জাল পর্ব ০৪

 ০৪।

আরিফ‌কে ছে‌ড়ে দি‌য়ে বা‌কি দুইজন জামাল‌ শে‌খের পেছ‌নে পেছ‌নে রওনা দি‌লো।
বাইরে বৃ‌ষ্টির প্রবল বে‌গে কিছুই দেখা যায় না। দুইজন সহকা‌রি কিছুক্ষ‌নের ম‌ধ্যেই ছোট্ট ঘ‌ড়ের ম‌ধ্যে মি‌লি‌য়ে গেল। তারপর ও‌দের খবর আর পাওয়া গেল না। আবার পা‌শে কোথাও একটা বজ্রপ‌াত হ‌লো। কা‌নে তা‌লি লে‌গে আসে। তারপর নিরবতা। জামাল শে‌খের কোন আওয়াজ পাওয়া যায় না।
আরিফ বলল, এখনি ও‌দের ধরার ভা‌লো সময়। ওরা সবাই ঘড়টার ভেত‌রে গি‌য়ে মাছ লুট‌ছে। তারপর সবাইকে প্রস্তুত হ‌তে বলল আরিফ। আজ‌কে এই ডাকাত‌দের শেষ দে‌খে ছাড়‌বে। আরিফ বলল, আমা‌দের কা‌ছে অস্ত্র বল‌তে কী কী আছে? ট্রলা‌রে ক‌য়েকটা ব‌টি আছে। আর কিছু চাকু আছে। আর বড় বড় কিছু বড়‌শি। সবাই রে‌ডি রা‌খো সব কিছ‌ু। আজ‌কে এর শেষ দে‌খে ছাড়‌বো সবাই।
আরিফ সাবধা‌নে ট্রলা‌রের ভেত‌রের ছোট কক্ষটার দি‌কে এগি‌য়ে গেল। তারপর সাবধা‌নে কক্ষটার দরজা ধপ ক‌রে আট‌কে দি‌লো। স‌াথে সা‌থে দরজার খিলটা আট‌কে দি‌লো। স্টি‌লের দরজা। সহ‌জে এটা ভে‌ঙে ওরা বের হ‌তে পার‌বে না। জামাল শে‌খের লো‌কেরা হয়‌তো ঘটনাটা‌ টের পে‌য়ে যাওয়ার পর মাছ লুট করা বাদ দি‌য়ে দরজার কা‌ছে ছু‌টে আস‌লো। কিন্তু ততক্ষ‌নে অ‌নেকটা দে‌রি হ‌য়ে গে‌ছে। এই দরজা সহ‌জে ওরা ভাং‌তে পার‌বে না।

আরিফ সকল অস্ত্র রে‌ডি ক‌রে। সবার হা‌তেই কিছু একটা দি‌য়ে ব‌লে, আজ‌কে আমাদের লড়াই কর‌তে হ‌তে পা‌রে। আমি জা‌নি তোমরা পার‌বে। তোমরা তো আর বা‌কি‌দের ম‌তো ভীরু না। আজ‌কে হয় এদের পু‌লি‌শে দি‌বো নয়‌তো এমন অবস্থা কর‌বো, যা‌তে আর ডাকা‌তি না কর‌তে পা‌রে।
ভেতর থে‌কে প্রচন্ড‌ বে‌গে দরজা ধাক্কা‌নোর আওয়াজ আস‌ছে। প্রবল বৃ‌ষ্টির ম‌ধ্যেও দেখা যা‌চ্ছে যে দরজাটা কাঁপ‌ছে। ম‌নে হ‌চ্ছে যেন ভে‌ঙে ফেল‌বে ওরা। ত‌বে এই দরজা ভাঙা কোন মু‌খের কথা না। শক্ত স্টি‌লের দরজা। কিন্তু ভাঙাটা যে অসম্ভব সেটাও বলা যা‌বে না। ওরা একসময় দরজার ম‌ধ্যে দা দি‌য়ে কোপা‌তে শুরু করল। বজ্রপা‌তের আলো‌তে দেখা যা‌চ্ছে দরজাটা ওরা ক্ষত‌বিক্ষত ক‌রে ফেল‌ছে। ওরা অপরপা‌শে কতটা হিংস্র হ‌য়ে গে‌ছে সেটা দে‌খেই বোঝা যা‌চ্ছে। চিৎকার কর‌ছে আর নানান ধর‌নের আজেবা‌জে ভাষা ব্যবহার কর‌ছে।
বাতাস অ‌নেকটা ক‌মে‌ছে। ত‌বে বৃ‌ষ্টি এখ‌নো আগের ম‌তোই একটানা ব‌র্ষে যা‌চ্ছে। একটুর জন্যও ক‌মে‌নি। আরিফ শুনতে পা‌রে ওরা চিৎকার কর‌ছে। খুবই আজবভা‌বে। ‌কিছুক্ষ‌নের জন্য আরি‌ফের স‌ন্দেহ হ‌লো, কি কর‌ছে ওরা ভিত‌রে? ও আস্তে আস্তে দরজাটার কা‌ছে গেল। তারপর দরজার পা‌শে কান পে‌তে শোনার চেষ্টা করল ভিত‌রে ওরা কি বল‌ছে। ত‌বে ও‌দের কোন কথা শোনা গেল না। আরি‌ফে‌র কা‌নের কা‌ছে হটাৎ ক‌রে একটা দা‌য়ের কোপ দরজা ফে‌টে বের হ‌য়ে এলো। চম‌কে উঠ‌লো ও। একটুর জন্য রক্ষা পে‌য়ে‌ছে ও। আর একটু বা‌মে কান রাখ‌লে, দা পু‌রোটা আরি‌ফের কা‌নের ভিতর ঢু‌কে যেত। আরিফ শুন‌তে পেল ওরা কেন জা‌নি চিৎকার কর‌ছে। বৃ‌ষ্টির শ‌ব্দে ভা‌লোভা‌বে কিছু শোনা যা‌চ্ছে না। ও‌দের কথা কা‌নে আস‌ছে না। শুধু অ‌নেক্ষন যাবৎ চিৎকার ক‌রে যা‌চ্ছে এটাই বোঝা যা‌চ্ছে।
আলী বলল, কি হ‌য়ে‌ছে ভেত‌রে? ওরা একম কর‌ছে কেন? আরিফ জা‌নি‌য়ে দিলো এটা ও‌দের ফাঁদ। ওরা নিশ্চই এমনভা‌বে অ‌ভিনয় কর‌ছে যা‌তে আমরা দরজাটা খু‌লে দেই, আর ওরা আমা‌দের উপর সরাস‌রি ঝা‌পি‌য়ে পড়‌বে। আর এইবার আমা‌দের কিছু না কিছু কর‌তেই হ‌বে। ওরা ক্ষে‌পে গি‌য়ে‌ছে। তাই ওদের য‌দি কিছু না করা হয়, তাহ‌লে প‌রে যে‌কো‌নো সময় আমা‌দের উপ‌রে হামলা ক‌রে দি‌বে।
আরো অ‌নেকটা সময় পার হ‌য়ে গে‌ছে। বৃ‌ষ্টিও অ‌নেকটা ক‌মে এসে‌ছে। আরিফ একটু পর অবাক হ‌য়ে খেয়াল করল, দরজার ওপা‌শে আর কোন ধর‌নের শব্দ আস‌ছে না। ওপাশটা‌তে পু‌রো নিরবতা। আরিফ ও‌দের প‌রিকল্পনাটা প‌রিস্কারভা‌বে বুঝ‌তে প‌ে‌রে‌ছে। ডাকা‌তেরা চুপ ক‌রে থাক‌লে বাইরের লোকজন কি ঘ‌টে‌ছে দেখার জন্য দরজা খুল‌বে। আর তখ‌নি ডাকা‌তেরা সু‌যোগ নি‌বে। আরিফ ও‌দের‌কে সাবধান ক‌রে দি‌লো। পার‌লে ট্রলারটা এখন ঘু‌ড়ি‌য়ে তী‌রে নি‌তে হ‌বে, তারপর পু‌লিশ‌কে খবর দি‌তে হ‌বে।
তখন ট্রলা‌রে থাকা আরো ক‌য়েকজন বলল, এই ডাকা‌তের লো‌কেরা সব পু‌লিশ‌দের কি‌নে রে‌খে‌ছে। পু‌লি‌শেরা ও‌দের কিছুই ক‌রে না। বরং যারা ডাকাত‌দের বিরু‌দ্ধে মামলা নি‌য়ে আসে, উল্টা তারাই ফে‌সে যায়। কিছু‌দিন আগে একটা ঘটনা ঘ‌টে‌ছি‌লো। এই গ্রা‌মের চেয়ারম্যান নি‌জে ও‌দের না‌মে মামলা ক‌রে‌ছি‌লো। ডাকাত‌দের ধরা তো দু‌রের কথা। কিছু‌দিন পর সেই চেয়ারম্যানই গুম হ‌য়ে গেল। তা‌কে আর খু‌ঁজেই পাওয়া যায় নি। তার প‌রে থে‌কে ও‌দের বিপ‌ক্ষে আর কেউ মামলা করার সাহসই পায় নি।
আরিফ বুঝ‌তে পা‌রে ও‌দের‌কে বিপ‌দে ফালা‌নো অনেক ঝা‌মেলার কাজ। এখন একটাই লক্ষ। ও‌দের‌কে এখা‌নেই শেষ ক‌রে দেয়া।
দরজার ম‌ধ্যে যে একটা ফু‌টো হ‌য়ে‌ছে সেটার ম‌ধ্যে চোখ রাখল। ভেত‌রে অন্ধকার। কোন ধর‌নের শব্দও কা‌নে আস‌ছে না। কি কর‌ছে ওরা? আরি‌ফের সন্দেহ হয়। আলী‌কে ব‌লে, দাদা। ভেতর দি‌য়ে কী পালা‌নোর রাস্তা আছে?
এমন সময় পেছন থে‌কে আলীর গলায় কে যেন দা দি‌য়ে চে‌পে ধ‌রে। আরিফ দেখ‌তে পায় সেটা আর কেউ না। জামাল শেখ। জামাল শেখ এইবার খু‌শি‌তে গদ গদ হ‌য়ে ব‌লে। এসে‌ছিলাম মাছ ডাকা‌তি কর‌তে। মনে ক‌রে‌ছিলাম দা‌-য়ের ব্যবহারটা করা লাগ‌বে না। কিন্তু এখন ম‌নে হ‌চ্ছে, কর‌তেই হ‌বে। আহ্! অ‌নেক‌দিন ধ‌রে মানুষ কো/পাই না। আজ‌কে একটু আমরা সবাই মি‌লে হ‌লি খেল‌বো। আরিফ চিৎকার দি‌য়ে বলল, দাদা‌কে কিছু ক‌রো না। ছে‌ড়ে দাও দাদা‌কে। জামাল শে‌খের লো‌কেরা সবাইকে ঘি‌ড়ে ফেলল। আরিফ দরজার সাম‌নে একা। জামাল শেখ ব‌লল, আজ‌কে তোর সাম‌নেই সবাইকে মার‌বো। তুই ম‌নে ক‌রে‌ছি‌লি আমরা পা‌তি ডাকাত, তোর কথায় আমরা ভয় পে‌য়ে যা‌বো। কিন্তু শু‌নে রা‌খো বাছা, ইদু‌রের গর্ত ভে‌বে তু‌মি সা‌পের গ‌র্তে পা দি‌য়ে ফে‌লে‌ছো। এখন এর ফল তোমা‌কে পে‌তেই হ‌বে।
আরিফের প্রচুর ভয় হ‌তে লাগল। আলীর গলায় দা ধ‌রে আছে ওরা। কী জা‌নি কী ক‌রে ফে‌লে। ও একটা জায়গায় দে‌খে‌ছি‌লো ডাকা‌তেরা চু‌রি করার আগে নেশা ক‌রে, যার কার‌ণে ও‌দের কোন ভা‌লো খারা‌পের জ্ঞান থা‌কে না। ওরা নি‌জে‌দের বাঁচা‌নোর জন্য যা ইচ্ছা তাই ক‌রে ফেল‌তে পা‌রে।
আরিফ বার বার জামাল শেখ‌কে ব‌লে যা‌চ্ছে, প্লিজ দাদার কিছু ক‌রো না। দাদা‌কে ছে‌ড়ে দাও তোমরা। কিন্তু জামাল শেখ কোন কথাই শুন‌ছে না। সে ওর চারজন সহকা‌রিকে বলল, ও‌দের‌কে ঘি‌ড়ে ধর। আজ‌কে খেলা জম‌বে ভা‌লোম‌তে।
ট্রলা‌রের বা‌কি লো‌কেরা নি‌জে‌দের জন্য ভয় পা‌চ্ছে না। তারাও আলীর জন্য ভয় পা‌চ্ছে। এই সময় আরিফ ব‌লে উঠল, ও‌দের থে‌কে আমরা সংখ‌্যায় অ‌নেক বে‌শি। আমরা সাহস ক‌রে চেষ্টা কর‌লেই ও‌দেরকে হাড়াতে পার‌বো। সাহস ক‌রে দেখ সবাই। ভয় পে‌য়ে গে‌লে ওরা আজ‌কে আমা‌দের মে‌রেই ফেল‌বে। আমা‌দের সাম‌নে একটাই রাস্তা। সেটা হ‌লো ও‌দের সা‌থে লড়াই করা।
জামাল শে‌খের মু‌খের আকৃ‌তিটা আবার পা‌ল্টে গেল। এখন কি বল‌বে সেই কথা সে‌ ভে‌বে প‌া‌চ্ছে না। এতো‌দিন জামাল শেখ কথার দ্বারাই মানুষ‌কে ভয় পা‌য়ি‌য়ে দি‌তো। কিন্তু আজ‌কে একটা ছে‌লে‌কে এতো ভয় দেখা‌নোর প‌রেও তার সাহস কম‌ছে না।
আরি‌ফের কথাটা যে পু‌রোটাই সত্য এই কথাটা ট্রলা‌রের সবাই উপল‌ব্ধি কর‌তে পার‌লো। ওরা বু‌ঝে গে‌ছে, ডাকাত‌দের থে‌কে বাঁচ‌তে হ‌লে লড়াই কর‌তে হ‌বে।
রা‌তের অন্ধকার এখ‌নো কাঁ‌টে নি। আকা‌শে এখ‌নো মে‌ঘের আনা‌গোনা চল‌ছে। মা‌ঝে মা‌ঝে ঘুন ঘুন বৃ‌ষ্টি পড়‌ছে। জামাল শেখ আরো ভয়ানক গলায় বল‌ছে, আজ‌কে তো‌দের সবাইকে মে‌রে ন‌দী‌তে ভা‌সি‌য়ে দি‌বো। এমন সময় আজাদ ভাই একটা প‌রিকল্পনা ক‌রে ফেলল। তার হা‌তে একটা বিশাল ব‌টি। আজাদ ভাই দৌ‌ড়ে গি‌য়ে জামাল শে‌খের পেছ‌নে এসে পড়ল। পেছন থে‌কে জামাল শে‌খের একজন সহকা‌রি জামাল শেখ‌কে ইশারা দেওয়ার সা‌থে সা‌থেই তি‌নি ‌পেছন দি‌কে ঘু‌ড়ে দাড়ান। আজাদ ভাই ভয় পান না, জামাল শেখ আজাদ ভাইকে দা দি‌য়ে হা‌তের ম‌ধ্যে একটা কোপ দি‌য়ে ফে‌লেন। আজাদ ভাই একটা চিৎকার দেন। কিন্তু তি‌নি থা‌মেন না। নি‌জের হা‌তের ব‌টিটা দি‌য়ে জামাল শে‌খের হা‌তেও কোপ দি‌য়ে ব‌সেন। আলী মুক্ত হ‌লে জামাল শে‌খের হাত থে‌কে দা-টা ছি‌নি‌য়ে নেয়।
আরিফের মু‌খে তখন আনন্দ। আরিফ উত্তে‌জিত হ‌য়ে বলল, আমি ব‌লে‌ছিলাম না? তোমরা সাহস ক‌রে ও‌দের সা‌থে এক হ‌য়ে লড়াই কর‌লে ওরা আমা‌দের কিছুই কর‌তে পার‌বে না।
সবাই যার যার অবস্থান থে‌কে তৈ‌রি হ‌য়ে নেয়। আজ‌কে মাছ বাঁচা‌নোর যুদ্ধ নয়। আজ‌কে পু‌রো এলাকা বাঁচা‌নোর যুদ্ধ। সবার হা‌তেই ব‌টি। জামাল শেখ নি‌জের হা‌তের দি‌কে তা‌কি‌য়ে দেখ‌লেন, পু‌রো হাত টকট‌কে রক্ত‌ে পি‌চ্ছিল হ‌য়ে গে‌ছে। তার হা‌তের দা-টা এখন আলীর হা‌তে। দা থে‌কে এখ‌নো টপ টপ ক‌রে রক্ত পড়‌ছে।
জামাল শে‌খের চারজন লোকও প্রচন্ডরকম ভয় পে‌য়ে‌ছে। ওরা বু‌ঝে গে‌ছে ও‌দের এতোগ‌ু‌লোর সা‌থে পারা যা‌বে না। জামাল শেখের চেহাড়ায় এতোক্ষন যে হিংস্রতা ছি‌লো, তা অল্প সম‌য়ের মা‌ঝেই বিলুপ্ত হ‌য়ে গেল।

বা‌কি চারজন সহকা‌রিদের ঘি‌ড়ে ধর‌লো সবাই। সবার হা‌তে ব‌টি দে‌খে ওরা প্রথ‌মে নি‌জে‌দের নৌকার দি‌কে দৌ‌রে পালা‌নোর প্রস্তু‌তি নিচ্ছ‌িলো, আর ওই সম‌য়েই আরিফ চিৎকার ক‌রে ব‌লে, ও‌দের‌কে ধ‌রে ফেল এখন। এটাই সময়। আরি‌ফের কথায় বা‌কি সবাই ও‌দের দি‌কে ছু‌টে গেল ধরার জন্য। ওরা য‌থেষ্ঠ ভয় পে‌য়ে‌ছে। প্রথ‌মেই সবাই ও‌দের হাত থে‌কে দা গু‌লো ছি‌নি‌য়ে নি‌লো, তারপর ও‌দের সবাইকে ধ‌রার পর কিছু দ‌ড়ি যোগার ক‌রে বেঁ‌ধে ফেলা হল। জামাল শেখ এক হাত দি‌য়ে আরেক হাতটা ধ‌রে আছে। অ‌নেক বড় একটা ক্ষত হ‌য়ে‌ছে সেটা বোঝাই যা‌চ্ছে। এখ‌নো ঝড় ঝড় ক‌রে রক্ত বের হ‌চ্ছে। আজা‌দ ভাইয়েরও একই অবস্থা। একটা কাপড় খু‌লে একজন আজা‌দ ভাইয়ের হা‌তের ক্ষত জায়গাটা‌তে বে‌ধে ফেলল। এতে রক্ত পড়া কিছুটা কমে‌ছে ব‌টে ত‌বে আজা‌দের শ‌রি‌র ক্রমশ দুর্বল হ‌য়ে আস‌ছে।

এদি‌কে আরিফ সবাইকে উদ্দেশ্য ক‌রে বলল, এখন তোমরাই ব‌লো, ও‌দের কি বিচার করা যে‌তে পা‌রে? অ‌নে‌কেই বল‌তে লাগল, কি‌সের আবার বিচার? বিচার জি‌নিসটা ও‌দের জন্য না। ও‌দের জন্য অনেক নিরপরাধ মানুষরা বিচার পায় নি। ও‌দের এখা‌নেই নি‌জে‌দেরই দা দি‌য়ে কু‌পি‌য়ে মে‌রে ফেলা হোক। তারপর যা হবার হ‌বে।
নৌকার ম‌ধ্যে আজ‌কে সবাই হিংস্র। ও‌দের চো‌খেও যেন আজ‌কে র‌ক্তের নেশা। অ‌নেক দি‌নের রাগ ও‌দের। সবাই সিদ্ধান্ত নিল এখ‌নি মে‌রে ফেল‌বে ও‌দের। তখন আরিফ জামাল শে‌খের কা‌ছে গি‌য়ে বলল, খুব তো ব‌লে‌ছি‌লি তোর খুব ক্ষমতা। এলাকার বে‌শিরভাগ মানুষ য‌দি আগেই তো‌দের ধ‌রতো, তো‌দের হাড়‌গোড় খুঁ‌জে পাওয়া যেত না। কিন্তু গ্রা‌মের সাধারণ মানুষগু‌লে সহজ সরল ব‌লে এতো‌দিন তারা কিছু ব‌লে নি। কিন্তু আজ‌কে আমরা চুপ ক‌রে থাক‌বো না। তো‌দের দে‌খি‌য়ে দি‌বো, ক্ষমতা আমা‌দেরও আছে। এখন ভা‌লোয় ভা‌লোয় ব‌লে ফেল, তোরা এলাকার চেয়ারম্যা‌নের সা‌থে কী ক‌রে‌ছিস? আমি নিশ্চিত যে তোরাই তার সা‌থে কিছু একটা ক‌রে‌ছিস।
জামাল শেখ বলল, আমি তার খবর জা‌নি না।
- এলাকার সবাই জা‌নে চেয়ারম্যান মাসুদ মিয়া যে‌দিন তো‌দের বিরু‌দ্দে থানায় মামলা দি‌তে গেল। তারপ‌রেই সে নি‌ঁখোজ হ‌য়ে গেল। এরকম ঘটনা এলাকায় অ‌নেক ঘ‌টি‌য়ে‌ছিস তোরা। জামাল শেখ তবুও কোন উত্তর দেয় না। আবার বৃ‌ষ্টির গর্জন শোনা যায়। ঝম ঝম ক‌রে বৃ‌ষ্টি না‌মে আবার। ট্রলা‌রের সবাই বৃ‌ষ্টি‌তে ভিঁজ‌ছে। গা বে‌য়ে পা‌নি গ‌ড়ি‌য়ে পড়‌ছে সবার। সবার দৃ‌ষ্টি জামাল শে‌খের দি‌কে। অথচ তার মু‌খে কোন কথা নেই। ঠান্ডায় এবং হা‌তের ব্যাথার কাঁপ‌ছে সে। হটাৎ ক‌রে বিকট আরেকটা বজ্রপাত হল। শব্দ শু‌নে বা আলোর ঝলকা‌নি দে‌খে ম‌নে হ‌লো এটা ঠিক ট্রলারের কিছুটা সাম‌নেই পড়‌লো। কিছুক্ষ‌নের জন্য সবাই যেন অন্ধ ও ব‌ধির হ‌য়ে গেল। সবাই মু‌খে একবার কা‌লেমা উচ্চারণ করল। জামাল শে‌খের চারজন সহকা‌রি ছোটার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা কর‌ছে। কিছুক্ষন প‌রে জামাল শেখ ট্রলা‌রের সাম‌নের দি‌কে তা‌কি‌য়ে চম‌কে গেল। সেই জায়গাটা‌তেই, যেই যায়গাটা‌তে বজ্রপাত হল কিছুক্ষন আগে। তারপর আচমকা সে ব‌লে উঠল, মাসুদ মিয়া। সবাই সে‌দি‌কে তাকাল। কেউ নেই ওখা‌নে। অথচ, জামাল শেখ বল‌তে লাগল, ওইতো! আমার দি‌কে এগি‌য়ে আস‌ছে। কিন্তু এটা তো সম্ভব না। মৃত মানুষ কিভা‌বে এখা‌নে আস‌বে? বৃ‌ষ্টির প‌রিমান আরো বে‌ড়ে‌ছে। চার‌দি‌কে আবার অন্ধকার। দূ‌রে কিছ‌ুই দেখা যা‌চ্ছে না। কেউ নেই ও‌দি‌কে। অথচ জামাল সেখ এখ‌নো ব‌লেই যা‌চ্ছেন, ও আমার দি‌কে এগি‌য়ে আস‌ছে। ওইযে,, ওর পু‌রো শ‌রি‌রে জাল পেঁচা‌নো। আমা‌কে বাঁচাও দয়া ক‌রে। ও আমা‌কে মে‌রে ফেল‌তে চায়। আমি আর এসব খারাপ কাজ কর‌বো না। আমা‌কে মাফ ক‌রে দাও। খুব ভয়ংকর দেখ‌তে ওর মুখ।
ট্রলা‌রের বা‌কি কেউ আশেপা‌শে কাউকে দেখ‌তে পা‌চ্ছে না। ত‌বে, আরিফ এবং আলীর ম‌নে একটা ভয়ানক খটকা লাগ‌লো। তারমা‌নে সেই জালটার সা‌থে জামাল শে‌খেরও কোন সম্পর্ক আছে? আলীও তো আগে ঠিক এরকমই কিছু দেখ‌তো যে, কোন এক ভয়ানক অবয়ব পু‌রো শ‌রি‌রে জাল পে‌চি‌য়ে আলীর সাম‌নে আস‌ছে। আলী বার বার তা‌কি‌য়ে দেখার চেষ্টা কর‌লো। তবুও আলী সে‌দি‌কে কিছুই খু‌ঁজে পেল না। কিন্তু জামাল শেখের ছটফটা‌নি থাম‌ছে না। তার বা‌কি চারজন সহকা‌রিও ভ‌য়ে চোখ লাল ক‌রে আছে। ওরাও ভে‌বে পা‌চ্ছে না যে সাম‌নে কী হ‌তে চ‌লে‌ছে। আরিফ আর আলী থ হ‌য়ে দা‌ড়িঁ‌য়ে আছে। ওরা ছাড়া জা‌লের খবরটাও কেউ জা‌নে না। আরিফ তখন আলী‌কে বলল, যে‌হেতু তোমার সা‌থে জামাল শে‌খের কথার একটা মিল পাওয়া যা‌চ্ছে তারমা‌নে জালটার সা‌থে জামাল শে‌খের কোথাও না কোথাও একটা মিল অবশ্যই আছে। জা‌লের সা‌থে সম্পর্ক আছে মা‌নে সেই জা‌লের ভেত‌রে থাকা মৃত মানুষগুলোর সা‌থেও কোন যোগসুত্র আছে। আর আরিফ জামাল শে‌খের কা‌ছে গি‌য়ে বলল, ভা‌লোয় ভা‌লোয় বল জা‌লের ভেত‌রের মানুষগু‌লো কারা? কেন ও‌দের দে‌খে ভয় পা‌চ্ছিস? আমি বু‌ঝে গে‌ছি তুই কিছু একটা ক‌রে‌ছিস। বল এবার। না বল‌লে এখ‌নি হাত পা বে‌ঁধে পা‌নি‌তে ফে‌লে দি‌বো।
জামাল শেখ এখনো দে‌খতে পা‌চ্ছে, তার সাম‌নে চেয়ারম্যান মাসুদ মিয়া। হ্যাঁ। সেই। তাছাড়া তা‌কে আর কেউ দেখ‌তে পা‌চ্ছে না। জামাল শেখ আরি‌ফের দি‌কে চোখ লাল ক‌রে তা‌কি‌য়ে বলল, এর ফল কিন্তু ভা‌লো হ‌বে না। আজ‌কে আমি কোনরকম বেঁ‌চে ফির‌তে পার‌লে তো‌দের আর রক্ষা থাক‌বে না। একটা একটা ক‌রে সবাইকে মার‌বো।
আরিফ একটা হা‌সি দি‌য়ে বলল, আর য‌দি বাঁচ‌তে না দেই। কী কর‌বি তখন? ভা‌লোয় ভা‌লোয় ব‌লে দে জা‌লের সা‌থে তোর সম্পর্ক কী।
আবার মুষলধা‌রে বৃ‌ষ্টি। এতো বৃ‌ষ্টি আরিফ আগে কখ‌নো দে‌খে নি। বৃ‌ষ্টিরও তাহ‌লে দুইটা রূপ। এটা রুপ ভা‌লো লাগার অনুভু‌তি জাগায়। ম‌নে প্রেম জাগায়। আরেকটা রুপ তাহ‌লে এইটা, ম‌নে হ‌য় যেন চার‌দিক থে‌কে জলরা‌শি জাপ‌টে ধর‌তে চায় তা‌দের। ম‌নে হয় যেন এখ‌নি শ্বাসরুদ্ধ ক‌রে মে‌রে ফেল‌বে এই বৃ‌ষ্টি।
একট‌ু প‌রেই দ‌লের একজন লো‌কের ভয়ানক চিৎকা‌রে হতবাক হ‌য়ে যায় সবাই। "ওইখা‌নে এতোগুলো মান‌ুষ কি‌সের?" সবাই তা‌কি‌য়ে দেখ‌লো। আস‌লেই। এইবার স্পষ্ট দেখা যা‌চ্ছে, পু‌রো ৬ জন মানুষ। তা‌দের চেহাড়াটা ভা‌লোভা‌বে দেখা যা‌চ্ছে না। জামাল শে‌খের আর্তনাদ যেন আবার শুরু হ‌লো। সে বার বার বল‌তে লাগ‌লো, "ছে‌ড়ে দে শয়তা‌নের বাচ্চা। আমার হাত থে‌কে তোরা কোনভা‌বেই বাঁচ‌তে পার‌বি না।" ত‌বে একটু প‌রেই বিদ্যুৎ চমকা‌নোর আলো‌তে ওদের মুখটা দেখা গেল। ওরা কারো মুখ ভা‌লোভা‌বে বুঝ‌তে না পার‌লেও একজ‌নের মুখ ঠিকই চিন‌তে পার‌লো। মাসুদ মিয়া। এলাকার চেয়ারম্যান। মুখ তার বিভৎস। যেন ম‌নে হ‌চ্ছে প‌চে গ‌লে গে‌ছে মুখটা।
জামাল শেখ সে‌দি‌কে তা‌কি‌য়ে থে‌কে আবার ভয় পে‌য়ে বলল, তারাতা‌রি আমা‌কে এখান থে‌কে বের কর হারামযাদা। যে‌তে দে আগে।
আরিফ তখন বুঝ‌তে পা‌রে। তখন জামাল শে‌খের আরো কা‌ছে গি‌য়ে ব‌লে, ও‌দের সা‌থে কি ক‌রে‌ছিস সেটা খু‌লে বল‌বি এখন। নইলে তো‌কে নি‌জের হা‌তে আমি শেষ কর‌বো। আরি‌ফের হা‌তে জামাল শে‌খের সেই দা-টাই। আরিফ বলল, এই দা‌য়ের ম‌ধ্যে যতগু‌লো মানু‌ষের রক্ত তুই লা‌গি‌য়ে‌ছিস, একে একে প্রতিটারই শোধ নেব। ভা‌লোয় ভা‌লোয় খু‌লে বল বল‌ছি।
জামাল শেখ সহ সবাই দেখল দূ‌রে ছয়জন ম‌ানুষ এখ‌নো দা‌ড়িঁ‌য়ে আছে। বাতা‌সে ট্রলার ঢুল‌ছে। এই বু‌ঝি উল্টে গেল। সবাই সেই লোকগু‌লোর দি‌কে তাকাল। ও‌দের অবস্থা আগের ম‌তোই আছে। ত‌বে ও‌দের দাড়া‌নোর ভ‌ঙ্গি দে‌খে বোঝা যায় তীব্র ক্ষোভ জ‌মে আছে ও‌দের ম‌ধ্যে। জামাল শেখ ও‌দের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল। আমিই মে‌রে ফে‌লে‌ছি চেয়ারম্যান‌কে। নি‌জের হা‌তে খুন ক‌রে‌ছি ও‌কে।
পু‌রো ট্রলার জু‌রেই যেন নিরবতা নে‌মে এলো। যেন কথাটা শু‌নে বাতাসও তার গ‌তি থা‌মিয়ে দি‌লো। জামাল শেখ বলল, সালা আমার সা‌থে পাঙ্গা নি‌তে আসে। আমা‌কে পু‌লি‌শের ভয় দেখায়। ও সালা জা‌নে না আমি কে। এক‌দিন ও আমা‌কে মারার জন্য গোপ‌নে শহর থে‌কে গুন্ডাও ভাড়া ক‌রে‌ছি‌লো। কিন্তু আমার লো‌কে‌দের কা‌ছে গুন্ডাটা ধরা প‌ড়ে। প‌রে ও‌র কথা শু‌নে জান‌তে পারলাম মাসুদ মিয়া-ই না‌কি এই কাজ ক‌রে‌ছে। ‌সে‌দিন বুঝ‌তে পারলাম এই চেয়ারম্যান‌কে আর টি‌কি‌য়ে রাখা চল‌বে না। এক‌দিন অন্ধকা‌রে মস‌জি‌দে নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় মাসুদ মিয়া‌কে ক‌য়েকজ‌নে অপহরণ করলাম। তারপর চোখ বেঁ‌ধে ও‌কে নি‌য়ে আসলাম নদীর পা‌রে। তারপর আর দে‌রি ক‌রি‌নি। শুধু ও‌কে ব‌লে‌ছিলাম, আমার পেছ‌নে লে‌গে বড্ড বড় ভুল ক‌রে ফে‌লে‌ছিস তুই।

সে‌দিন রা‌তে মাসুদ মিয়া‌কে মে‌রে ফে‌লে জামাল শেখ। নি‌জের হা‌তের দা- টা দি‌য়ে জবাই ক‌রে তা‌কে। র‌ক্তে আশেপাশটা ভ‌রে যায়। তারপর জামাল শে‌খের লো‌কেরা লাশটা‌কে একটা বস্তায় তু‌লে সেখা‌নে ক‌য়েকটা ইট দি‌য়ে বস্তাটার ম‌ুখ ভা‌লোভা‌বে বন্ধ ক‌রে। তারপর একটা নৌকা‌তে চ‌ড়ে বস্তাটা‌কে ন‌দী‌তে ফে‌লে দেওয়া হয়। যে জায়গাটায় জামাল‌ শেখ‌কে মারা হয় সেই জায়গার রক্তটাও কোদাল দি‌য়ে চে‌ছে পা‌নি‌তে ফে‌লে দেওয়া হয়।
কিন্তু ক‌য়েকজন মানু‌ষের কা‌ছে ঘটনাটা চো‌খের আড়াল হ‌লো না। ন‌দীতে মাছ ধরার সময় ৫ ভাই দূড় থে‌কে জামাল শে‌খের লোক‌দের পানিতে বস্তা ফেল‌তে দে‌খে স‌ন্দেহ ক‌রে ব‌সে।
পর‌দিন এলাকার চেয়ারম্যান‌কে না খু‌জে পে‌য়ে সবাই চিন্তায় প‌ড়ে যায়। সবাই আশেপা‌শে খোঁজার চেষ্টা ক‌রেও তা‌কে আর কোথাও খুঁ‌জে পাওয়া যায় না। একসময় স‌ন্দেহ করা হ‌তে থা‌কে জামাল শেখ‌কেই। কারণ কিছু‌দিন আগেই না‌কি মাসুদ মিয়া জামাল শে‌খের বিরু‌দ্বে মামলা ক‌রে‌ছি‌লো।
সন্ধ্যায় জামাল শেখ‌কে সা‌লি‌সে ডে‌কে আনা হয়। তারপর তা‌কে চেয়ারম্যা‌নের ব্যাপা‌রে নানান কথা জিজ্ঞাসা করা হয়। কিন্তু জামাল শেখ ব‌লে, আমি এস‌বের কিছুই জা‌নি না। নি‌জে ডাকা‌তি ক‌রি এটা সত্য। ত‌বে খুন-খারা‌পি‌তে আমার কোন হাত নেই। আপনারা শুধু শুধু আমা‌কে স‌ন্দেহ কর‌ছেন। তাছাড়া চেয়ারম্যান সা‌হে‌বের সা‌থে আমা‌রো ভা‌লো সম্পর্ক। আমি কেন তা‌কে মার‌তে যা‌বো?
- তোর সা‌থে চোয়ারম্যা‌নের সম্পর্ক ভা‌লো মা‌নে? মাসুদ মিয়ার সা‌থে তোর ভা‌লো সম্পর্ক কিভা‌বে হয়? উনি য‌থেষ্ঠ ভা‌লো মানুষ ছি‌লেন। আর ত‌ুই হ‌লি একটা চোর। আমা‌দের চেয়ারম্য‌নের সা‌থে একটা চো‌রের না‌কি সম্পর্ক আছে, সেটা মানা যায়? আমরা জা‌নি তুই মি‌থ্যে কথা বল‌ছিস। এখন বল, স‌ত্যিটা কি? কি ক‌রে‌ছিস মাসুদ মিয়ার সা‌থে?
আরেকজন ব‌লে, আমরা জা‌নি তুই ক‌তোটা মিথ্যাবা‌দি। তোর একটা কথাও আমা‌দের বিশ্বাস হয় না।
কিন্তু জামাল শেখ তবুও কোন কথা ব‌লে না।

চল‌বে....

Comments

Popular Posts