একটা ভালোবাসার গল্প

 অপেক্ষা
পর্ব ৭

তুই ছেলেটাকে মুখের উপরে না বলে দিলি? জানিস কতো খুঁজে তোর জন্য একটা ভালো ছেলে দেখেছিলাম। আর তুই কিনা... কথাগুলো বললেন আব্দুস সালাম। তার মুখে হতাশার ছাপ। মিতুর চোখ ভিঁজে আসছে। আব্দুস সালাম বলতে লাগলেন, এখন বিয়ে করবি না তো আর কবে বিয়ে করবি? তোর বান্ধবী তোর কাজিনরা এখনো বিয়ে করার বাকি আছে? আর এদিকে তুই ঘড়ে আইবুড়ো হয়ে বসে আছিস। মিতু এইবার সরাসরি কান্না করে দিলো। বলল, বাবা প্লিজ থামো। আমি এখন বিয়ে করবো না।
- তুই তো বড় হচ্ছিস। এখন তো তোর একটু বোঝা দরকার। তুই এভাবে ছেলেটাকে মুখের উপর না বলে দিলি। ছেলেটা কী মনে করবে এখন? আর বছরে কয়টা বিয়ের সম্বন্ধ আসে তোর? যত বড় হচ্ছিস তর বয়স্ক বয়স্ক ছেলেদের বিয়ে আসবে।

আব্দুস সালাম কথাগুলো মেয়েকে কোনদিনও বলতেন না। কিন্তু এখন বলতে হচ্ছে। যে জানে মিতু এখন ওর রুমে চলে যাবে। তারপর অনেক্ষন লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করবে। কিন্তু কথাটা তিনি না বলেও শেষমেশ পারলেন না। আসলেই মিতু সেদিন অনেক কান্না করল। তার জীবনটা আগে অনেক সাজানো গোছানো ছিলো। এখন তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। কোন পরিস্থিতিতে কী করবে সেটা বুঝে উঠতে পারে না সে। সেদিন রাতেও মিতু কিছু খেল না। মিতুর বাবা মিতুকে ডাক দিতে গিয়েও ফিরে আসেন। তার সাহস হয় না? নাকি লজ্জা লাগে? ভেবে পায় না সে। মাঝে মাঝে নিজেকেই বাবা হিসেবে ব্যার্থ মনে হয় তার। কী করেছে সে মেয়েটা জন্য? খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পায় না সে। হয়তো অনেক কিছুই করেছে। তবে মজার বিষয়, এই মুহুর্তে একটাও মনে পড়ছে না।

সকাল বেলা মিতুকে দেখা গেল। নাহ্। আব্দুস সালাম খেয়াল করলেন, তার মেয়ের মুখে অভিমানের ছাপ নেই। বেশ হাঁসিখুশিই আছে। সকাল বেলা মায়ের সাথে রান্নাবান্নায় সাহাজ্য করছে। আজকে ছুটি। তাই মিতু কিছুটা সময় পায় ঘড়টা গোছানোর। মিতুর ঘড়ে গোছানোর মধ্যেও তেমনটা কিছু নেই। তবে মিতুর ভাইয়ের রুমে আছে। অনেক কিছুই আছে। মিতু মাঝে মাঝেই তার ভাইয়ের রুমটা খোলে। তার জামাকাপড়গুলাও আলমারিতে সুন্দর করে সাজানো। জানালার পাশে ছাদ সমান উচু বুকশেলফ। বেশিরভাগই ইংলিশ লেখকদের বই। মিতু ইংলিশ অতটা পড়তে পারে না। তবে বইগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। কী সুন্দর বইয়ের মলাটগুলো। তার ভাইয়ের ঘড়টা সাজানো গোছানো। ভাইয়ের সব কিছু এই ঘড়ের মধ্যেই আছে। তবে ভাইটা নেই।
আজকে সারাদিন অনেক কাজ। এক সপ্তাহের কাজ এই দুই দিনে করতে হয়। কাপড়চোপড় ময়লা হয়ে আছে অনেকদিন ধরে। সেগুলো ধুয়ে দিতে হবে আজকে।
রাতে মিতু বিছানায় শুয়ে আছে। ক্লান্ত সে। প্রতি শুক্রবারে সে এই সময়টা একটু বই পড়ার সময় পায়। উপন্যাসের বইগুলো অনেকদিন ধরে পড়া হয় না। উপন্যাসের বই পড়া শুরু করলে সেটা নিয়মিত পড়তে হয়। অনেক দিন বিরতি দিলে সেই গল্পের চরিত্র, প্লট কিছুই মাথায় থাকে না। থাকলেও সেটা পড়ার ইচ্ছা থাকে না।
বিছানা থেকে উঠতেই ইচ্ছা করছে না কোনভাবেই। নাহ্। আজকে থাক। বই পড়ার মুড নেই তার। খেয়েদেয়ে একটু ঘুমাতে পারলেই যেন একটু শান্তি পাবে সে।

সময় আরো এগিয়ে যাচ্ছে। মিতু আস্তে আস্তে নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে। বিজয়কে সে বার বার ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অনেকটা পেরেছে সে। তবে কেন জানি বাজারের সামনে আসলেই তার ছেলেটার কথা মনে পড়ে। ছেলেটাকে এখনো সে দেখতে পায়নি। মিতু তারপরে আর খোঁজার চেষ্টা করে নি। আর কোথায় বা খুঁজবে তাকে?
একদিন সকালে মিতুর মাথায় ভালো একটা আইডিয়া আসলো। সেদিন শুক্রবার মিতু সকালবেলা বাইরে গেল। তার গন্তব্য সেখানে, যেখানে প্রতিদিন রিকসা ভাড়া দেওয়া হয়। কয়েকটি রিকসার দোকান আছে। মিতু প্রতিটা দোকানেই যাবে।
প্রথম সে যেই দোকানটাতে গেল, সেখানে বিজয়ের বর্ণনা দিল। সেখানকার মালিক জানালো, এমন অনেক ছেলেরা তো প্রতিদিনই আসে। কিভাবে খবর নিবে সে?
তবে একসময় মিতু রিকসা হাউজের সামনে পৌছালো। মিতু সেখানকার মালিককে বিজয়ের বর্ণনা দিল। নাম বিজয়। দেখতে অনেকটা ভদ্র ঘড়ের ছেলেদের মতো মনে হয়। ফর্সা। চুলগুলো লম্বা লম্বা করে কাঁটা।
সেখানকার মালিক বলল, এভাবে আপনাকে কার ঠিকানা দিবো বলুন তো? বিজয় নামের অনেক ছেলেই তো আমার কাছে আসে। আর আমি বয়স্ক মানুষ। অতো মানুষের খেয়াল কিভাবে রাখবো?
তাহলে কি শেষমেশ তার কাছ থেকেও কোন প্রকার সাহাজ্য পাওয়া যাবে না? মিতু ব্যার্থ হয়ে যখন ফিরে যেতে যাচ্ছিল। ওই সময় লোকটা মিতুকে পেছন থেকে ডাক দিলো। মিতু ঘুড়ে তাকালো। লোকটা বলল, আপনি যখন এসেছেন তবে আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। ছেলেটার নাম আমি কখনো জিজ্ঞেস করি নি। তবে ছেলেটা ফর্সা, দেখতে অনেকটা স্মার্ট। আপনার বর্ণনার মতোই। তবে ওর একটা জিনিস দেখে আমি অবাক হতাম। সেটা হচ্ছে, ছেলেটা রোজ প্রায় আটটার দিকে রিকসার জন্য আসতো। কিন্তু সারা দিন চালাতো না। দশটার সময়ই রিকসা জমা দিয়ে দিতো। আমি নিশ্চিত ছেলেটা নিয়মিত কোন একটা কারণে রিকসা নিত।
মিতু কিছুটা অবাক হয়ে বলল, এখন আসে না?
- অনেকদিন ধরে ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছি না। তবে আমি নিশ্চিত, ছেলেটা আসলে কোন রিকসাচালক না।
- ছেলেটার ঠিকানা জানেন?
- ঠিকানাটা তো তো জানা হয় নি।

সেদিন মিতু বাসায় এসে অনেক চিন্তাভাবনা করল। বার বার তার মনে হচ্ছে ওই ছেলেটাই বিজয়। যে রিকসা নিয়ে আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত রিকসা ভাড়া নিয়ে তাকে অফিসে দিয়ে আসতো। তাছাড়া আগে থেকেও তার কিছুটা সন্দেহ আছে। ছেলেটাকে দেখেও কোনভাবে রিকসাচালক মনে হয় না। এরকম দেখতে স্মার্ট ছেলে, যার কথাবার্তা এতো সুন্দর, সে কেন রিকসা চালাবে? আরো তো কতো পেশা আছে। মিতু এটাই বার বার ভাবে।

অনেক মাস পার হয়ে গেল। মিতু আস্তে আস্তে বিজয়ের সৃতি ভুলে যেতে আরাম্ব করল। ভোলাটাই স্বাভাবিক। মিতু চেষ্টা করেছে ভোলার। অনেকটাই সফল হয়েছে সে। এখন হয়তো বাজারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে আর সেই ছেলেটার অপেক্ষা করে না। এখন শুধু ছেলেটাকে চিরোতরে ভোলার অপেক্ষা। তবে সেটা হয়তো কখনোই সম্ভব না। থাকুক ছেলেটা তার সৃতির এক কোনে। অসুবিধা কী?

আব্দুস সালামের ঘড়ে আজকে আরেকজন মেহমান আসলেন। মিতুকে দেখতেই আসলেন। ছেলের বাবা একাই এসেছেন। মিতুকে দেখে অনেক পছন্দই করলো সে। ছেলেও ভালো চাকরী করে। মিতুর বাবা এইবার মিতুকে বলল, এইবার আর প্লিজ না বলিস না। রাজি হয়ে যা। এভাবে আর কতো সময় নষ্ট করবি? এরকম ভালো ছেলে তুই কি আর পাবি?
- আমি বিয়ে করে চলে গেলে তোমাদের কী হবে বাবা?
- কিছুই হবে না। আমাদের নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। আমরা ঠিকই ভালো থাকবো।
মিতু রাজি হয়। এইবার বাবার কথাটা সে ফালায় না। মিতু বলে, তুমি যেটা ভালো মনে করো। এখন আর তোমার ইচ্ছার বাইরে যেতে চাই না। আমি বিয়েতে রাজি আছি বাবা।
মিতুর বিয়ে ঠিক হয়। তবে মিতু এখনো ছেলেটাকে দেখে নি। আর ইচ্ছেও নেই। ভেবেছে সে দেখবে না। এমনকি ফোনেও কথা হয়নি একটিবারও।
রাইসা বলল, শুনলাম অবশেষে বিয়েতে রাজি হচ্ছিস?
- হ্যাঁ।
- আলহামদুলিল্লাহ। অনেকদিন পর একটা ভালো সংবাদ শুনলাম। তা তোর হবু জামাই দেখতে কেমন রে?
- দেখিনি।
- মানে? দেখিসনি কেন?
- ইচ্ছা হয় নি।
- তাই বলে তুই দেখবি না? ছেলে যদি পরে পছন্দ না হয়?
- তবে আর কী। তার সাথেই সংসার করতে হবে। জীবনটাই আর কয়দিনের?
- ধুর। তুই হয়তো মজা করছিস।
- নাহ। আমি কেন মজা করতে যাবো?

সেদিন বাসায় গিয়ে মিতু অনেক চিন্তা করলো। যার সাথে বিয়ে হবে তাকে কেন সে দেখবে না? না দেখেই বা লাভটা কী? যার সাথে সে সংসার করবে তাকে সে দেখবে না, তো আর কে দেখবে? মিতু তার বাবার কাছে গিয়ে বলল, ছেলের ছবিটা কোথায় বাবা? আব্দুস সালাম নিজের ফোন থেকে একটা ছেলের ছবি বের করে মিতুর হাতে দিলো। মিতুর বাবা বলল, ছেলেটা কিন্তু দারুন।


একরাম হোসেন ছেলেকে ফোন দিলেন। বিজয় ফোন রিসিভ করে বলল, কেমন আছো বাবা?
- আমি ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
- আছি ভালোই।
- কাল কখন রওনা হবি?
- খুভ ভোরে বাবা। এখন জিনিসপত্র গোচ্ছাচ্ছি। সকাল ৭ টায় ফ্লাইট।
- সাবধানে আসিস বাবা।
বিজয় ফোন রেখে দেয়। ব্যাগপত্র গোছায় নিজে। কালকে সকালেই সে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। ১৫ দিনের জন্য ছুটি নিয়েছে সে। এটাই অনেক। এই সময়টা দেশে যাওয়ার ইচ্ছা কোনভাবেই ছিলো না তার। বাবার কড়া আদেশ। যেকোনো ভাবেই এই কয়েকদিনের মধ্যেই দেশে আসতে হবে তাকে। কী আর করার আছে? ছুটি নিয়ে চলে আসতে হয় তাকে।
৭ টায় ফ্লাইট। বিমানে উঠে বার বার মিতু নামের মেয়েটার কথা মনে হল। কেমন আছে মেয়েটা? বিয়ে হয়ে গেছে কি? বিজয়ের কথা কি আর মনে পড়ে? তবে বিজয় মেয়েটাকে কোনভাবেই ভুলতে পারে নি। এখনো সেই মেয়েটার চেহাড়া মনে পড়ে। মনে পড়ে রিকসায় বসা অবস্তায় তার হাতের স্পর্শ। এগুলো কোনভাবেই ভুলে যাওয়ার নয়।

প্রথমবার যখন সে দেশে এসেছিলো তখন যে আনন্দটা হচ্ছিলো এখন সেরকমটা হচ্ছে না। সবটা যেন স্বাভাবিকই লাগছে। তবে একটা জিনিস বিজয়ের ভালো লাগল। এখন এখানে আষাঢ় মাস চলছে। বিজয় যখন বিমান থেকে নামল তখন আকাশটা মেঘলা। একটু হালকা হালকা বাতাস। দেশের মাটিতে নামার পর যেন মনের মধ্যে থাকা সকল পাথর নেমে গেল। মনটা হালকা হয়ে গেল অনেকটা। এখন নিজের বাড়িতে যেতে পারলেই যেন শান্তি। বাসে উঠে বসলো বিজয়। দেশের বাস সার্ভিসগুলো আরেকটু ভালো হওয়া দরকার। রাস্তার ধুলো, বাসের ঝাকি, একটু পরে মনে হয়, আগের জায়গাতে চলে গেলেই বোধয় ভালো হতো। অন্য সময় হলে হয়তো একটু ঘুম আসতো। এখন আসবে না। এভাবেই যেতে হবে।
বাসায় এসে বিজয় যেন নিজের প্রাণ ফিরে পেল। এসেই বাবাকে সালাম দিল। একরাম হোসেন ছেলেকে বুকে জরিয়ে ধরে বলল, কেমন আছিস বাবা?
- ভালো আছি বাবা।
- আয় ঘড়ে চল। অনেক ক্লান্ত হয়েছিস বোধয়।
- ক্লান্ত কখনোই হতাম না। ঢাকার বাসগুলোর যে অবস্থা। এই দুইটা ঘন্টা আমি কিভাবে আসলাম, আল্লাহ্ ভালো জানে। মাথা ঘুড়াচ্ছে অনেজ।
- তাহলে ফ্রেশ হয়ে নে। খেয়েদেয়ে কিছুক্ষন রেষ্ট নে। আয়।

খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম করে সে। একটু ঘুমানোর পর বিকেলবেলা বিজয় একটু ঘুড়তে বের হয়। জাভেদ, আরিফ ওরা কেউ নেই। পরিচিত মানুষ থাকলেও সময় কাঁটানোর কিছু নেই। জাম গাছটা সেই আগের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এখন আকাশ অনেকটা পরিস্কার। শীতের সময় সে যখন এসেছিল তখন আশেপাশে অন্যরকম একটা আমেজ ছিলো। এখন সেটা আর নেই। বাইরের অস্থায়ী দোকানপাট উঠে গেছে। একটু পর পর বৃষ্টি নামে। বিজয় রাস্তায় কিছুক্ষন হাঁটাহাটি করে। কয়েকজন লোক ডাক দিয়ে বলে, কী বিজয় ভাই? কেমন আছে। কবে এলে? এরকম প্রশ্ন। কিন্তু বসে কথা বলার সময় কারো নেই। সবাই ভয়ানক ব্যাস্ত। শহর নামের জিনিসটাই যেন তৈরি হয়েছে এই ব্যস্ততার জন্য।
সন্ধ্যার পরে আকাশে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকায়। গুর গুর করে ডেকে আকাশ কালো হয়ে উঠে। বিজয় আর দেরি না করে বাসার দিয়ে রওনা দেয়। আহ্, কী দারুন আবহাওয়া। এরকম জিনিস দেখতে যে কতটা ভালো লাগে। কাউকে কি বলা যাবে এই কথা? সবাই কাজের গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সবার তাড়াহুড়ো। কেউ কি এই ব্যস্ততার শহরে তার মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু এর সৌন্দর্য দেখার চেষ্টা করেছে? কী লাভ। তারা তো এমনটা প্রতিনিয়ত দেখে অভ্যস্ত।

ঘড়ে চলে আসে বিজয়। এসে দেখে একরাম হোসেন রান্না করছেন। বিজয় পেছন থেকে বলে, আমার কথা শুনছো না তাহলে। কতোবার বলি একটা কাজের লোকে রেখে নাও। টাকা পয়সার কী অভাব হচ্ছে? এভাবে পুরুষ মানুষ হয়ে রান্না করলে কেমন দেখা যায়?
- কে দেখে? কে আছে আর এই ঘড়ে?
- তবুও। আমি বাসায় কাজের লোক রেখে দিবো ভাবছি।
- কাজের লোক আর কতদিন রাখবি? বিয়েটা তো করতে বলি। এইবার আর তোকে বিয়ে না করে যেতে দিচ্ছি না। কথাগুলো বিজয় মাথা নিচু করে শোনে।
একরাম হোসেন বলে, বিয়েটা করলে আমি একটু রক্ষা পাই। বিজয় চলে আসে সেখান থেকে। এই মুহুর্তে তার বলার মতো কোন ভাষা নেই।

পরদিন সকালে বিজয় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে। তারপর রেডি হয়। একরাম হোসেন স্কুলে যাবেন। বিজয়কে রেডি হতে দেখে তিনি বললেন, কোথায় যাচ্ছিস?
- বাইরে। কিছুক্ষনের জন্য।
- গতবারের মতো পাগলামি করলে কিন্তু খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।
- না বাবা। কী যে বলো।

বাজারে অনেক্ষন বসে থাকল বিজয়। অফিসে যাওয়ার সময় হয়েছে মিতুর। এখনি তার আসার সময়। আসলে কী বলবে সে? কী বলার আছে আর? সে কি বলতে পারবে যে সে কোন রিকসাচালক নয়, এতোদিন তার সাথে সে মিথ্যা কথা বলেছে। মিতু কি সেটা মানবে? অনেক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলো বিজয়। কিন্তু শাড়ী পড়া মেয়েটার দেখা সে কোনভাবেই পাচ্ছে না। অফিসের সময় পার হয়ে গেছে। মিতু কখনোই এতো দেরি করে নি।
বাসায় চলে আসে সে। কোথায় গেল মিতু? বিজয়ের চোখের সামনে এখনো মেয়েটার চেহাড়া স্পষ্ট ভেসে উঠে। সারাদিন অনেক সুন্দর রোদ ছিলো আজকে। একরাম হোসেন বাসায় এসে দেখল বিজয় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। একরাম হোসেন বলল, তাহলে এতোদিনে বুদ্বি হয়েছে।
- কেন বললে কথাটা?
- ভেবেছিলাম রিকসা হকাচ্ছিস কিনা।
ল্যাপটপটা বন্ধ করে সেখান থেকে উঠে নিজের রুমে চলে যায় বিজয়। একরাম হোসেন আর কিছু বলে না। সে নিজেও খুব ক্লান্ত। ইদানিং বাচ্চাকাচ্চারা খুব জাঁলায়। মাথা হেট করে ছাড়ে। তার ভাবনা, বিজকে ভালোভাবে বিয়েটা করিয়ে দিতে পারলে স্কুলের চাকরিটা সে ছেড়ে দিবে।

সেদিন বিকেল বেলা বিজয় মিতুর অফিসের সামনে গেল। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকল। অনেক্ষন পরে অফিস ছুটি হলো। সবাই বের হচ্ছে আস্তে আস্তে। অনেক মেয়ে চারপাশে। তবে মিতু নামের মেয়েটাকে সে কোনভাবেই দেখতে পেল না। কোথায় গেল মেয়েটা। আজকে কি অফিসে আসে নি? নানান চিন্তা মাথায় আসতে লাগল। এমন সময় একটা মেয়ে কন্ঠের কেউ তার নাম ধরে ডাকল। বিজয় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটা অবাক হয়ে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
- আপনার নাম নিশ্চই বিজয়?
- হ্যাঁ। আপনি কিভাবে জানলেন?
- আপনি তো অই ছেলেটা, যেকিনা মিতুকে প্রতিদিন রিকসায় করে নিয়ে আসতেন। আপনাকে কিভাবে ভুলতে পারি। মিতু তো আপনার কথা সারাক্ষন বলতো।
বিজয় যেন কিছুক্ষন অবাক হয়ে রইল। তারপর বলল, মিতু এখন কোথায়?
- মিতু চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে।
- মানে?
- হ্যাঁ। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। শুনলাম বিয়ে ঠিকঠাক করা হয়েছে। তাই চাকরিটা আর করতে চায় না।

বিজয় চারপাশটা কেমন যেন অন্ধকার দেখতে লাগলো। মিতু নামের মেয়েটার বিয়ে। এটা বিজয় যেন কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না।
রাইসা আর বিজয় রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। রাইসা বলল, আপনাকে আমি মাঝে মাঝে খেয়াল করেছি। আপনি মিতুকে প্রতিদিন রিকসা করে অফিসে নিয়ে আসতেন। তবে আপনাকে দেখে আমার কোনভাবেই রিকসাওয়ালা মনে হয় না। প্লিজ আমাকে কী আপনার সঠিক পরিচয়টা বলবেন? বিজয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাইসাকে বলে, বলতাম। তবে এখন মনে হচ্ছে, এসব নিয়ে আপনার চিন্তা না করাই ভালো।
বিজয় চলে আসে সেখান থেকে। মনটা ভেঙে গেছে তার। সেদিন রাতে বিজয়ের ঘুম আসলো না। মিতু অন্য কারো বউ হতে চলেছে, সেটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন লাগছে। বার বার তার চেহাড়াটা চোখের সামনে ভাসছে।
মাঝে মাঝে বিজয় ভাবে, কেন যে সেদিন বন্ধুদের সাথে রিকসা চালানোর বাঁজি ধরলো। সেদিন বাঁজি না ধরলে হয়তো মেয়েটার সাথে কখনোই কথা হতো না। পরিচয়ও হতো না। সেটাই হয়তো তার জন্য ভালো ছিলো। সেদিন মিতু ঠিক কথাই বলেছিলো। একটা গাছ কচি বয়সেই ছেঁটে ফেলে দিতে হয়। যখন সেটা বড় হয়ে যায়। তখন সেটা কাঁটতে অনেক কষ্ট হয়। ভালোবাসাটাও তেমন।
পরদিন সকালে বিজয় নিজের ড্রয়ারটা খুঁজল। মেয়েটার বাসার ঠিকানা সে লিখে রেখেছিলো একটা কাগজে। সেটা খুঁজে পেল না সে। সমস্যা নেই। জায়গা মনে আছে। এক শুক্রবারে বিজয় মিতুদের বাসার সামনে গেল। বিজয় বাসার নিচে গিয়ে একটা জিনিস দেখে হতাস হয়ে গেল। মিতুদের বারান্দার গ্রিলে যেখানে মিতুর কাপড় ঝুলানো থাকতো সেখানে কিছু বাচ্চা ছেলের কাপড়। মিতুদের ফ্যামিলিতে তো কোন বাচ্চা নেই। তারমানে কি মিতুরা এই বাসা ছেড়ে দিয়েছে?
বাসার কলাপসিবল গেটে তালা দেওয়া। যাতে অপরিচিত কেউ ভিতরে না প্রবেশ করতে পারে। বিজয় আর অপেক্ষা করলো না। কী লাভই বা অপেক্ষা করে? কিছুদিন পরে তার বিয়েই হয়ে যাবে। দেখা করে মায়া বাড়িয়ে কোন লাভ আছে? চলে আসে বিজয়।
বাসায় আসার পর থেকে একরাম হোসেন খেয়াল করছেন তার ছেলের মন অনেকটা খারাপ। কিছুদিন ধরে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছে না। একরাম হোসেন ছেলের কাছে এসে বলে, তুই এখনো মনে হয় ওই মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করছিস। কিন্তু এভাবে কি জীবন চলবে?
বিজয় চুপ করে আছে। একরাম হোসেন বলল, এসব ভণ্ডামি বাদ দিয়ে নিজের জীবন ঠিক কর। তোর জন্য মেয়ে দেখেছি। এইবার আর তুই না বলতে পারবি না। মেয়ে অনেক সুন্দরী আছে।

বিজয় এর কোন উত্তর দেয় না। কোন প্রতিবাদ করতে চায় না। এখন থেকে সে চেষ্টা করবে নিজের পুরোনো অতীতগুলোকে ভুলে যেতে। একরাম হোসেন বুঝতে পারে ছেলের এখন বিয়ে করা ছাড়া কোন পথ খোলা নেই। একা থাকতে থাকতে সত্যিই খুব খারাপ লাগে এখন তার। বয়স দিন দিন বেড়ে চলছে। স্কুলে বাচ্চাদের পড়ানোটা যদিও আনন্দের কাজ মনে হয়। তবে এই বয়সে সেটা বিপদের কারণও বটে। ক্লাশে জোরে জোরে কথা বললে মাথার মধ্যে ব্যথা করে। এখন এই জীবন থেকে মুক্তি চায় সে। জীবনে অনেক কিছু করেছে সে। নিজেকে আয়নায় বৃদ্ব অবস্থায় দেখে মাঝে মাঝে আঁতকে উঠে সে। এইতো কিছুদিন আগেও সে তরুন ছিলো। বড্ড শক্তপোক্ত পুরুষ। এই কদিনে কী হয়ে গেল? অবসর। অবসরের পরের ধাপ কী? মৃত্যু? তাই তো মনে হয়।

বিজয় বিয়েতে রাজি হয়েছে। বাবার কাছে শিশুর মতো সে আবদার করে, আমার হবু বউকে কি দেখা যাবে না? ফটো নেই কোন? একরাম হোসেন হেসে বলেন, নাহ। ছবি রাখি নি। আর তোকে দেখাবোও না। দেখা করবি এক্কেবারে বাসর ঘড়ে।
- যদি পছন্দ না হয়।
শোন একটা কথা বলি। পছন্দ প্রথম প্রথম নাও হতে পারে। তবে তুই যখন বউয়ের সাথে সংসার করা শুরু করবি, তখন পছন্দ আস্তে আস্তে একাই হতে থাকবে।

চলবে....

Comments

Popular Posts