জাল পর্ব ০১
০১।
ঘড়িতে কেবল রাত নয়টা বাঁজে। তবে গ্রামে রাত নয়টা মানেই অনেক কিছু। মাঝে মাঝে এই রাতের বেলা কিছু কিছু বাড়ি থেকে ছেলেমেয়েদের চিৎকার করে পড়ার শব্দ ভেঁসে আসে। আবার কিছু কিছু বাড়ি থেকে ভেসে আসে কলকল শব্দের হাঁসির আওয়াজ। মাসুদ মিয়া সেই গ্রামের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। গ্রামের এদিকটায় হিন্দু লোক বাস করে। ধুপের মিষ্টি গন্ধ এখনো নাকে আসে। মাসুদ মিয়া হাঁটতে হাঁটতে একসময় শ্মশান ঘাটে এসে দাঁড়ায়। নাহ্। এখানে ভয় পাওয়ার মতো পরিবেশ নেই। আকাশে রুটির মতো চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের আলোতে গ্রামের পুর্ব পাশের বিশাল মাঠটা চকমক করছে। দূরে কয়েকটা গৃহস্থের ঘড়ের টিনের চালে সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে চোখে লাগছে।
অইতো দূরে কয়েকজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। তারা এগিয়ে আসছে। মাসুদ মিয়া তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। চাঁদের আলোতে তাদের মুখগুলো স্পষ্টই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তিনজন লোক। মাঝখানেরটা জামাল শেখ। কোন সাধারণ মানুষ সে নয়। তার চেহাড়া দেখলেই সাধারণ মানুষের বুক কেঁপে উঠে। দুধের শিশু-ও তার মুখ দেখে ভয়ে চিৎকার করবে হয়তো। ডাকাত সে। এলাকার সবচেয়ে বড় ডাকাত। আশেপাশের কয়েকটা এলাকায় তার বিশাল ক্ষমতা। জামাল শেখের দুই পাশে তার দুই অনুচর। দুইটার হাতেই লাঠি। যদিও এই রাতে তাদের হামলা দেওয়ার কোন পরিকল্পনা নেই, তবুও এই লাঠি তারা সবসময় সাথে রাখে। এটা তাদের একটা প্রতীক। এই লাঠি না থাকলে "ডাকাত" শব্দটার যেন অপমান হয়।
মাসুদ মিয়া এই এলাকার চেয়ারম্যান। এলাকার মানুষ তাকে ভালো বলেই জানে। সে থেকে বলা যায় যথেষ্ঠ ভালো মানুষই সে। কিন্তু সেই কথা কেউ খতিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করে নি। একটা মানুষকে সরাসরি ভালো বা খারাপ বলার কোন উপায় নেই। মানুষ মাত্রই বৈচিত্রময়। কোনদিকে সে ভালো। আবার অন্য কোন দিকে সে খারাপ।
জামাল শেখ এসেই দেখতে পারলেন মাসুদ মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। জামাল শেখ বললেন, চেয়ারম্যান সাহেব। এতো রাতে তলব করার কারণ কী? জানতে পারি?
মাসুদ মিয়া, নিজের দাঁড়ির মধ্যে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ইদানিং শুনছি নৌকায় ডাকাতি করছিস?
- হুম। ঠিকই শুনেছেন। আমরাই ডাকাতি করছি।
- এভাবে ডাকাতি করাটা কি ঠিক হচ্ছে তোদের?
- কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল এই জ্ঞান যদি আমাদের থাকতো তাহলে তো ডাকাত হতাম না।
- ভালোই তো মসকরা করছিস আমার সাথে। কিন্তু আশেপাশের এলাকার মানুষ তো আমার কাছে বিচার দিচ্ছে। ডাকাতি করছিস তুই। আর দোষ পড়ছে পুরো গ্রামের। ব্যপারটা কী ভালো দেখায়?
- চেয়ারম্যান সাহেব। আপনি তো জানেন। আমার দাদা ছিলেন বড় ডাকাত। বাবাও ডাকাতই ছিলেন। কিন্তু দাদার মতো না। আমরা দুই ভাই। দাদার মতোই হবো। আমাদের জীবনের মাঝখানে নাক গলানোটা আপনার কিন্তু মোটেও ঠিক হচ্ছে না।
- এর পরেও এসব খারাপ কাজ করলে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।
- বলি কী করবেন?
- অনেক কিছুই করতে পারি? ভালোয় ভালোয় বলছি সাবধান হয়ে যা। নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে তোদের সাথে।
- আমরা আমাদের পেশা ছাড়ছি না। আমরা শুধু দেখতে চাই আপনি কী করতে পারেন।
মাসুদ মিয়ার চোখ জ্বল জ্বর করছে রাগে। তবে জামাল শেখের মুখে এখনো যেন আনন্দ। যেন কোন একটা বিষয়ে সে অনেক মজা পেয়েছে। চকচক করছে চোখদুটো তার।
রাত বেড়ে যাচ্ছে। চাঁদটা আর কিছুক্ষন পরেই গাছের পেছনে লুকোবে। এখনি এখান থেকে চলে আসাটাই যেন মঙ্গল। জামাল শেখ যাওয়ার আগে বলে গেলেন, সাবধানে থাকবেন আশা করি। দুনিয়াদারি ভালো না।
.
ভাঙা একটা নৌকাতে বসে আছে আলী। কৃষিকাজ করে। তবে এখন মাঝে মাঝে জাল নিয়ে নদীতে মাঝ ধরতে যায়। মাঝে মাঝে নিজে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে। আবার বড় কোন বোট থেকে ডাক আসলে সেখানে চলে যায়। সেখান থেকে ভালোই পয়সা আছে। সে হিসেবে বলতে গেলে জীবনটা তার ভালোই চলছে। দিনে ও রাতে অফুরন্ত সময়। গল্প করতে পারে অনেকের সাথে। তবে তার সাথে নিজের বলে এখন কিছু নেই। আলীর স্ত্রী মরে গেছে প্রায় পাঁচ বছর হলো। একটা ছেলে আছে। লেখাপড়া করিয়েছিলো। শহরে চলে গেছে। আসে মাঝে মাঝে। বৃদ্ধ বাবাকে এসে মাঝে মাঝে দেখে যায়। টাকাপয়সা তো পাঠায় অনেক। টাকাপয়সা? এই জিনিসটা তো কেবল বাচ্চাদের স্বপ্ন আর প্রবীণদের ব্যবহারের জিনিস। যাদের বয়স শেষ, এক পা কবরে। তাদের অতোটা টাকাপয়সার প্রয়োজন নেই। তখন তাদের একটা জিনিসই প্রয়োজন, মানুষ। তারা মানুষ চায়। তারা চায় কেউ তাদের সাথে গল্প করুক, সময় দিক।
জালটা খানে খানে ছিঁড়ে গেছে। কিছু কিছু জায়গা দিয়ে মাছ বের হয়ে যায়। জালের সুতাগুলোও পুচপুচে হয়ে গেছে। নাহ্। এই জালকে এইবার ক্ষান্ত দিতে হবে। নতুন জাল কেনা ছাড়া উপায় নেই। কদিন এটা দিয়েই চালানো যাক আপাতত।
- আলি ভাই? আছো কেমন?
- আছি তোমাদের দোয়ায় ভালোই।
আজাদ। পরিচিত মানুষ। আলির সাথেই মাঝে মাঝে মাছ ধরে। বাজারে দেখা হয় দুজনের। একসাথে বোটে মাঝে মাঝে গল্পও চলে।
- মাছ এতো কম কেন আলী ভাই?
- আর বলো না। জালটা প্রায় ছিঁড়ে গেছে। এটা দিয়ে আর হচ্ছে না। ভাবছি, নতুন একটা কিনে ফেলবো।
- কী বলো। আমার একটা জাল আছে। ব্যবহার করি না। ঘড়েই ফেলে রেখেছি অনেকদিন। তাই বলি কী, তুমি অইটা নিয়ে যাও।
- কী বলো। তোমার জাল। আমি কেন নেব? ভেবেছি একটা কিনে ফেলবো।
- সেটা তোমার ব্যাপার। তবে জালটা অনেক সুন্দর। তুমি চাইলে একদিন দেখাতে পারি।
আচ্ছা, দেখবো। আমার মাছ বিক্রি শেষ হলে আমি চলে যাবো। একদিন সময় করে যাবো তোমাদের ওদিকে।
কিছুদিন পর আলী চিন্তা করলো এইবার জাল না কিনে আর হচ্ছেই না। পুরোনো জাল দিয়ে অর্ধেকের বেশি মাছ ফুটা দিয়ে বের হয়ে যায়। অর্ধেক মাছের দাম অনেক হতো। সামান্য একটা জালের জন্য এতো বড় একটা লস করা ঠিক হবে না। জালের দোকানে গিয়ে অনেক জাল দেখলো। কিছু জাল পছন্দ হলেও সুতা ভালো না। নাহ্। তারচেয়ে বরং আজাদের বাড়িতে গিয়ে ঘুড়ে আসা যাক। জালটা নাকি অনেক ভালো, দেখেই সে বুঝতে পারবে কেমন ভালো।
সেদিন সন্ধ্যায় আলী আজাদের বাড়িতে গিয়ে পৌছালো। আজাদ কিছুটা হাসার চেষ্টা করে বলল, তুমি আসবে, এটা আমি জানতাম।
- ভালো তো। তবে এটাও জানো যে কী কারণে এসেছি?
আজাদ বলল, আসো, ঘড়ে আসো। কিছু পানি-জল খাও। তারপর জাল দেখাচ্ছি।
আজাদ আর আলীর বয়সের মধ্যে অনেক তফাৎ থাকলেও তাদের জীবনটা যেন একই। আজাদেরও স্ত্রী গত হয়েছে অনেক বছর আগে। মৃত্যুর আগে একটা মেয়ে উপহার দিয়ে গেছিলো তাকে। নাঈমা। নাঈমা কি ফুটফুটে ছিলো? বলা যাচ্ছে না। বাবার মতোই একটু কালো সে।
আলী চা খেতে খেতে বলল, তোমার মেয়ে কেমন আছে?
- আছে ভালোই। চা-টা কেমন হয়েছে?
- ভালো।
- আমার মেয়েই বানিয়েছে।
- আচ্ছা এবার জালটা দেখাও দেখি কেমন।
একটা বস্তার মধ্যে ভাঁজ করে জালটা রেখেছিলো আজাদ। বস্তার দঁড়িটা খুলে আজাদ বলল, এই দেখো আমার জাল। আলী কিছুক্ষন জালটার দিকে তাকিয়ে রইল। জালটার সুতাগুলো অনেক সুন্দর। চকমক করছে। বাহ্। এমন জালই তো সে খুঁজেছে অনেক। এরকম জাল কি আর পাওয়া যাবে? আলী জালটা কিছুক্ষন হাতিয়ে দেখলো। যতবার দেখছে, ততবারই যেন জালটার মায়ার জড়িয়ে যাচ্ছে সে। আজাদ বলল, জালটা কী পছন্দ হয়?
- অনেক। পছন্দ হয়েছে ভাই। রাজি থাকলে নিতে পারি।
- কী বলো। দেওয়ার জন্যই তো দেখালাম।
- এরকম জাল বাজারে কতো খুঁজেছি, কিন্তু পাই নি। তুমি কোথায় পেলে?
- পেয়েছি কোথাও। সেটা জেনে তো আর তোমার লাভ নেই। পছন্দ হলে নিয়ে যাও।
আজাদের সাথে আরো অনেক্ষন কথাবার্তা বলার পর জালের বস্তাটার ভিতরে জালটা তুলে রওনা হলো নিজের বাড়ির দিকে। যাক! অন্তত মাছ ধরা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। বাড়িতে এসে নতুন জালটা নিয়ে আবার বসলো। জালের সুতাগুলো অনেক মোটা। সাধারণ কোন মাছ এই জাল ছিঁড়ে বের হতে পারবে না। তারপর, নিজের পুরোনো জালটা বস্তায় তুলে নতুন জালটা সাজিয়ে রেখে দিলো। পরদিন সকালেই সেই মাছ ধরতে বের হবে। একা মানুষ সে। সারাদিন একবার রান্না করলেই পুরো দিন চলে যায়। রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
পরদিন সকালে উঠে হালকা রান্নাবাড়া করে খেয়েদেয়ে জাল নিয়ে রওনা হয়। তার কাঁধে আজ নতুন জাল। আজকে নতুন করে মাছ ধরার উৎসাহ পায় সে। আশেপাশের কয়েকজন মাঝি আলীর জাল দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, কিপটেমি বাদ দিয়ে অবশেষে জাল তাহলে কিনেই ফেললে? দারুন হয়েছে। একটু দেখি তো। আলী একটু থেমে জালটা দেখায় সবাইকে। অনেক সুন্দর জাল। "কোথা থেকে কিনলে ভাই এইটা?"
- আমি কিনি নি। আমার এক বন্ধু দিয়েছে। নাম বলা যাবে না।
আলী জাল ফালায় নদীতে। একটু ভাঁড়ি জাল। যার কারলে একটু বেশি শক্তি খরচ করলে অনেক বড় জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে যায়। যাক, ভালোই। কয়েকবার জাল ফেলে ভালোই মাছ পেল আলী। দুপুর পর্যন্ত মাছ ধরল সে। খেয়েদেয়ে মাছগুলো বিকেলের হাটে নিয়ে যাবে। ভালো মাছ পেয়েছে সে। আজকের মাছগুলো বিক্রি করতে পারলে আগামী তিন দিন অনায়াসেই কেঁটে যাবে। একা মানুষ। সংসারে বেশি টাকার প্রয়োজন তার হয় না। সুস্থ সবল মানুষ সে। আল্লাহর দয়ায় কোন প্রকার রোগ ব্যাধি তাকে আক্রমণ করে নি। অসুধের পয়সা বেঁচে যায়। খাওয়াদাওয়া, টুকিটাকি কাজে পয়সা খরচ করা আর চায়ের দোকানে বসে সন্ধ্যায় গরম চায়ের স্বাদ নেওয়াটাই তার জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারাদিন পরিশ্রম করার পরে রাতে দারুন একটা ঘুম হয় আলীর। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে ঘুম। এমন মানুষ খুব কমই আছে। আবার সকালে উঠেই সে কাজের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সারাদিন মাছ ধরে। তারপর সেগুলো বাজারে নিয়ে যায়। আর রাতে ঘুম। এভাবেই চলছিলো আলীর জীবন। তবে একটা ঘটনা আলীর জীবনের পুরো মোড় ঘুড়িয়ে দিলো। এক রাতের ঘটনা। এবং সে রাতের পর থেকে আলী ভালোভাবে ঘুমাতে পারলো না। কী হলো সেই রাতে?
সারাদিন অনেক খাটুনির পর হালকা কিছু খেয়েদেয়ে বিছানার সাথে গা এলিয়ে দিলো আলী। বরাবরই আগের রাতের মতো ঘুম চলে আসলো তার চোখে। অনেক লম্বা একটা ঘুম। তবে হঠাৎ করে আলীর ঘুমটা কেন জানি ভেঙ্গে গেল। ঘুমের ঘোড়ে কারণটা সে ধরতে পারল না। তবে কিচ্ছুক্ষন পর যখন তার চেতনা আসলো, তখন সে একটা অবাক করা বিষয় খেয়াল করল। ঘড়ের কোনের যেখানটাতে জালটা রেখেছিলো, সেখান থেকে এক ধরনের আওয়াজ আসছে। কীসের আওয়াজ? আলী সেটা ভালোভাবে খেয়াল করার পর বুঝতে পারলো, সেটা যেমন তেমন আওয়াজ না। মানুষের কান্নাও আওয়াজ। বিছানা থেকে ধরাম করে উঠে বসলো আলী। এটা কিভাবে হতে পারে? হ্যাঁ। এখনো মৃদুভাবে কান্নার শব্দ ভেঁসে আসছে আলীর কানে। যেন মানুষ নয়। কিছু শেয়ালের দল যেভাবে দল বেঁধে চিৎকার করে ঠিক তেমনটাই। কান্নার শব্দ আরো ঘন হয়ে উঠে। জাল থেকে যেন শব্দটা বের হয়ে যেতে চাইছে। কী ভয়ানক সেই শব্দ।
সকালে ঘুম ভেঙ্গে যায় আলীর।
সকালে উঠে সে আন্দাজ করতে পারে না যে, গতরাতের ঘটনাটা কি আসলেই ঘটেছিলো নাকি পুরোটাই স্বপ্ন। আলী ভাবে, স্বপ্ন হবেনা তো কী? জাল থেকে আবার মানুষের কান্নার আওয়াজ আসবে কোন দুক্ষে? তবে আলীর কাছে পুরো ঘটনাটা মনে হচ্ছে, যেন রাতে সেটা বাস্তবেই ঘটেছিলো। কেন এমনটা হচ্ছে? সেদিনের স্বপ্নটার কথা ভেবে সে সেদিন কোন কাজেই মন বসাতে পারল না। আজকে সারাদিন সে মাছ ধরল না। জালটার দিকে তাকালেই রাতের সেই স্বপ্নের কথা মনে হয়। আলী জালটার উপরে হাত বুলায়। ভালো আগে। এই জালই তার রোজগারের মাধ্যম। আলী যখন ছোট ছিলো। তখন তার মা তাকে ছেড়ে চলে যায়। মারা যায় নি। ছেড়ে যায়। বাবার হাতেই সে মানুষ হয়েছে। তবে বাবার ভালোবাসাও বেশি দিন তার ভাগ্যে জোটে নি।
জাল যেন তাকে তার মায়ের মতোই ভালোবাসে। তাকে লালনপালন করে। মনে হয় এটাই যেন তার পরিবারের আপন কেউ।
আবার রাত হয়। আলী নিজে কিছু রান্না করে। বেশি রাত জাগে না সে। আশেপাশে অনবরত ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যায়। এখন গরম কাল। আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠে। যদি ঘুম না আসে তখন বাইরে গিয়ে আকাশের দিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে। চাঁদের দূরের সেই পাহারগুলো দেখে মনে হয়, একটা মানুষ। একটা গোলকের ভেতরে বন্দি হয়ে আছে। অইটা চাঁদের বুড়ি। অইখানে বসে বুড়ি নাকি সুতা কাঁটে। সে নিশ্চুপ। আলী সেটার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে। আকাশের তারাগুলোর দিকেও তাকায়। জ্বলজ্বলে তারাগুলোর মনে হয় প্রাণ আছে।
ঘুমে ঢলে পড়লে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। সাথে সাথে ঘুম।
গতরাতের মতোই আজকে রাতেও ভয়াবহ একটা ঘটনা ঘটল তার সাথে। আবার কান্নার শব্দ। কাদের কান্না? অনেকগুলো পুরুষের কান্না। শুনতে খুব ভয়ঙ্কর লাগে আলীর। বুক ধরফর করতে থাকে। এটা স্বপ্ন হতে পারে না। কান্নার শব্দ আরো বাড়ছে। একসময় আলী যেটা দেখলো, সেটা দেখার জন্য সে নিজে কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলো না। সেই নতুন জাল। সেটার ভেতরে কয়েকজন লোক। ছটফট করছে সবাই। যেন তারা আলীকে কিছু একটা বলতে চাইছে। আলী ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। আলী বিছানা থেকে উঠতে গেলেও সে খেয়াল করল, অদৃশ্য কোন একটা শক্তি তাকে যেন বিছানায় টেনে ধরে আছে। জাল থেকে এখনো আগের মতোই শব্দ হচ্ছে। আস্তে আস্তে জালসুদ্ধ সেই মানুষগুলো আলীর কাছে আসতে লাগল। অনেক কাছে। আরো কাছে। কী ভয়ানক সেই লোকগুলোর চেহাড়া। এর পরের ঘটনা আর তার মনে নেই। কী হয়েছিলো এর পরে?
পরদিন সকালে আলীর ঘুম ভাঙে। আবার সবকিছুই স্বাভাবিক। রাতের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা আজকেও স্বপ্নের মতোই মনে হচ্ছে। তবে আলীর মনের মধ্যে অন্যরকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। টানা দুই দিন একই স্বপ্ন আসা তো স্বাভাবিক না। নিশ্চই এর পেছনে অবশ্যই কারণ থাকার কথা। স্বপ্ন সে অনেক দেখে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত অদ্ভুত সব স্বপ্নও দেখে। তবে এই স্বপ্নটা তার কাছে একটু ভিন্ন। রাতের ঘটনাটাকে স্বপ্ন মনে হয় না। বাস্তবের মতোই মনে হয়। একবার ভাবল, মসজিদের হুজুরের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করার দরকার।
পরদিনের ঘটনাটা ছিলো আরো ভয়ানক। আলী বিছানায় শুয়ে আছে। সে নিজের হাত-পা-গুলোও নাড়াচাড়া করাতে পারছে না। শুধু চোখের সামনে সব কিছু ঘটে যাচ্ছে। জালের ভেতরে কয়েকজন মানুষ। ৫-৬ জনের মতো হবে। মানুষগুলো সেখানে ছটফট করছে। চিৎকার করে কান্না করছে। তারা আলীর দিকে জালসুদ্ধ এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। একসময় সে জালটা আলীকেও জড়িয়ে ফেলল। বড্ড খারাপ লাগে তার। এরপরের ঘটনা তার আর মনে থাকে না। পরেরদিন সকালে উঠেই আবার সব কিছুই ঠিক। জালটাও ঠিক আগের জায়গায়। আলী বাস্তব আর স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পায় না। নাহ্। এভাবে আর কতদিন? এরকমটা কেন হচ্ছে তার সাথে? আগে তো মোটেও কখনো এরকমটা হয় নি। আলীর চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। সকালে বড্ড ঘুম ঘুম লাগে। তারমানে কি রাতে তার ঘুম হয় না? সারা রাত জেগে থাকে? তারমানে রাতে যেই ঘটনাগুলো ঘটে। সেগুলো কি বাস্তবেই ঘটে? হিসাব মিলাতে পারে না সে। কিছুদিন ধরে জাল ফেলছে না সে। জালটার দিকে তাকালে রাতের ভয়ঙ্কর সেই ঘটনাগুলোর কথা মরে পড়ে। তিন দিন ধরে জালটা একই ভাবে পড়ে আছে। চুল পরিমানও সরেনি। এর থেকে বলা যায়, রাতের ঘটনাগুলো একেকটা স্বপ্ন।
- আচ্ছা, গ্রামের এদিকে আলীর বাড়ি কোন দিকে?
সাদা তুলোর মতো চুলওয়ালা একটা লোক জবাব দিলো, মাছ ধরে সেই আলী? তার সাথে তোমার কাজ কী?
- আমি তার নাতি?
- বলো কি। আলীর নাতি এতো বড় হয়ে গেছে, আমরা কিছুই জানি না। তা কেমন আছো বাবা?
- আছি ভালো আপনাদের দোয়ায়।
- তোমার বাবা-তো অনেক দিন ধরে আসে না। তবুও মাঝে মাঝে আসতো। কিন্তু তোমাকে তো দেখিনি আগে।
- হ্যাঁ। আগে কখনো গ্রামে আসিনি। এই প্রথম আসলাম। বলতে পারেন এটা আমার জীবনের একটা নতুন অভিজ্ঞতা।
- গ্রামে এসে অনেক কিছু শিখতে পারবা। আচ্ছা বাবা। অনেক দূর থেকে এসেছো। ওইযে, একটা বড় নারিকেল গাছ দেখতে পাচ্ছো না? অইটা তোমাদের গাছ। সোজা রাস্তা ধরে গেলে বুঝতে পারবে।
- আচ্ছা। ভালো থাকবেন।
ছেলেটার নাম আরিফ। আলীর একটা ছেলে ছিলো। রফিক উদ্দিন। তার ছেলেই আরিফ। রফিক লেখাপড়ার জন্য ছোটবেলায়ই শহরে চলে গেলে আলী বড্ড একা হয়ে যায়। মাঝে মাঝেই আসত রফিক। বছরে দু একবার। একসময় সেখানেই বিয়ে করে ফেলে রফিক। বিয়ের পরে আসার পরিমান আরো কমে গেল। শহরের বৌ গ্রামের ভাঙ্গা ঘড়ে থাকবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই আসে না। ছেলেকেও আসতে দেয় নি এতোদিন।
কিন্তু আরিফ এখন বড় হয়েছে। নিজের যে একজন দাদা আছে এবং সে তাকে কোনদিন দেখতে পায়নি, এটা ভেবেই তার বড্ড খারাপ লাগে। ভার্সিটির ছুটির ফাঁকে তাই সুযোগ নিয়ে গ্রামে চলে এসেছে সে। তবে বিষয়টা তার বাবা-মা জানে না। বাসায় ট্যুরের কথা বলে এসেছে। আরিফ গ্রাম নিয়ে যতোটা ধারণা মনে করেছিলো ততটা মিলছে না। সারাজীবন বই পত্রে পড়েছে গ্রামের কথা আর ইউটিউবের ভিডিওতেই দেখেছে। গ্রামের মাটির ঘ্রাণটা তো আর বই বা ভিডিওতে পাওয়া যায় না।
নারিকেল গাছটাকে অনুসরণ করে সে এগিয়ে যাচ্ছে। এইতো আরেকটু দূরে। হ্যাঁ। ঘড় দেখা যাচ্ছে। টিনের ঘড়। অইটাই তার দাদার বাড়ি। শুধু দাদার বাড়ি বললে ভূল হবে, এটা তো তার নিজেদেরই বাড়ি। তার শেকড় পোঁতা এখানেই। তারাই তো সেই শেকড় ছিঁড়ে শহরে চলে এসেছে।
আরিফ ঘড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কী বলে ডাকবে এই ঘড়ের মানুষকে? তাকে কি চিনতে পারবে? এসব ভাবতে ভাবতেই একসময় প্রায় বৃদ্ধবয়স্ক একটা লোক ঘড় থেকে বের হয়ে দেখল, সামনে একটা ছেলে। গায়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কাপড়। আলীর চিনতে একটু ভুলও হল না। ছেলেটার চেহাড়া তো পুরোপুরি রফিকের মতো। চিনতে কিভাবে ভূল হতে পারে? আলী ছেলেটার দিকে অনেক্ষন হা করে তাকিয়ে রইল।
ছেলেটা বলল, ভালো আছো দাদু?
আলী কী বলবে সেই ভাষা খুঁজে পেল না। চোখ ভিঁজে আসে। আজকে চোখের সামনে তার নাতিকে দেখতে পাচ্ছে। আলী ছেলেটার কাছে আসল। কেমন আছো দাদু?
- ভালো আছি।
- এখন আমাকে মনে হলো?
- অনেক মনে হতো। আসতে চাইতাম। কিন্তু আজ এসেই পড়লাম।
- খুব ভালো করেছো দাদু। আজকে আমি অনেক খুশি হয়েছি। ঘড়ে চলো। অনেক দূর থেকে এসেছো। একটু বিশ্রাম করে খাওয়াদাওয়া করো।
চলবে....
Comments
Post a Comment