‌রো কা‌নে না যায়।

আলী জামাল শে‌খের নিক‌টে গি‌য়ে নি‌জের চোখ বাঁধল। এরকম দৃশ্য সে দে‌খে সহ্য কর‌তে পার‌বে না। তারপর শান দেওয়া দা-টা দুহাত দি‌য়ে উচু ক‌রে ধরল। তার হাত কাঁপ‌ছে। চা‌ঁদের আলো‌তে দা-টা চকমক ক‌রে উঠল।

বকুল, রাজু, শ্যামল, সুবাস, পলক আর চেয়ারম্যান মাসুদ মিয়া, চা‌ঁদের আলো‌তে এখন তা‌দের মুখটা প‌রিস্কার দেখা যা‌চ্ছে। ওরা হয়‌তো এমনটাই চেয়েছিল। আজ‌কে তা‌দের আশা পুর্ণ হ‌য়ে‌ছে। ও‌দের মুখগু‌লো কিছুক্ষনের ম‌ধ্যেই মি‌লি‌য়ে গেল। ট্রলারটা রক্তাত্ব। পা‌শেই জামাল শে‌খের নিথর দেহটা প‌ড়ে র‌য়ে‌ছে। মাথার মস্তক দু ফাঁক হ‌য়ে গে‌ছে। তার চো‌খে এখ‌নো ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
আরিফ আলী‌কে বলল, সে‌দিন আমরা যে জালটা পছন্দ ক‌রে কি‌নে‌ছিলাম ওটা আনো। আলী সেটাই করল। জালটার উপর পর পর পাঁচটা লাশই রাখা হল। তারপর জালটা শক্ত ক‌রে গিট দি‌য়ে বে‌ঁধে ‌ফেলা হল। তারপর সবাই মি‌লে ধরাধ‌রি ক‌রে জালসুদ্ধ লাশগু‌লো‌কে পা‌নি‌তে ফে‌লে দি‌লো। ট্রলা‌রে থাকা লোকগু‌লো যেন কিছুটা স্ব‌স্তি পেল। ভয়ানক একটা ডাকাত থে‌কে ওরা আজ‌কে রক্ষা পেল। আকা‌শে দারুন চাঁদ উঠে‌ছে। স্পষ্ট দেখা যা‌চ্ছে ৬ জন মানুষ‌কে। একসময় ওরা খেয়াল করল ওরা আস্তে আস্তে হাওয়ায় মি‌লি‌য়ে যা‌চ্ছে। চার‌দি‌কে কী ঠান্ডা হাওয়া। ভেজা কাপ‌ড়ে সবাইকে শীত ধ‌রি‌য়ে দেয়। কিন্তু ও‌দের শ‌রি‌রে তখ‌নো উত্তেজনা। ওরা আজ থে‌কে প্রতিজ্ঞা ক‌রে, কো‌নো বিপ‌দেই তারা ভয় পা‌বে না। যতই বিপদ আসুক না কেন, সবাই য‌দি এক হ‌য়ে সাহস নি‌য়ে কাজ করা যায়, তাহ‌লে যে‌কো‌নো বিপদ‌কেই তারা অ‌তিক্রম কর‌তে পার‌বে।
ট্রলার ফি‌রি‌য়ে নি‌তে হ‌বে। আজাদ ভাইয়ের রক্ত পড়া বন্ধ হ‌য়ে‌ছে কিছুটা। তাকে ডাক্তার দেখা‌তে হ‌বে, শেলাই দি‌তে হ‌বে।
ট্রলা‌রের পাটাতন থে‌কে সকল রক্ত ধু‌য়ে ফেলা হল। বাল‌তি বাল‌তি পা‌নি এনে পু‌রো ট্রলারটা প‌রিস্কার করা হ‌লো, যা‌তে কেউ স‌ন্দেহ কর‌তে না পা‌রে।
নদীর পা‌ড়ে ফি‌রে আস‌তে আস‌তে ফজ‌রের আযান প‌ড়ে গেল। সবাই মাছ গু‌ছি‌য়ে ফেলল। আর একটু প‌রেই বাজা‌রে নি‌য়ে বি‌ক্রি কর‌তে হ‌বে। প্রচুর মাছ ধরা প‌রে‌ছে আজ‌কে।
আজাদ ভাইকে ডাক্তার দেখা‌নো হল। অ‌নেকগু‌লো সেলাই দি‌তে হ‌য়ে‌ছে। সে না‌কি এক মাস এই হাত দি‌য়ে কো‌নো কাজ কর‌তে পার‌বে না। আজাদ ভাই চিন্তায় প‌ড়ে গেল। এক মাস কাজ না কর‌লে তারা চল‌বে কিভা‌বে? নাঈমা মে‌য়েটা তার বাবার এই অবস্থা দে‌খে অ‌নেক কান্না কর‌লো।

বি‌কে‌লে ঘুম থে‌কে উঠল আরিফ। আজ‌কে বি‌কে‌লেও বৃ‌ষ্টি হ‌বে হয়‌তো। মে‌ঘে অন্ধকার হ‌য়ে এসে‌ছে প্রায়। আলী বলল, বৃ‌ষ্টি আস‌বে হয়‌তো, চল, ঘ‌ড়ে চল। কিছুক্ষ‌নের ম‌ধ্যেই বৃ‌ষ্টি শুরু হল। আরিফ আলী‌কে উদ্দেশ্য ক‌রে বলল, দাদা। আমার তো ছু‌টি শেষ হ‌তে চলল। এখন তো আবার শহ‌রে চ‌লে যে‌তে হ‌বে। আমার কথা তোমার ম‌নে পড়‌বে না? আলী নি‌জের না‌তির মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে দি‌য়ে ব‌লে, তুই চ‌লে গে‌লে তো‌কে বড্ড ম‌নে পড়‌বে। তোর কা‌ছে একটা অনুরোধ থাক‌বে, মা‌ঝে মা‌ঝে এই বু‌ড়ো দাদা‌কে দেখ‌তে আসিস। বয়‌সো তো আর কম হয় নি। ক‌বে শুন‌বি আমি আর নেই।
- এভা‌বে কেন বলছো দাদা। আমি এখন থে‌কে মা‌ঝে মা‌ঝেই তোমার এখা‌নে আস‌বো। এমন‌কি আমা‌দের পু‌রো ফ্যা‌মি‌লি নি‌য়েও তোমার এখা‌নে চ‌লে আস‌তে পা‌রি।
- আলীর চো‌খে পা‌নি চ‌লে আস‌লো। তি‌নি কিছু বলার ম‌তো ভাষা খু‌ঁজে পান না। তার ম‌নের ভেত‌রে লুকা‌নো থা‌কে অ‌নেক কথা। তি‌নি সব কথাই খু‌লে বল‌তে পা‌রেন না। এটা আস‌লে কেউ পা‌রে না। তি‌নি শুধু কাঁদ‌তে থা‌কেন। আরিফ তার দাদার হাতটা ধ‌রে ব‌লে, দাদা। তু‌মি খুব ভা‌লো একজন মানুষ। তোমা‌কে আমি কখ‌নেই ভুল‌বো না। আলী ম‌নে ম‌নে ভা‌বেন, ভা‌লো মানুষেরাই হয়‌তো জীব‌নের কো‌নো এক সময় বড্ড একা হ‌য়ে যায়।
আরিফ ব‌লে, আমি ভা‌র্সিটি‌তে গি‌য়ে সবাইকে বল‌তে পার‌বো যে আমার দাদা একজন সাহসী মানুষ। এলাকার সব‌চে‌য়ে বড় ডাকাত, যার দি‌কে কেউ চোখ তু‌লে তাকা‌তে পার‌তো না, তা‌কে শা‌য়েস্তা ক‌রে‌ছে।
- তুইও তো কম সাহসী না। আজ‌কে তুই য‌দি না আস‌তি তাহ‌লে জামাল শেখ‌কে কখ‌নোই মার‌তে পারতাম না।
আরিফ দাদার কা‌নে কা‌নে ব‌লে, ত‌বে আমরা যে সে‌দিন রা‌তে এসব ক‌রে‌ছি, তা যেন এখ‌নি গ্রা‌মের মানুষ না জা‌নে। এখন জান‌লে বড় একটা ঝা‌মেলা হ‌য়ে যে‌তে পা‌রে।

আজা‌দের অবস্থা মোটামু‌টি ভা‌লোর দি‌কে। আরিফ আজ‌কে আজা‌দের পা‌শে এসে বসল। তারপর শান্ত হ‌য়ে বলল, কেমন আছো আজাদ ভাই?
- আল্লাহর রহম‌তে এখন মোটামু‌টি ভা‌লোই আছি। ত‌বে হাতটা এখ‌নো ঝিম ঝিম ক‌রে। ত‌বে সেটা নি‌য়ে চিন্ত‌া করো না। প্রতি‌দিনই একটু একটু ক‌রে কম‌ছে। ম‌নে হয় এই সপ্তা‌হের ম‌ধ্যেই ভা‌লো হ‌য়ে যা‌বে। নাঈমা আরি‌ফের জন্য চা ক‌রে আনে। আরিফ সেটা খে‌তে খে‌তে ব‌লে, আজ‌কে ঢাকায় চ‌লে যা‌বো ভাই।
আজাদ একটা জো‌রে নিঃশ্বাস ছা‌রে। তারপর ব‌লে, যে‌তে ত‌ো হবেই। কিন্তু তুই চ‌লে গে‌লে গ্রামটা যেন পু‌রো খা‌লি খা‌লি হ‌য়ে যা‌বে। আরিফ বলল, তোমা‌দেরকে ছাড়া স‌ত্যি আমার কিছু‌দিন থাক‌তে কষ্ট হ‌বে। ত‌বে চিন্তা ক‌রো না, সময় পে‌লে আমি আবার চ‌লে আস‌বো, তখন আবার অ‌নেক‌দি‌নের জন্য আস‌বো।
আরিফ নাঈমার দি‌কে তা‌কি‌য়ে ব‌লে, নিয়‌মিত পড়াশুনা কর‌বে, স্কু‌লে যা‌বে, আর তোমার বাবা‌কে দে‌খে রাখ‌বে। আর নি‌জের যত্ন নি‌বে।
- আচ্ছা।
আরিফের কেমন যা‌নি বড্ড কান্না পা‌চ্ছে। এ গ্রাম থে‌কে মো‌টেও তার যে‌তে ইচ্ছে কর‌ছে না। জীবনটা এখা‌নে কত সুন্দর। তবুও চ‌লে যে‌তে হ‌বে।

বি‌কে‌লের দি‌কে ঢাকার বা‌সে উঠ‌লো সে। শেষবা‌রের ম‌তো গ্রামটার দি‌কে তা‌কি‌য়ে দেখ‌লো। আবার ক‌বে দেখা হ‌বে জা‌নে না  সে। পেছ‌নে আলী দা‌ঁড়ি‌য়ে, আলী বলল, সাবধা‌নে যাস। আর মা‌ঝে মা‌ঝে বু‌ড়ো দাদা‌কে দেখ‌তে আস‌বি এখন থে‌কে।
- আস‌বো দাদা। মা‌ঝে মা‌ঝেই আস‌বো।
আরি‌ফের চোখ থে‌কে টপ টপ ক‌রে পা‌নি পড়‌ছে। সে নি‌জের শা‌র্টের হাত‌ায় চো‌খের পা‌নি মু‌ছে বা‌সের সি‌টে গি‌য়ে বসল। বা‌সের জানালা দি‌য়ে বাইরের গ্রামটা দেখ‌ছি‌লো। এম‌নি এক‌দিন সম‌য়ে সে এই গ্রা‌মে প্রথম পা রে‌খে‌ছি‌লো। আজ‌কে তা‌কে চ‌লে যে‌তে হ‌চ্ছে।


আলী আবার আগের ম‌তো মাছ ধর‌তে যায়। নতুন আরেকটা জাল কি‌নে‌ছে সে। আজাদ ভাইয়ের হা‌তের অবস্থাও এখন ভা‌লো আছে। তারা মাছ ধরে। মাছ ধর‌তে গে‌লে নি‌জেরা নি‌জেরাই সেরা‌তের গল্প আলেচনা ক‌রে। জামাল‌ শেখ‌কে কোথাও পাওয়া যা‌চ্ছে না, এটা এলাকার সবাই জে‌নে গে‌ছে। ত‌বে কেউ তা‌কে খু‌ঁজে বের করার চেষ্টাও ক‌রে নি। জামাল শেখের নি‌ঁখোজ হওয়ার ঘটনায় গ্রা‌মের সবাই যেন খু‌শিই হ‌য়ে‌ছে। নদী‌তে মাছ ধর‌তে গে‌লে আগে সারাক্ষন ভ‌য়ে ভ‌য়ে থাক‌তে হ‌তো। কিছু‌দিন ধ‌রে তেমনটা হ‌চ্ছে না। সবাই দি‌ব্বি নদী থে‌কে মাছ ধ‌রে এনে বাজা‌রে বি‌ক্রি কর‌ছে। অ‌নে‌কেই বলাব‌লি কর‌ছে, তা‌কে না‌কি পু‌লি‌শে ধ‌রে‌ছে, অ‌নে‌কে য‌দিও বল‌ছেন, হয়‌তো তি‌নি ম‌রে গে‌ছেন। ত‌বে এর মূল ঘটনাটা কেউ জানলো না।

আরি‌ফের একটা বই বের হ‌য়ে‌ছে। নি‌জের জীব‌নের ঘটনাই সে লি‌খে‌ছে। বইটা ইতিম‌ধ্যে বেস্ট‌-সেলা‌রের তা‌লিকা‌তে আছে। তার গ্রা‌মে যাওয়া থে‌কে ফি‌রে আসার ঘটনা। সা‌থে সে-রা‌তের ভয়ানক বর্ণনা। গা‌য়ের লোম দা‌ঁড়ি‌য়ে যাওয়ার ম‌তো গল্প। পাঠকরা জা‌নেনা ঘটনাটা বাস্তব। কিন্তু আরিফ জা‌নে, এই গ‌ল্পের প্রতিটা ঘটনার তার নি‌জের চো‌খের সাম‌নেই ঘ‌টে‌ছে। সেটা হয়‌তো পাঠক‌দের কখ‌নো বলা যা‌বে না। কিন্তু এটা বাস্তব।

সমাপ্ত

Comments

Popular Posts