একটা ভালোবাসার গল্ল

 মিতু
পর্ব ৪

আজকে মিতুর উঠতে অনেকটা দেড়ি হয়ে গেল। কালকে রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় ১ টা বেজে গেছিল। ঘুম ভাঙতেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। অফিসের বেশি সময় নেই। তারাতারি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে হালকা একটু নাস্তা সেরে নিল। মিতুর মা সকালবেলা উঠে মেয়ের জন্য রান্না করে। মিতু আজকে কোনরকম খেয়ে রেডি হয়ে অফিসে চলে গেল। আজকে অফিসে একটা মিটিং আছে। উচিৎ ছিল একটু পরিপাটি হয়ে যাওয়া। কিন্তু পরিপাটি হতে গিয়ে দেরি হয়ে গেলে আরো ঝামেলা হয়ে যাবে। যাওয়ার আগে মাকে বলল, আসার সময় কিছু আনতে হবে? মিতুর মা মেয়েকে বলল, তরকারি একদম নেই। কিছু সবজি আনতে পারবি?
আচ্ছা বলে মিতু বাসা থেকে বের হয়ে গেল। বাসা থেকে বাজারে ৫ মিনিটের জন্য হেঁটে যায় সে। তারপর অফিস পর্যন্ত রিকসা নিতে হয়। আজকে কী ছেলেটা আসবে? কালকে ছেলেটার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। আজকে নাও আসতে পারে। নাকে ব্যথা পেয়েছে। যেতে যেতে কালকের ঘটনাগুলো মনে পড়তে লাগল। ছেলেটার অনেক সাহস। কিভাবে ছেলেগুলোকে মারল। মনে হয়না আর অই ছেলেগুলো রাস্তায় বিরক্ত করতে আসবে। ইদানিং মিতু ছেলেটার কথা একটু বেশিই ভাবছে। তাঁর কথা বলার স্টাইল, ছেলেটার হেয়ার কাট, দাড়ি শেভ করার স্টাইল দেখে মনে হয় না সে একজন রিকশাচালক। অন্যান্য চালকদের মতো করে সে রিকসা চালায় না। চালানোর গতি ধীর। যেন রিকসা চালানোতে ছেলেটা অপরিপক্ব। এক কথায় বলতে গেলে নিশ্চই একটা রহস্য আছে। কিন্তু মিতু সেটা ধরতে পারছে না।

বাজারের পৌঁছাল মিতু। একটু খোজার চেষ্টা করল ছেলেটাকে। এসেছে কি? আজ থেকে মনে হয় আর আসবে না। মিতুর কেন জানি খারাপ লাগতে লাগল। খারাপ লাগছে কেন? আশেপাশে কয়েকটা রিকসাও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সে উঠছে না। সে বিশেষ অই রিকসাটার অপেক্ষাতেই আছে। এমনিতে আজকে অফিসে দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। উচিৎ অন্য কোন রিকসাতে উঠে পড়া। মিতুর ইচ্ছে করছে না। তাঁর মনটা আজ কিসের জন্য যেন অনেকটা খারাপ হয়ে গেল। মনের মধ্যে যেন কালো মেঘে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু এমন লাগার কারণ মিতু বের করতে পারলো না।
আর কিছুক্ষন পরে মিতু খেয়াল করল, ছেলেটা আসছে। ওইতো। তাকেই খুঁজছে। মেঘের আড়াল থেকে যেন রোদের দেখা পাওয়া গেল। মিতু ছেলেটার রিকসার কাছে গেল। আজকে নতুন করে মিতু বলল, যাবেন?
বিজয় হাঁসি মুখেই বলল, আপনার জন্যই তো আসি। জানেন না সেটা?
মিতু আর কথা না বাড়িয়ে রিকসায় উঠে বসল। বলল, তারাতারি যেতে হবে আজকে। অফিসের অনেক দেড়ি হয়ে গেছে।
হুম, আজকে আমিও অনেক দেড়ি করে ফেলেছি। ভেবেছিলাম আপনি অন্য কোন রিকসায় চলে গেছেন। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম ব্যাপারটা উলটা। আপনি এখনো আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
- হয়েছে। তারাতারি চালান। আজকে দেরি হলে খবর আছে।
বিজয় দ্রুত রিকসা চালিয়ে যাচ্ছে। মিতু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা একটা শার্ট পরেছে। মুখে মাক্স পরা। মিতু নিরবতা ভেঙ্গে ছেলেটাকে প্রশ্ন করল, আপনাকে কিছুদিন সারাক্ষন মাক্স পরে থাকতে দেখছি। কারণটা একটু বলবেন?
- ওইতো রাস্তার ধুলোবালি থেকে বেঁচে থাকার জন্যই।
- ধুলোবালি? আমাদের এই এলাকায় আপনি ধুলোবালি পেলেন কোথায়? রাস্তা তো এক্কেবারে পরিস্কার।
বিজয় এরকম কথা আগে ভেবে দেখে নি। রাস্তায় ধুলোবালি আসলেই অনেকটা কম। বিজয় বলল, মাক্স পড়াটাই ভালো। ধুলোবালি না থাকলে কী হবে। ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া যে নেই, সেই কথা তো বলা যায় না।
- হয়েছে হয়েছে। তারাতারি চালান। আজকে অফিসে গেলে কী যে হবে আল্লাহ ভালো জানে।

অফিসের সামনে রিকসা এসে থামলো। মিতু নিজের ব্যাগ থেকে টাকা বের করে বিজয়ের কাছে দিতেই বিজয় বলল, থাক। আপনার কাছ থেকে আর টাকা নিবো না। কথাটা শুনে মিতু যেন আকাশ থেকে পড়ল। তারপর বলল, বলেন কী? আমার থেকে টাকা নিবেন না মানে?
- আপনি আমার অনেক দিনের পরিচিত। আপনার কাছ থেকে টাকা নেওয়াটা আমার ভালো লাগছে না।
- বাব্বা। অফিসের অনেক দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। আপনার মুখের মধুর কথা এখন শুনতে ইচ্ছে করছে না। টাকাটা রাখুন।
- না। আমি রাখতে পারবো না।
মিতু বিরক্ত হয়ে বলল, আচ্ছা বাই। পরে দেখা হবে।
মিতু অফিসে চলে আসলো। আজকে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল। অফিসে আসার পর মিতু জানতে পারল, অস্ট্রেলিয়া থেকে যে ক্লায়েন্ট আসার কথা, আজকে সে কোন এক কারণে আসতে পারে নি। তাই মিটিংটা কিছুদিনের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কথাটা জানতে পেরে তাঁর মাথা থেকে যেন হাজার টন পাথর সরে গেল। আজকে মিতু চেহাড়ার যে অবস্থা করে এসেছে, এতে অফিসের বস যে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে না এটাই অনেক। অফিসে মিতুর প্রিয় বান্ধবী রাইসা। মিতুর পাশে এসে বসল কিছুক্ষন। তারপর বলল, কীরে। এতো সুন্দরী মেয়ের চোখের নিচে এতো কালো দাগ কেন রে? রাতে ঘুমাস নি?
- নারে। রাতে ঘুমাতে পারি নি। বোনের বিয়েতে গিয়েছিলাম। অফিসে মিটিংয়ের কথা শুনে রাতেই এসে পড়তে হলো। বাসায় আসতে আসতে রাত বারোটা। যদি আগে জানতাম মিটিং ক্যানসেল। তাহলে আজকে ছুটিই নিয়ে নিতাম।
- তোর সব কাজিনদের তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এদিকে তুই কিন্তু সেই আগের মতোই রয়ে গেলি। কিরে, বিয়ে শাদী করবি না?
- কিছুদিন ধরে তুই বড্ড বেড়েছিস কিন্তু। আমাকে নিয়ে তোর নাক গলাতে হবে না। তুই নিজের চরকায় তেল দে।
- দিচ্ছি তো। অন্যদের চরকায় তেল কেন দিতে যাবো। তেলের দাম নেই বুঝি। বাই দ্যা ওয়ে, আমি কিছুদিন ধরে একটা জিনিস খেয়াল করছি। অনুমতি দিলে বলবো।
- বল।
- কিছুদিন ধরে দেখছি তুই একটা ছেলের রিকসায় করে নিয়মিত আসছিস। কে ছেলেটা? তোর বয়ফ্রেন্ড নাকি? রিকসায় করে নিয়ে আসে?
- ধুর, এসব কেন হতে যাবে। এদিকেই রিকসা নিয়ে আসে। তাই আমাকে নিয়ে আসে।
- তোকেই কেন প্রতিদিন নিয়ে আসে। আর কাউকে না নিয়ে। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগছে না কিন্তু।
- বা.. রে। এখানে তোর খারাপ লাগার কী আছে। কিছুদিন ধরে আসার কারণে পরিচয় হয়েছে। তাই প্রতিদিন আসি।
- হয়েছে, বুঝেছি। তবে ছেলেটা কিন্তু দারুন। দেখে রিকসাচালক মনে হয় না। আমি বিয়ে না করলে ছেলেটাকে গিয়ে প্রপোজ করতাম।

সন্ধ্যায় মিতু কিছু বাজার করে বাসায় আসলো। এসে গোছল করে নিল। তারপর কিছুক্ষন বই নিয়ে বসল। আজকে বই নিয়ে বসতে অনেক ইচ্ছে হল। অনেক দিন ধরে বসা হয় না। পড়তে ভালো লাগে না। আগে ভালো লাগতো। যখন তার ভাই বেঁচে ছিলো। হিমু, মিসির আলীর সাথে ছিলো তার গভীর পরিচয়। ঘড়ের কোণায় এখনো অনেক বই পরে আছে যেগুলা এখনো পড়া হয় নি।
- মিতু, ভাত খাবি না?
- খাবো মা। আসছি।
বইটা রেখে দিল। খাবার টেবিলে গিয়ে মাকে বলল, বাবা খাবে না? বাবা কই?
- তোর বাবা আর কই থাকবে। শুয়ে আছে বিছানায়।
মিতু রাগ দেখিয়ে বলল, বাবাকে কতো বলেছি সন্ধ্যাবেলায় শুয়ে না থেকে একটু হাঁটাহাটি করুক। এটা কী শুয়ে থাকার সময়?
- সেটা তোর বাবাকে গিয়ে বল। আমাকে বলছিস কেন?
মিতু বাবার রুমে গিয়ে তার বাবাকে বলল, তুমি আমার কথা শুনবে না বাবা তাই তো? তোমাকে না বলেছি, সন্ধ্যাবেলা শুয়ে থাকবে না। ইচ্ছা হলে বাইরে গিয়ে একটু ঘুড়ে আসবে। শরিরটা ভালো থাকবে।
- শরীর ভালো দিয়ে আর কি করবো রে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। শরীর তো এমনিতেই খারাপ হবে।
- তুমি একটা পাগোল। তুমি নিজে যদি মনে মনে ভাবো যে তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ তাহলে তুমি শীগ্রই বুড়ো হয়ে যাবে। আমরা মনে মনে নিজেকে যা ভাবি আমাদের শরীর তাই করার চেষ্টা করে।
মিতুর বাবা হেঁসে বলল, জানতাম না যে আমাদের ঘড়ে একটা বড় বিজ্ঞানী আছে।
- হয়েছে। আসো ভাত খাবো।
- তোর তো ইচ্ছা ছিলো বড় একজন ডাক্তার হবি। আমারদেরই ভুল ছিলো। তোকে ডাক্তারি পড়ালে ভালো হতো। আমার মনে হয় এতোদিনে তুই একটা বড় ডাক্তার হতে পারতি।
- হয়েছে বাবা। এসব নিয়ে কেন ভাবো। খোদা যা করে ভালোর জন্যই করে। জানো না এটা?
- জানি তো। আয়। ভাত খাই চল।

খেয়েদেয়ে ঘুমাতে যায় মিতু। বইগুলো আর পড়া হয় না। ঘুমানোর আগে বিজয় ছেলেটার কথা হঠাৎ করে মনে পড়ল। ছেলেটা স্মার্ট। তাহলে রিকসা চালাচ্ছে কেন? ছেলেটার কথা বলায় বোঝা যায় সে শিক্ষিত। তাহলে চাকরি না করে রিকসা চালানোর কারণ কি? মিতু এই হিসাবটা মিলাতে পারছে না। সেদিন রাতের কথা মনে পড়ছে অনেক। ওরকম কয়েকটা ছেলের সাথে একাই লড়ছিলো। নিশ্চই সে সাহসী। মিতুর অজান্তেই তার অন্তরে ছেলেটার জন্য একটা জায়গা হয়ে যাচ্ছে তা মিতু একটু একটু আন্দাজ করতে পারল। ইদানিং মাঝে মাঝেই চোখের সামনে সেই অচেনা ছেলেটার ছবি ভেসে আসছে। মিতু পরদিন তার সাথে কী কী আলোচনা করবে তা আগে থেকেই ভেবে রেখে দিচ্ছে। অনেক কথা ভাবে। কিন্তু সবগুলো আর মনে করে বলা হয় না। মিতু ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন আবার সকাল হয়। আবার অফিসে যায় এবং আবার তাদের দেখা হয়। অনেক আলাপ। মিতু হেসে হেসে কথা বলে। যেন তারা অনেক দিনের পরিচিত কোন বন্ধু। অনেক দিনের সম্পর্ক তাদের।

আজকে শুক্রবার। মিতু রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল সকাল নয়টা বাজে। রিকসার ক্রিং ক্রিং শব্দে মিতু স্তম্ভিত ফিরে পেল। ছেলেটা এসেছে।
- "আজকে শুক্রবার, তবুও আসতে বলেছিলেন যে।"
মিতু বলল, আপনাকে নিয়ে আজকে একটা জায়গায় যাবো। চলেন।
মিতু রিকসায় উঠে বসল। তারপর বিজয়কে বলল, চলুন।

সামনে বিশাল বড় একটা লেক। চারদিকটা সবুজ। লেকের পানি টলটলে। সবুজ প্রকৃতির স্পর্শ পেয়ে পানিও সবুজ রঙ ধারণ করেছে। একটা বেঞ্চের মধ্যে গিয়ে মিতু বসল। বিজয় এতোক্ষন মিতুকে অনুসরণ করে আসছিলো। মিতুর কাছে আসার পরে সে বলল, বসুন। বিজয় মিতুর পাশে অনেকটা দুরত্ব নিয়ে বসল।
মিতু বলল, জায়গাটা কেমন?
- দারুন। কতো সুন্দর প্রকৃতি। এমন জায়গায় খুব কম আসা হয়। আজকে আপনার জন্য আসতে পারলাম।
- এখানে কেন এসেছি জানেন?
- কেন?
- জায়গাটা আমার অনেক ভালো লাগে। যদি কখনো সময় পাই তাহলে এখানে চলে আসি। কতো সুন্দর ঠান্ডা বাতাস দেখেছেন?
- হুম। অনেক সুন্দর। তো আজকে আপনার সাথে আমাকে আনার কারণ কী?
মিতু কিছুক্ষনের জন্য হাঁসল। তারপর বলল, কিছু কথা ছিলো আপনার সাথে। বিজয় অবাক হয়ে বলল, কিসের কথা?
মিতু বলল, এইতো টুকিটাকি কিছু কথা।
- আচ্ছা। চেষ্টা করবো উত্তর দেওয়ার।
- কফি খাবেন?
- আপনার ইচ্ছা।
- তাহলে যান। ওই দোকান থেকে দুই কাপ কফি আনেন। আমার জন্য আর আপনার জন্য একটা। বিজয় চায়ের জন্য উঠল। পাশ থেকে মিতু বলল, আমার থেকে টাকা নিয়ে যান। বিজয় বলল, লাগবে না। কফির টাকাটা অন্তত আমি দিতে পারবো।

কফি খেতে খেতে মিতু বলল, আপনি লেখাপড়া কতদুর করেছেন?
- করেছি কিছু কিছু। গরীব মানুষ তো।
- আপনি মিথ্যা বলছেন। আমি কিন্তু বুঝতে পারছি।
- বুঝতে পারলে ভালো।
- মানে? আপনি আমাকে সত্য বলবেন না?
- এতো কথা বাদ দিন তো। আমি রিকসা চালাই। আমার জীবন নিয়ে আপনার এতো চিন্তাভাবনা কেন সেটাই বুঝতে পারছি না।
- তার মানে আপনি আমাকে বলতে চান না?
- ব্যাপারটা তেমন না। আমার জীবন নিয়ে কী আর বলার আছে।
- থাক। বলতে হবে না। চললাম। ভালো থাকেন।
মিতু কফির কাপটা পাশে রেখেই চলে যেতে আরাম্ব করল। বিজয়ের দিকে ঘুড়েও তাকালো না। মিতু রাস্তার কাছে গেল। পাশেই বিজয়ের রিকসা থাকা সত্যেও মিতু অন্য একটা রিকসা ভাড়া করে চলে গেল। বিজয় সেটা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। কফিটা অর্ধেক খাওয়া হয়েছে। বাকিটুকু কোনভাবেই খেতে ইচ্ছে করলো না বিজয়ের। ফেলে দিল।

বাসায় এসে মিতুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজকে ছুটির দিন। ইচ্ছা ছিলো কিছু কাজ করবে। কাজের লিস্টটা অনেক বড়। কিন্তু এই মুহুর্তে কোন কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। মিতুর মা এসে বলল, কোথায় গেছিলি? এসেই শুয়ে পড়লি যে? মিতু শুয়ে থেকেই বলল, ভালো লাগছে না মা।
- কী হয়েছে বল তো?
- শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। একটু ঘুমাবো।
- সকালে কিন্তু কিছু খেয়ে যাস কি। কিছু খাবি না।
- না।
মিতুর মা মেয়ের এমনটা দেখে একটু ভয় পেয়ে গেল। তার মেয়ে তো কখনো এভাবে এসেই শুয়ে পড়ে না। তবে মাঝে মাঝে, যখন মনটা অনেক খারাপ হয়ে থাকে। তার মা বোঝে এটা মন খারাপের শুয়ে থাকা। তবুও সে মিতুকে কিছু বলে না। ইদানিং মিতুকে কিছু বলাও যায় না। সে বড় হয়ে গেছে। তার মা খেয়াল করে তার মেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। এই কিছু দিন আগেও মিতু নামের মেয়েটা অনেক হাসিখুশি ছিলো। যখন তার ভাই বেঁচে ছিলো তখন তো সে এক্কেবারে বাচ্চাই ছিলো। সারাদিন বই পড়া, টিভিতে গোপাল ভাড় দেখা, এগুলাই ছিলো প্রতিদিনের রুটিন। তার ভাই ভার্সিটির টপ স্টুডেন্ট। এদিকে মিতুর অবস্থা মোটামুটি। মায়ের কাছে সারাক্ষন বকা খেতো মিতু। বলত, তুই নাকি ডাক্তার হতে চাস। বলি, এই মাথা নিয়ে তুই মেডিকেলে চান্স পাবি? পরিক্ষাই দিতে পারবি কিনা সন্দেহ। এদিকে মিতু কোন ভ্রুক্ষেপ করে না। সে ডাক্তার হতে চায়। তবে ডাক্তার না হতে পারলে যে জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে তেমনটা সে ভাবে না। মিতুর বাবা বলে, ওকে একটু আনন্দেই থাকতে দাও না। বিয়ে হয়ে গেলে কি আর এভাবে ছেলেমানুষি করতে পারবে? মেয়ে বড় হবে না?
একদিন তাঁর ভাইয়ের চাকরী হয়ে গেল। কী খুশী সবাই। মিতু ভাবল, যাক এবার মনের কিছু আশা পুর্ণ হবে। বাবা মা দুজনে তো অনেক খুশি। বিশেষ করে তার বাবা। জীবনে অনেক পরিশ্রম করেছেন তিনি। এখন সে হাঁপিয়ে গেছে। আগের মতো শক্তি আর নেই তার।
তবে বাবার হাঁসি বেশিদিন থাকলো না। চাকরী হওয়ার ১৭ দিনের মাথায় ভাই অনেক বড় একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেল। তার বাবা এই কথা কোনভাবে বিশ্বাসই করতে পারছিলো না। তিনিও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেলেন। মা-ও ভেঙে পড়লেন। মিতুও বুঝতে পারছিলো না যে কোথা থেকে কী হয়ে গেল। সেদিনের পর থেকে আর টিভিতে কার্টুন দেখা হয় নি। ছেলেমানুষি আচরণ সেদিনের পর থেকে চিরোদিনের জন্য বিদায় হয়েছিল তার জীবন থেকে। বই পড়া থেকে মনোযোগ সরিয়ে সে মনোযোগ দিল নিজের ক্যারিয়ারের দিকে। মিতুর লেখাপড়া কম। কোন চাকরি পাওয়াটা তার জন্য অনেক কঠিন। মিতুদের সংসারে যখন পুনারায় অভাব দেখা গেল তখন মিতুর এক বান্ধবী বলল, আমাদের কম্পানিতে কিছু গ্রাফিক্স ডিজাইনার নেওয়া হবে। তোর তো কাজ জানা নেই। তুই তিন মাসের একটা কোর্স করে নে। তারপর আমি বসকে বলে তোকে একটা চাকরির ব্যাবস্থা করে দিতে পারবো। সেই থেকে মিতুর জীবনটা পুরোপুরিভাবে পালটে গেল। মিতু ৩ মাসে গ্রাফিক্স ডিজাইনের একটা কোর্স শিখল। তারপর তার বান্ধবী কম্পানির বসকে বলে একটা চাকরির ব্যাবস্থা করে দিল। চাকরিটা পাওয়ার পর থেকে সে অনেক বড় হয়ে গেছে। তার চেহাড়া থেকে ছেলেমানুষি ভাবটা চলে গেল। মিতু নামের মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে এখন। কতদিন ধরে যে টিভিটা চালু করে না সে, সেটা মনেই নেই। বইগুলোও আর ভালোভাবে পড়া হয় না।

অফিসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে মিতু। মাকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলো সে। আজকে শীতটা একটু কমই পরেছে। আজকে বাজারে আসার পর মিতু আশেপাশে তাকিয়ে দেখল। তারপর দেখল বিজয় ছেলেটা রিকসা নিয়ে এসেছে। ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। মিতু একটু এগিয়ে গেল। ছেলেটা মিতুকে দেখে হাত দিয়ে ইশারা করল। তারপর মিতু যেটা করল সেটা দেখার জন্য বিজয় মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। মিতু তার পাশে থাকা একটা রিকসাওয়ালাকে বলল, যাবেন? শ্যামপুর রেলগেট?
মিতু অন্য একটা রিকসায় উঠে বসল। বিজয় অবাক হয়ে রিকসাটার দিকে তাকিয়ে রইল। মিতু যেন তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেল।
মিতু পেছনের দিকে একটিবারের জন্যও তাকাল না। অথচ বিজয় রিকসাটার পিছু করতে লাগল। পেছন থেকে বার বার রিকসার ক্রিং ক্রিং শব্দ কানে আসতে লাগল। তবুও মিতু তাকাচ্ছে না। একসময় রেলগেটের সামনে এসে থামলো রিকসাটা। মিতু রিকসা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে চলে গেল। বিজয়ও রিকসা থামালো। মিতুর দিকে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষন। মিতু জানে ছেলেটা তাকে ফলো করছে। কিন্তু তারপরেও সে ছেলেটার দিকে তাকালো না। এক্কেবারে সোজা অফিসে ঢুকে গেল।

"কীরে। আজকে ঠিক আছিস তো" রাইসা মিতুর দিকে ঝুকে বলল। মিতু বলল, হ্যা। ঠিক আছি। কেন রে, কী হয়েছে?
- আজকে দেখলাম অন্য একটা রিকসায় আসলি।
- এই। তোর কি সবসমই আমাকে নিয়ে গবেষনা করতে ভালো লাগে?
- ছেলেটা যে তোর পেছন পেছন আসলো? সেটার উত্তর কিভাবে দিবি?
- সর তো। আমাকে বিরক্ত করিস না। অনেকগুলা কাজ জমে আছে। এসব বলে আমার মাথাটা নষ্ট করিস না।
- ছেলেটা যে তোকে পছন্দ করে সেটা কিন্তু শিউর হয়ে গেলাম আমি।
- উফ। যাবি আমার এখান থেকে?
- আচ্ছা বাবা। আমি গেলাম। ভালোমতে কাজ কর। বাই।

অনেক কাজ মিতুর। তার উচিৎ ছিলো কাজগুলো কমপ্লিট করা। তবে একটু পরে বুঝতে পারল মিতু কোন কাজেই মনোযোগ দিতে পারছে না। মাথার মধ্যে ছেলেটার চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। তারমানে আসলেই ছেলেটা তাকে পছন্দ করে? নাহলে রিকসা নিয়ে এতো দূর ফলো করার কারণ কী? সত্যি সেদিন মিতু ভালোভাবে কাজ করতে পারলো না। মজার ব্যাপার কোন কারণ ছাড়াই তার হাত কাঁপছে। বুকের হার্টবিট বাড়ছে। তারমানে সেও সেই ছেলের মায়াজালে বন্ধি হয়ে যাচ্ছে। একটা রিকসাওয়ালা ছেলের প্রেমে পড়ছে সে। না। এভাবে কল্পনা করতে পারছে না সে। কিছুই ভালো লাগছে না আজকে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বার বার।
অফিস থেকে এসে মিতু ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিল। তারপর অনেক দিন পর আজকে সে টিভিটা চালু করল। অনেক দিন ধরে টিভি দেখা হয় না। এই কদিনে অনেকগুলো নতুন চ্যানেল এসেছে হয়তো। ভাবলো আজকে কার্টুন দেখবে। হ্যা। তাই করলো সে। একটা কার্টুনের চ্যানেল দিল। মা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে তোকে অন্য রকম লাগছে। এসেই তো কখনো টিভি দেখতে দেখি না। ভালো কোন শো আছে নাকি রে?
- হ্যা। আছে তো। দেখো। এটা কী কার্টুন? শার্কো?
- তারমানে তুই এখনো বড় হোস নি? আজকে থেকে বাচ্চাদের মতোন আবার কার্টুন দেখা শুরু করলি?
অন্য রুম থেকে মিতুর বাবা এসে বলল, তুমি চাও আমার মেয়ে এখনি আমাদের মতো বুড়ো হয়ে যাক? তেমনটা হবে না। আমার মেয়ে সারাজীবন আমার মেয়ের মতোই থাকবে। পিচ্চি। ছোট্ট। তা কী দেখছিস?
মিতুর বাবা মিতুর কাছে এসে বসলো। তারপর বলল, মিতুর মা। আমাদের তিনজনের জন্য তিন কাপ চা বানিয়ে আনো তো। আর মেয়েরটায় চিনি বেশি দিও।

চলবে....

Comments

Popular Posts