একটা ভালোবাসার গল্প

পর্বঃ ৩
এই দুইটা দিন বিজয়ের কাছে মনে হচ্ছিল দুইটা বছরের সমান। কোনভাবেই যেন কাঁটতে চাইছিল না। কিন্তু দিন তো আর থেমে থাকবে না। পরদিন রবিবারে বিজয় আবার রিকসা নিয়ে বের হল। মুখে মাক্স। গায়ে একটা শার্ট। তবে এই শার্টটা বাবার। বিজয়ের কাছে যেগুলো আছে, সেগুলো অনেক দামী। তাই বাবার শার্টটাই এক কথায় চুরি করে আনা হয়েছে আরকি। রিকসা চালালে বিজয়ের মোটেও শীত লাগে না। গরমে প্রায় ঘেমে যায় যায় অবস্থা। বিজয় মনে মনে ভাবে, আমার মতে প্রতিটা মানুষেরই সকাল বেলা এভাবে রিকসা চালানো উচিৎ। এভাবে রিকসা চালালে জিমে গিয়ে টাকা খরচ করার কোন দরকারই নেই।
কিছুক্ষন পরেই বিজয় বাজারের সামনে গিয়ে রিকসাটা থামাল। একটু পরেই মিতু আসবে। এসেই রিকসায় বসবে। আজকে বিজয় ভেবে রেখেছে, মেয়েটার কাছে সে ফোন নাম্বারটা চাইবে। এখন মেয়েটা দিলে হয়। নাও দিতে পারে। নাম ছাড়া একে উপরের কোন কিছুই জানে না। দুজনের পরিচিত না তারা। কিছুক্ষন পরে মিতু আসল। তারপর বলল, কী খবর আপনার? কেমন আছেন? বিজয় বলল, এইতো, ভালোই আছি।
মেয়েটা রিকসায় উঠে বসল। তারপর বলল, চলুন।

বিজয় রিকসা নিয়ে এগোচ্ছে। আজকে কথাটা বিজয়ই আরাম্ব করল। আচ্ছা, আপনি কিছুদিন ধরেই আমার রিকসাতেই যাচ্ছেন? এর কারণ কী?
  - আপনিই তো আমার জন্য রিকসা নিয়ে অপেক্ষা করেন। আপনি অপেক্ষা করার পরেও যদি আমি অন্য কোন রিকসায় উঠে যাই। তাহলে আপনার প্রতি একটা খারাপ ব্যাবহার হলো না?
  - আপনিই তো আমাকে অপেক্ষা করতে বলেন। তাই তো অপেক্ষা করি।
মেয়েটা একটু ভ্রু কুচকে বলল, তারমানে আপনি বিরক্ত হচ্ছেন।
  - না না। বিরক্ত হতে যাবো কেন? বরং ভালোই লাগে?
  - ভালো লাগে মানে?
  - মানে.. ইয়ে আরকি.. আপনার সাথে ভালোভাবে কথা বলা যায়। অন্য কোন যাত্রীর সাথে তো এভাবে কথা বলতে পারি না। সবাই তো আর আপনার মতো ভালো ব্যাবহার করে না।
  - ধন্যবাদ।
  - ধন্যবাদ কিসের জন্য?
  - দিলাম এমনি। আর হ্যা। কালকে বিকেলে আমরা একটা অনুষ্ঠানে যাবো। আমি আর আমার চাচাতো বোন। ভেবেছি, আপনার রিকসাতেই যাবো। যাবেন কালকে?
  - আপনি বললে অবশ্যই যাবো। কখন কোথায় রেডি থাকতে হবে শুধু এটা বলে দেন। যথা সময় গিয়ে আমি উপস্থিত থাকবো।
  - কালকে আমার বাসার সামনে যাবেন। আমি বাসার ঠিকানা দিচ্ছি।

বিজয় এই জিনিসটাই এতদিন ধরে খুঁজছিল। মেয়েটার বাসার ঠিকানা। আজকে মেয়েটা নিজের ইচ্ছাতেই ঠিকানাটা দিল। তারপর বলল, কালকে আমি অফিসে ছুটি নিয়েছি। তাই সকালে আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। আপনি বিকাল চারটায় আমার বাসার সামনে এসে পরবেন।
মেয়েটাকে অফিসে রেখে এসে বিজয় রিকসাটা জমা দিয়ে এসে সেখান থেকে সরাসরি বাসায় চলে আসল। যেন মনে হয় এটাই তার রোজকারের ডিউটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাতে খাওয়ার সময় বিজয়ের বাবা বিজয়কে বলল, অনেকদিন পর পর তো দেশে আসিস। তোকে কতবার বলি, তুই এইবার একটা বিয়ে করে ফেল। আমি নিজে আর কত কিছু সামলাবো। আমারো তো বয়স হয়ে গেছে।
বিজয় খেতে খেতেই জবাব দিল, করবো বাবা। সময় হলেই করে ফেলব।
  - তুই বলতে চাচ্ছিস, এখনো তোর সময় হয়নি? এতো বড় হয়ে গেছিস। চাকরি করিস। তাও বলছিস সময় হয় নি।
  - তুমি কেন বুঝতে পারছো না বাবা। আমি অই সময়ের কথা বলিনি। আমি বলেছি, আমি বিয়ে করবো। তবে তোমার আর আমার দুইজনেরই পছন্দে।
  - সেটা তো না বলিনি। কেন? হটাৎ এই কথা কেন? কাউকে পছন্দ হয়েছে?
  - তেমনটা না বাবা।
  - পছন্দ থাকলে বল। আমি কথা বলবো মেয়ের ফ্যামিলির সাথে।
বিজয় খাওয়া শেষ করে বলল, সেটা পরে দেখা যাবে। সময় হলে তোমাকে ঠিকই বলবো।
  - তারমানে তুই কাউকে পছন্দ করিস। আর সেটা তুই আমাকে এখন বলছিস না। সময় হলে বলবি?
  - ধরে নাও তেমনটাই বাবা। এখন তারাতারি খাও। খেয়েদেয়ে শুয়ে পরো। তা স্কুল কেমন চলছে? বাচ্চারা বিরক্ত করে না?
  - বাচ্চাদের কাজই তো বিরক্ত করা। একটু একটু তো করবেই। ওসব সহ্য হয়ে গেছে। ছোটবেলায় তুইও কম দুষ্টু ছিলি না।

সেদিন বিজয় শুয়ে পড়ল। ঘুমানোর আগে জাভেদ ফোন করল। জাভেদ বলল, কী খবর বিজয়? কোথায় থাকিস?
  - থাকি বাসাতেই।
  - কিছুদিন ধরে তুই আমাদের সাথে ভালোভাবে কথা বলছিস না। তুই মনে হয় আমাদের দুজনের উপরে রাগ করেছিস। তোকে ওভাবে রিকসা চালাতে দেওয়াটা আমাদের ঠিক হয় নি। আমাকে মাফ করে দিস বন্ধু।
  - বাব্বা। আজকে রাতে কি আকাশে সুর্য উঠল নাকি রে? এভাবে কথা বলছিস কেন রে?
  - ঠাট্টা করে বলছি না। আসলেই বলছি। ভাবলাম, তুই হয়তো আমাদের উপরে রাগ করে আছিস।
  - ধুর! ফালতু কথা বলিস না। রাগ করতে যাবো কেন তোদের সাথে? রিকসা চালাতে দিয়েছিলি। রিকসা চালিয়েছি। ভালোই লেগেছে। ওসব নিয়ে তুই ভাবিস না। কিছুদিন ধরে একটু ব্যাস্ত আছি।
  - তোর আবার কিসের ব্যাস্ততা এখন?
  - পরে বলবো।
  - সেদিন আমাদেরকে চায়ের দোকানে একলা রেখে একটা মেয়েকে রিকসায় করে নিয়ে উড়ে গেলি। বলি মেয়েটা কিন্তু জোস ছিল।
  - ধুর। কী সব বলছিস।
  - আমাদেরকে বোকা বানিয়ে লাভ নেই বন্ধু। সুন্দরী মেয়ে। একটু ফিলিংস তো থাকবেই। বলতে লজ্জা পাচ্ছিস কেন?
  - তা তো ঠিক। কিন্তু বন্ধু, আমি একটু বেশিই ভেবে ফেলেছি। আমি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছি।
  - বলিস কী। প্রথম দেখাতেই ভালোলাগা?
  - তেমনটাই। একমাত্র তোকেই কথাটা বললাম। কাউকে বলিস না।
  - বলবো না কেন? এটা তো সবাইকে বলারই কথা। ভেবেছি এখনি সবাইকে কথাটা ফোন করে জানিয়ে দেব।
  - না। তেমনটা এখনি করিস না। সময় হলে বলিস সবাইকে।
  - তা। মেয়েটার ঠিকানা আছে?
  - হুম। আজকে মেয়েটা নিজেই আমাকে দিয়েছে।
  - বলিস কী। তাহলে তো ব্যাপারটা অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে।

সেদিন রাতে বিজয় আর জাভেদের মধ্যে অনেক কথা হল। কথাবার্তা বলে সেদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়ল। আচ্ছা, মেয়েটার কী কোন বয়ফ্রেন্ড আছে? তাই যদি হয়, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? বিজয়ের মনের মধ্যে এই চিন্তাটা বার বার ঘুড়পাক খেতে লাগল। এখন তো কিছু কিছু মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের আগে থেকেই কোথাও রিলেশনশিপে থাকে। এই মেয়েটার ক্ষেত্রেও যদি তেমনটা হয়? তাহলে কেমন হবে? তবে তেমনটা নাও হতে পারে। সাধারণ একটা মেয়ে। বয়ফ্রেন্ড থাকলে অবশ্যই তাকে নিয়ে একবার হলেও রিকসায় উঠত। অফিসে যাওয়ার আগে তার সাথে একবার দেখা করার জন্য আসতো। কিন্তু তেমনটা তো হচ্ছে না। একা মেয়ে। বড় ভাইটা মারা গেছে কিছুদিন আগে। বাবা-মা অসুস্থ। বিজয় খেয়াল করেছে মেয়েটার চোখের নিচে কালো দাগ। সংসারের খরচের বোঝা মেয়েটা একাই মাথায় নিয়েছে।
এসব ভাবতে ভাবতে বিজয় সেদিনের মতো ঘুমিয়ে গেল।

পরদিন বিকেলবেলা বিজয় রিকসা নিয়ে সেই ঠিকানায় রওনা হয়ে গেল। সাড়ে তিনটা বাঁজে। আধা ঘন্টার মধ্যেই ওরা রেডি হয়ে অপেক্ষা করবে। এখনি বিজয়ের কেমন যেন শীত শীত করছে। আর কিছুক্ষন পরে কুয়াশাও পড়ে আসবে। বিজয়ের গায়ে হালকা একটা সোয়েটার। বিজয় এর আগেও এদিকে এসেছে। তবে সেটা অনেক ছোটবেলায়। এখন চারদিকে বিল্ডিং উঠে গেছে। আরেকটু সামনেই মেয়েটার বাসা। বিজয় রিকসার গতি বাড়িয়ে দিল। একসময় মেয়েটার বাসার কাছে এসে বিজয় থামলো। বাসাটা চার তলা। মেয়েটা কয় তলায় থাকে সেটা সে জানে না। তবে এটাই সেই মেয়েদের বাসা এটা নিশ্চিত। এই বাসার ঠিকানাটাই তো দিয়েছিলো। বিজয় কয়েকবার রিকসাটার বেল বাজালো। আর সেই বেল বাজানোতে কাজও করলো। ওইযে, দুই তলা থেকে মেয়েটা ইশারা দিচ্ছে। হাসি মাখা মুখ। হাতের পাঁচটা আঙ্গুল দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল, আর মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগবে। বিজয় সেদিকে কতক্ষন তাকিয়ে ছিল সেটা সে হিসাব করতে পারলো না।

সরি। অনেক দেরি হয়ে গেল। কিছু মনে করবেন না যেন। বিজয় দেখল, মিতু আজকেও শাড়ি পড়েছে। চুলগুলো খোলা। মিতুর সাথে আরেকটা মেয়ে। এটা মিতুর চাচাতো বোন। দেখতে প্রায় মিতুর মতোই। সেও সুন্দর করে শাড়ী পড়েছে। দুজন রিকসায় উঠে বসল। বিজয় রিকসা চালাতে আরাম্ব করল। মিতু মাঝে মাঝে বিজয়কে রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছে। আর টুকিটাকি কথা বলছে। বিজয় শুধু মাথা নাড়িয়ে যাচ্ছে।
মিতুর বোন মিতুকে ফিস ফিস করে বলল, এই ছেলেকে তুই চিনিস?
  - চিনবো না কেন? অফিসে যাই রিকসায়।
  - ছেলেটা দেখতে কিছু দারুন।
  - ধুর। কী বলছিস এসব। পাগল কোথাকার।
কথাগুলো দুজনে পেছন থেকে ফিস ফিস করে বলছিলো। যাতে ছেলেটা শুনতে না পায়। তবে, বিজয় কথাটা স্পষ্টই শুনতে পেয়েছিলো। শরিরে যেন দ্রুত বিদ্যুৎ খেলে গেল। এই শীতের মধ্যেও যেন বিজয় ঘামছে। রিকসার গতি বাড়িয়ে দিল সে। রিকসার পেডেল ঠিকমতো করতে পারছে না সে। নাহ। যেভাবেই হোক শান্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মিতু বলল, আরেকটু সময় লাগবে। বিজয় রিকসা চালিয়ে ক্লান্ত। এতোক্ষন সময় সে কখনোই আগে রিকসা চালায় নি। মেয়েটা একটা বাসার সামনে দাঁড়াতে বলল। হুম। বাসাটা ভালোই সাজানো হয়েছে। বিজয় বলল, কিসের অনুষ্ঠান এটা? মিতু বলল, বিয়ে। আমার খালাতো বোনের বিয়ে। এটা আমাদের খালার বাসা। ইচ্ছা ছিলো আজকে খালার বাসায় রাতে থেকে গিয়ে অনেক আনন্দ করবো। কিন্তু তেমনটা করা হচ্ছে না। কালকে সকালে অফিসে জরুরি একটা মিটিং রয়েছে। উপস্থিত থাকতেই হবে। তাই আনন্দটা একেবারে মাটি হয়ে গেল। ভেবেছি, আমি খেয়েদেয়ে সবার সাথে দেখা সাক্ষাত করে বাসায় চলে যাবো। তাই যদি কিছুটা সময় আমার জন্য অপেক্ষা করেন এখানে অনেক উপকার হতো। আমার সর্বোচ্চ দেড় ঘন্টার মতো লাগবে।

বিজয়ের শীত লাগছে প্রচন্ড। এই শীতে তার উচিত ছিলো বাসায় গিয়ে কম্বল গায়ে ঘুমানো। কিন্তু তা না করে বিজয় একটা মেয়ের জন্য এখানে শীতে কাঁপাকাঁপি করছে। বিজয়ের কল্পনা দুইটা অংশে ভাগ হয়ে গেল। একভাগ বলছে, চলে যেতে। এই শীতের কষ্ট সহ্য করে লাভটা কী? সামান্য একটা মেয়ের জন্য এতো কিছু করছিস? আরেক অংশ বলছে, মেয়েটা মোটেও সামান্য না। মেয়েটা তোর জন্য অনেক স্পেশাল। সে মেয়েটাকে তার ভালোবাসার কথা জানাবে। কিন্তু সেটা সময়ের অপেক্ষা।

রাত আটটা বাঁজে। বিজয় চায়ের দোকানে গিয়ে এক কাপ চা দিতে বলল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে তার বাবাকে ফোন দিল। ওপাশ থেকে বাবা বলল, কোথায় তুই?
  - বাইরে আছি। আসতে একটু দেড়ি হবে। তুমি খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে যেও।
একটা ছেলে চা দিয়ে গেল। বিজয় চায়ে চুমুক দিল। পরিবেশটা দারুণ। চায়ের দোকানের টিভিতে একটা গান বেজে যাচ্ছে অনবরত। দোকানটাতে মানুষের ভির একটু বেশি হওয়ায় শীতটা একটু কম লাগছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে ক্ষুধার পরিমানটাও বাড়ছে। পাশে একটা হোটেলও আছে। চায়ের দোকান থেকে উঠে সে হোটেলে চলে গেল। ভাত খেতে পারলে ভালো হবে। মেয়েটা যদি আবার এসে পরে? তবুও। কিছু খেতে হবে।

মেয়েটা রাত দশটার সময় বাসা থেকে বের হল। বিজয় খেয়েদেয়ে আবার সেই চায়ের দোকানেই বসেছিল। মেয়েটা রিকসার সামনে এসে বিজয়কে খুজতে লাগল। বিজয় চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে মেয়েটাকে বলল, অবশেষে আসলেন তাহলে?
  - সরি। এতো দেরি করার ইচ্ছা আমার ছিলো না। তবুও বিয়ে বাড়িতে গেলে তো হুট করে আসা যায় না। খাওয়াদাওয়া করলাম। তারপর বলল, কিছু ছবি তুলতে হবে। ফ্যামিলির সবাই ছিলো সেখানে। তাই অনেকটা দেরি হয়ে গেল।
  - থাক সমস্যা নেই।
  - আপনিও হয়তো ভিতরে ভিতরে আমার উপরে রাগ করছেন। একটা মেয়ের জন্য অনেক রাত পর্যন্ত জেগে আছেন।
  - ধুর। কেবল রাত ১০ টা বাঁজে। এটা কোন রাত হল। এখন কথা বাদ দিয়ে রিকসায় উঠেন। আর আপনার বোন কোথায়?
  - ও আজ রাতে থাকবে।
  - ইচ্ছা করলে আপনিও তো থাকতে পারতেন। এখান থেকেই অফিসে যেতে পারতেন।
  - বাবা মা বাসায় একা।

বিজয় রিকসা চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশটা এখানে নীরব। এদিকে বাসাবাড়ি এবং লোকজন নেই বললেই চলে। একেবারে শুনশান। মাঝে মাঝে কিছু ঝি ঝি পোকা ডাকছে। রাস্তার এক পাশে অনেকগুলো পতিত জমি। সব মিলিয়ে জায়গাটা প্রায় ভৌতিক বললেই চলে।
  - আপনার বাবা মাকে খুব ভালোবাসেন মনে হয় তাই না?
  - যতটুকো পারি ভালো রাখার চেষ্টা করি। আর পারি কই। সারাদিন অফিসে থাকি। শুধু রাতে কথাবার্তা হয়।
  - আপনি মেয়ে হয়ে বাবা মায়ের জন্য এতো কিছু করছেন এটাই অনেক কিছু। আচ্ছা। এতো রাতে আপনি একা। সাথে অচেনা একটা ছেলে। আপনার ভয় করছে না।
  - ভয় করবে কেন? আমাকে দেখে কী ভীতু মেয়ে মনে হয়?
  - সেটাই তো মনে হচ্ছে। এতো রাত। অন্ধকার। ভূতের ভয় পেতে পারেন।
  - ভূত দেখেছেন কখনো?
  - না।
  - যেই জিনিস আমরা কখনো দেখি নি। সে জিনিস দেখে ভয় পাই কেন?
  - আসলে ব্যাপারটা ছোটবেলায় আমাদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে ভূত একটা ভয়ঙ্কর জিনিস। আমরা মনে মনে একটা ভয়ঙ্কর অবয়ব কল্পনা করে সেটা দেখে নিজে নিজেই ভয় পাই। অথচ আদৌ সেই জিনিস বাস্তবে নেই।
  - মাঝে মাঝে আপনাকে দেখে রিকসাওয়ালা মনে হয় না। আপনি অনেক কিছু জানেন সেটা আপনার ভাষার প্রকাশ দেখে বোঝা যায়। আপনি একজন রিকশাচালক হয়েও দুনিয়ার অনেক খোঁজখবর রাখেন। ব্যাপারটা ভালো লাগলো।

জায়গাটা শহর থেকে অনেকটা দূরে। শীতের পরিমানটাও আস্তে আস্তে বাড়ছে। সাথে ঠান্ডা বাতাস। বাতাসের কারণে আজকে কুয়াশা অতোটা বোঁঝা যাচ্ছে না। আশেপাশটা দারুণ পরিস্কার। এমন সময় বিজয় সামনে দুইটা আলো দেখতে পেল। বিজয় এগিয়ে যাচ্ছে। আলোগুলোও সামনে আসছে। অইতো কয়েকটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। বিজয়ের রিকসা আরো এগিয়ে নিয়ে গেল। এবং তারা তাদের রিকসার দিকেই তাকিয়ে আছে। সাথে দুইটা মটরসাইকেল। মটরসাইকেলের হেডলাইটের আলো জ্বলছে। বিজয়ের ব্যাপারটা কেমন যেন সন্দেহ লাগতে লাগল। পেছন থেকে মেয়েটা বলে উঠলো, রিকসা দ্রত চালাবেন। ওনারা থামাতে বললেও থামাবেন না। বিজয় আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল, লোকগুলো কে? কিন্তু মেয়েটা এর উত্তর দিলো না। কেবল বলল, রিকসা দ্রুত চালান। থামবেন না। বিজয় রিকসার গতি বাড়িয়ে দিল। ছেলেগুলোর বয়স বেশি না। বিজয়ের বয়সেরই। রিকসাটা ছেলেগুলোর কাছে আসা মাত্রই বিজয় ছেলেগুলোকে খেয়াল করল, ছেলেগুলো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। বিজয় রিকসার গতি বাড়িয়ে দিল। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই বিজয় ছেলেগুলোকে অতিক্রম করে চলে গেল। মেয়েটা পেছন থেকে আবার বলল, তারাতারি চলুন প্লিজ। জায়গাটা সুবিধের মনে হচ্ছে না। বিজয় বলল, চিন্তা করবেন না। আর বেশি সময় লাগবে না।
সেই মুহুর্তেই পেছন থেকে মটরসাইকেলের আওয়াজ আসতে লাগল। ছেলেগুলো রিকসাটার পিছু নিয়েছে। মটরসাইকেলের তুলনায় রিকসার গতি সামান্য থাকার কারণে, অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই ছেলেগুলো সেই রিকসার কাছে এসে পড়ল। বিজয় এদের পরিকল্পনা ঠিক বুঝতে পারল। সে রিকসা জোরে চালানোর চেষ্টা করল। ছেলেগুলো মটরসাইকেলের গতি আরো বাড়িয়ে দিল। তারপরেই একটা লম্বামতোন ছেলে মিতুকে বলল, মিতু! এতো রাতে আমি থাকতে এই ছেলের রিকসায় কী করছ? আমার গাড়িতে চলে এসো জান। ছেলেটার কথা শুনে মিতু কোন উত্তর দিল না। বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তারাতারি।
মটরসাইকেল আর রিকসা একই গতিতে চলছে। এই মিতু। আজকে তোমাকে অনেক হট লাগছে। চলোনা, আজকে রাতে যাই এক জায়গায়। অনেক মজা হবে। বিজয় এই কনকনে শীতের মধ্যেও ঘামছে। ক্রমেই ছেলেটার উৎপাত আরো বাড়তে লাগল। বিজয় সামনে থেকে কেবল সহ্য করে যাচ্ছিল। সহ্যের সীমা অতিক্রম করল তখনই যখন ছেলেটা মিতুর ওড়নাটা ধড়ে টান দিল।
বিজয় তার ডান পা দিয়ে মটরসাইকেলের সামনের অংশে জোড়ে একটা লাথি দিল। সাথে সাথে মটরসাইকেলের মধ্যে থাকা দুইজন নিয়ন্ত্রন হাড়িয়ে রাস্তার পড়ে গেল। বিজয় রিকসা থেকে নামল। ছেলেগুলো হাটুতে ব্যথা পেয়েছে নিশ্চই। বিজয় ছেলেটার কাছে গিয়ে ছেলেটার শার্টের কলার চেপে ধরে দাঁড় করালো। ঠাস ঠাক করে ডান গালে দুইটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, রাস্তায় মেয়ে দেখলে নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারিস না।
আরেকটা মটরসাইকেলে আরো দুইজন ছিল। ওরা মটরসাইকেল থামিয়ে বিজয়ের কাছে এসে বলল, সমস্যা কি আপনার? শরিরে বেশি চর্বি হইছে? ছেলেটা আচমকা বিজয়ের নাকের মধ্যে একটা ঘুষি দিয়ে বসল। এই ঘুষির জন্য সে মোটেও প্রস্তত ছিলো না। বিজয় সাথে সাথে ছেলেটার কলার ধরে নাকের মধ্যে দুইটা ঘুষি দিল। সাথে সাথে আরেকটা ছেলে এসে বিজয়কে পেছন দিক থেকে চেপে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু বিজয় নিজের কুনুই দিকে ছেলেটার পেটের মধ্যে আঘাত করল। ছেলেটা সাথে সাথে দু হাত দুড়ে ছিটকে চলে গেল। একজনের নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আরেকজন পেটে আঘাত পেয়ে সেখানেই শুয়ে পড়ল।
বিজয় লম্বামতোন ছেলেটার কাছে গিয়ে পুনারায় কলার ধরে বলল, কী? মেয়ে দেখলে হুস থাকে না? বল সালা। তোদের জন্য এখন মেয়েরা রাস্তায় বের হতে ভয় পায়। আজকে তোর এমন অবস্থা করবো তুই আজ থেকে মেয়েদের দিকে তাকালেই লজ্জা পাবি। বিজয় ছেলেটার চুলের মুঠি ধরে দুই গালে মারতে মারতে লাল বানিয়ে ফেলল। নাকে মুখে কয়েকটা ঘুষি দিল। ঠোট ফেঁটে র*ক্ত আসতে লাগল। তবুও বিজয় থামছে না। মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে। ছেলেটা একসময় নিস্তেজ হয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়ল।
এই প্রথম মেয়েটা বিজয়ের হাত ধরে টান দিয়ে বলল, হয়েছে। মরে যাবে, আসুন তো। বিজয় খানিকটা শান্ত হল। মিতু এখনো ভয় পাচ্ছে। তার ঠোট কাঁপছে।
বিজয় বলল, ভয় পাবেন না। ওরা শিক্ষা পেয়েছে। আর এমন করবে না। আপনি কি এদের আগে থেকেই চেনেন?
মিতু মাথা ঝাকিয়ে বলল, হুম। মাঝে মাঝেই বিরক্ত করে। বাসায়ও আসার চেষ্টা করে। বাবাকে হুমকি দেয় আমার সাথে বিয়ের জন্য। আমি ওকে বিয়ে করবো না। তারপরেও বার বার বিরক্ত করার জন্য আসে।
- আবার আসলে জানাবেন আমাকে। এখন চলুন।
দুজনেই রিকসায় উঠে বসল। রিকসা চালাতে আরাম্ব করল বিজয়। অনেক রাত হয়ে গেছে। রিকসার মালিক আজকে নিশ্চই জরিমানা রাখবে। এদিকে বিজয়ের বাবাও ঘুমিয়ে গেছে হয়তো।
"আজকে আপনি না থাকলে আমার অনেক খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারতো জানেন সেটা?"
বিজয় এর কোন উত্তর দিলো না। মেয়েটা আবার বলল, থ্যাংকস। শুধু থ্যাংকস দিলে ভুল হবে।
- তাহলে আর কী দিতে চান?
- আমার তো দেওয়ার মতো কিছু নেই। কিন্তু আপনার কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।
- আপনি বিপদে আছেন। আপনাকে সাহাজ্য করা আমার দায়িত্ব।

আরো কিছুক্ষন রিকসা চালানোর পর অবশেষে মেয়েটার বাসায় আসলো বিজয়। মেয়েটা রিকসা থেকে নেমে ভাড়া দিল। দেওয়ার সময় বলল, আপনাকে যত টাকাই দেই না কেন। সেটা কম হয়ে যাচ্ছে।
- ধুর। কী বলছেন এসব? আপনার এতো কিছু ভাবার দরকার নেই। যান। বাসায় যান অনেক রাত হয়ে গেছে।
মেয়েটা বাসায় যাওয়ার আগে বিজয়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। মেয়েটা বিজয়ের মুখের কাছে গেল। "আপনার নাক দিয়ে র*ক্ত বের হচ্ছে"। আমি একদম খেয়াল করি নি। ব্যথা পেয়েছেন নিশ্চই? মেয়েটা অনেকটা অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।
বিজয় বলল, আপনি চিন্তা করবেন না। বেশি ব্যথা পাই নি। ফার্মেসি থেকে অসুধ নিয়ে নিব। কিন্তু বিজয় একসময় খেয়াল করল মিতুর চোখে পানি চলে এসেছে। সে নিজের ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে নিজের হাত দিয়ে তার নাকের র*ক্তটা মুছে দিল। বিজয় কিছুক্ষনের জন্য থ হয়ে রইল। মেয়েটা একসময় বলল, আমাকে মাফ করে দিয়েন। এসব কিছু আমার জন্যই হয়েছে।
- আপনি অনেক বেশি চিন্তা করছেন। যান। এখন ঘড়ে যান। আপনার বাবা মা অপেক্ষা করছে হয়তো।
মেয়েটা চলে গেল। রাত বারোটা ছুই ছুই। বারোটার পরে রিকসা নিয়ে গেলে জরিমানা নিবে অবশ্যই। কিন্তু কী আর করার।


চলবে.....

Comments

Popular Posts