জাল পর্ব ০২
০২।
খেয়েদেয়ে হালকা একটু বিশ্রাম নেয় আরিফ। গ্রামটা শহর থেকে অনেক দূড়ে। বিকেল হয়ে এসেছে। আরিফ বিছানা থেকে উঠে দেখে আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি আসবে হয়তো। ঘড় থেকে বের হয়ে বাইরে যায় সে। বাহ! গ্রামের এই দৃশ্য-র চেয়ে সুন্দর জিনিস সে আর কোথাও দেখেছে বলে মনে পড়ে না। আরিফ কিছুক্ষনের জন্য স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে যায়। সেইসময় পেছন থেকে আলী ডাক দিয়ে বলে, জোরে বাতাস বইছে। তুফান আসবে। ঘড়ে চলে আয়। আরিফ বলল, দাদা, অনেকদিন ধরে বৃষ্টিতে ভিঁজি না। আজকে একটু ভিঁজতে চাই।
আলী সতর্ক গলায় বলল, এসব বৃষ্টিতে ভিজতে হয় না। বাঁজ পড়বে জোরে জোরে। গতবারও দুজন মানুষ মরেছে বাঁজ পড়ে।
আরিফ ঘড়ে চলে আসে। ঘড়ে চলে আসা মাত্রই ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়া আরাম্ব হয়। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে প্রচন্ডভাবে। আলীর ধারণাই ঠিক হলো। তুমুলবেগে বৃষ্টি এবং সাথে বজ্রপাত। কারেন্ট চলে গেছে। ঘড়ে অন্ধকার। অন্ধকার ঘড়ে কেবল দুজন মানুষ। আজকেই তাদের প্রথম দেখা। অতোটা পরিচয় নেই তাদের মধ্যে। তবে সম্পর্কটা রক্তের।
"দাদা, এভাবে একা একা থাকতে তোমার সমস্যা হয় না?" আরিফ কিছুটা চিন্তিত গলায় বলল। বাইরে টিনের চালের কিছু অংশ বাতাসে ঝাপটাচ্ছে। আলী ঠান্ডা গলায় বলল, সমস্যা তো হয়ই। একা একা থাকতে আর কারই বা ভাল্লাগে? সময়টা কোনরকম ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে পাড় করার চেষ্টা করছি। এগোতে চায় না।
- আমাদের সাথে শহরে যাবে?
- শহরে গেলে কী সব সমস্যার সমাধান হবে?
- আমি তবু গ্রামের মুক্ত হাওয়ায় ভালোই আছি। তোরা শহরের চার দেয়ালে আটকে থেকে কী পাস? আজকে দেখছিস না? বৃষ্টি হচ্ছে। কালকে সকালে ইনশাল্লাহ্ জাল নিয়ে বের হবো। অনেক মাছ পাওয়া যাবে কাল। নতুন পানি। মাছও খুশি, আমিও খুশি। কালকে আমার সাথে মাছ ধরতে যাবি?
পরদিন আরিফ তার দাদার সাথে বের হল। আলীর কাঁধে সেই জালটা। আজকে তার মনে কোন চিন্তা নেই। জালটা নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা সে ভুলেই গেছে। আরিফ আশেপাশে তাকিয়ে দেখে। পরিবেশটা চকচক করছে। সাথে ঠান্ডা বাতাস। কয়েকটা পুকুরে বিশাল বিশাল হলুদ ব্যাঙ ডেকে যাচ্ছে। আরিফ ভাবে, আগে পৃথিবীটা মানেই সে মনে করত, বিশাল বিশাল দালান, পাকা পিচের রাস্তা, ধুলা, আর বিশাল বড় বড় মার্কেট। কিন্তু এখানে এসে তার মনে হচ্ছে, সে অন্য একটা জগতে চলে এসেছে। নদীতে গিয়ে জাল ফেলে আলী। আলীর জাল ফালানো দেখে আরিফ কিছুটা অবাক হয়। এরকম করে টিভিতে জাল ফেলতে দেখেছে সে। বাস্তবে দেখা হয়েছিলো না। আজ হলো। আলী কিছুক্ষন পর জালটা আস্তে আস্তে টানা আরাম্ব করল। আরিফ হা করে জালের দিকে তাকিয়ে আছে। আলী যখন জালটা তুলল, আরিফ অবাক হয়ে দেখলো, মুক্তোর মতো মাছ চকচক করছে। অনেক মাছ। তার দাদার মুখে হাঁসি। আরিফকে ডেকে বলল, দেখেছিস, কতোগুলো মাছ এসেছে? রাতে বলেছিলাম না, অনেক মাছ আসবে। আরিফ এতো কাছ থেকে মাছ ধরা আগে দেখেনি। এই প্রথম। আলী কয়েকবার জাল ফেললেন। তারপর আরিফকে বললেন, এইবার এগুলা মহাজনের কাছে বিক্রি করবো।
আজকে সারাদিন আরিফ আলীর সাথেই ছিলো। দিনটা অনেক সুন্দর কেঁটেছে। আজকে অনেক নতুন নতুন জিনিস শিখেছে সে। সারা জীবন শহরের বড় লোকের ছেলেদের মুখ থেকে শুনে এসেছে গ্রাম অঞ্চলের দুর্নাম। তবে আজকে মনে হলো, গ্রাম ঘুড়ে না আসলে ব্যাপারটা মোটেও বোঝা যায় না। এখন আরিফ বুঝতে পারে তার দাদা কখনোই গ্রাম ছেড়ে শহরে যাবে না। এখন তো নিজেরই যেতে ইচ্ছে করছে না। তার শেকড় তো এখানে। তার পুর্বপুরুষেরা এই মাটিতেই বড় হয়েছে, এই মাটিতেই তারা শুয়ে আছে। তার বাবাই এই শেকড় ছেড়ে বাইরে এসেছে। বাবার প্রতি সামান্য রাগ হয় তার। এই অঞ্চলে আলীর মতো অনেক মানুষ। কী সুন্দর তাদের জীবন। একসাথে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কাজের সময় মন দিয়ে কাজ করছে। কত অবসর সময় তাদের। মাছ বিক্রি করে কিছু টাকা পায় আলী। সেই টাকা দিয়ে বাজারে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করে। তার নাতি এসেছে। যতদিন সে আছে ততদিন ভালো কিছুই রান্না করে যেতে হবে। আরিফ একবার বলল, আমার নানু মারা গেছে অনেক আগেই। তখন তুমি ইচ্ছা করলেই বিয়ে করতে পারতে। কিন্তু ওসবও করলে না। এখন তো তোমার বয়স হয়ে গেছে। একা রান্নাবান্না করো। একটা কাজের লোক রেখে নাও। আলী বলে, কী লাভ। আমি নিজেই এখনো ভালো চলতে পারি বুঝেছিস? কাজকর্ম করলেই মানুষ সুস্থ থাকে। বৃদ্ধ মানুষেরা যেদিন থেকে কাজকর্ম করা বাদ দিয়ে বসে পড়ে, সেদিন থেকেই শরিলে রোগ বাঁধতে থাকে। কিছুদিন পরেই তাঁরা মরে যায়। তাই যতদিন আছি, কাজ কর্ম করেই বেঁচে থাকতে চাই। আর আল্লাহর রহমতে আমার শরিলে কোন রোগবালাই নেই।
রাত হয়। আলী রান্নাবান্না শেষ করে। তারপর দুজনে খাওয়াদাওয়ায় করে। ঘড়ে দুইটা বিছানা। একটাতে আলী ঘুমায়। আরেকটাতে আরিফ ঘুমাবে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে অনেক্ষন আলাপ করে। ঘুমের কোন ভাব নেই। আলী বলে, তা কতোদিনের জন্য এসেছিস?
- কেন? আমি যদি বলি, সারা জীবন এখানেই থাকবো, তাহলে কী করবে?
- আরে। তুই শহরের ছেলে। তুই গ্রামে থাকতে যাবি কেন? কিছুদিন থাকবি, চলে যাবি, সময় পেলে আবার আসবি।
- কতদিন থাকবো সেটা এখনো ভেবে দেখিনি। তবে থাকবো কিছুদিন।
- তোর মা কিছু মনে করবে না?
- করুক। সমস্যা কোথায়?
আলী ঘুমিয়ে পড়ে। আরিফ আসার পরে রাতের ঘটনাগুলোর কথা সে ভুলেই গেছে। আজকেও ভেঁজা জালটা ঘড়ের কোনে টানিয়ে রাখা হয়েছে। আলী ঘুমায়। গভীর ঘুম। কতক্ষন ঘুমিয়েছে বলা যায় না। কিন্তু কোন অজানা কারণে ঘুমটা ভেঙে যায়। চোখের পাতা জ্বলে। ঘুম মোটেও শেষ হয় নি। কোন একটা কারণেই ঘুম ভেঙেছে। আলী জালটার দিকে তাকায়। নাহ... জালটা তো সেখানেই আছে। তাহলে? তাহলে কেন ঘুম ভাংল? বড্ড পানি পিপাসা পেয়েছে। একটু ওঠা দরকার। আলী বিছানা থেকে যখন উঠল, একটা ভয়ানক আতঙ্কে তার শরির কেঁপে উঠল। চোখ দুইটা বড় বড় হয়ে গেল। আলীর ঠিক সামনে অনেকগুলো মানুষ। এক, দুই, তিন,,, গুনে গুনে ছয়জন মানুষ। স্বাভাবিক মানুষ নয় তারা। তাদের শরির গলে পচে কালো কুচকুচে হয়ে গেছে। শরির থেকে মাংস খসে খসে মাটিতে পড়ছে। আলী এটা দেখার পর নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। সাথে সাথে বিকট একটা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলল। এর পরের ঘটনা তার মনে নেই। আরিফ যখন তার দাদার আওয়াজ শুনে ছুটে আসে তখন সে দেখে তার দাদা বিছানা ছেড়ে মাটিতে পড়ে আছে। মুখ থেকে গোঙরানির মতো আওয়াজ বের হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হয় এটা দেখে যে, আলীর গা জুরে সেই ভেঁজা জালটা পেঁচিয়ে আছে। টাইট করে পেঁচানো। অনেক চেষ্টা করেও একা জালটা খুলতে পারলো না। তার দাদার শরির কাঁপছে প্রচন্ডভাবে। অনেক চেষ্টার পরে যখন জালটা ছাড়াতে ব্যার্থ হল তখন বাধ্য হয়েই রান্না ঘড় থেকে বটিটা বের করে আনে। তারপর একপাশ সাবধানে কাঁটতে থাকে। কাঁটার পরে আরিফ তার দাদাকে জালের ভেতর থেকে বের করে আনে। জগ থেকে এক গ্লাস পানি এনে আলীর মুখে ছিটিয়ে দেয় সে। কিছুক্ষন পরে জ্ঞান ফিরে আসে তার। আলী বুঝে উঠতে পারে না, কী হয়েছে তার সাথে। মাথা ঘুড়াচ্ছে প্রচন্ডভাবে। আরিফ তার দাদার কাঁধে জোরে ঝাকুনি দিয়ে বলে, তুমি ঠিক আছো দাদা? এসব কিভাবে হলো? আলী জালটার দিকে তাকিয়ে বলে, জালটা এখানে কী করে?
- আমিও তো সেটাই বলি। এটা তোমার সারা গায়ে জড়ানো ছিলো। তুমি জ্ঞান হাড়িয়েছিলে।
- আমার কিছু একটা হয়েছে। কিছু হয়েছে আমার।
- কী হয়েছে? আমাকে খুলে বলো।
- কিছুদিন ধরে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। আমার পাশে কে যেন মাঝে মাঝেই আসে। আজকে অনেকগুলো মানুষ এসেছিলো আমার খাটের সামনে। খুব নোংরা চেহাড়া। আমাকে ঘুমাতে দেয় না।
আরিফ এসব কথা শোনার জন্য নিজে প্রস্তুত ছিলো না। কে আসে তার দাদার সামনে? আরিফ জিজ্ঞাস করে, তোমার গায়ে এই জালটা পেঁচানো ছিলো। এটা এখানে আসলো কিভাবে? আর তোমার গায়েই বা জড়ালো কিভাবে? আলীর প্রচন্ড শীত লাগছে। শরির ভেঁজা। আরিফ একটা কম্বল এনে আলীর গায়ে জড়িয়ে দেয়। আলী বিছানায় উঠে বসে। তারপর আরিফকে বলতে থাকে, সমস্ত দোষ এই জালটার। যেদিন থেকে এই জালটা আমার ঘড়ে এনেছি, সেদিন থেকেই এই ঘটনাগুলি ঘটছে। এই জালটাই অভিশপ্ত।
আরিফ বলে, জালটা পেয়েছো কোথায়?
- আমার সাথেই মাছ বিক্রি করে। নাম আজাদ। ও বলল, ওর কাছে ভালো একটা জাল আছে। সেটা দিয়ে মাছ ধরোগে। আমি জালটা নিয়ে আসার পরেই তেমনটা হচ্ছে। এতোদিন কিছু মনে করিনি। ধরে নিয়েছি সব কিছু একটা স্বপ্ন। কিন্তু না। ঝামেলা অবশ্যই একটা আছে।
- হয়েছে কালকে সকালে ওনার সাথে কথা বলতে যাবো। এখন ঘুমাও। রাত আড়াইটা বাঁজে। সকালে এই জালের রহস্য বের করা যাবে।
সেরাতে আর তেমনটা হয় নি। জালটা এখনো মেঝেতে পড়ে আছে। কালো কুচকুচে রঙের। প্রথম জালটা যখন সে বাড়িতে আনল তখন দেখতে অনেকটা সুন্দর লাগছিলো। কিন্তু এখন সেই একই জালটা দেখে কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে। জালটা এমনভাবে মেঝেতে পড়ে আছে যেন মনে হচ্ছে, একটা কালো কুকুর গুটিশুটি হয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে। সে রাতটা আলীর কেমন করে কাঁটবে আল্লাহ্ ভালো যানে।
আরিফেরও রাতে ঘুম হয় নি। মাঝে মাঝেই বিছানা থেকে উঠে দাদার বিছানায় উকি দিয়ে দেখে সবকিছু ঠিক আছে কিনা। অবশেষে রাত শেষ হয়ে সকাল হল। জালটা এখনো মেঝেতে পড়ে আছে। পাশেই বঁটি। আলী বঁটি দেখে জালটার কাছে গেল। তারপর জালটা ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করার পর দেখল, সেটা ছেঁড়া। আলী আরিফকে ডাক দিয়ে বলল, জালটা ছিঁড়লো কিভাবে?
- আমি ছিঁড়েছি। গতরাতের ঘটনা মনে নেই? সারা শরির পেচিয়ে ছিলো জালটা। ছেঁড়া ছাড়া তো উপায় ছিলো না। আমি জানি জালটা তোমার নয়। তোমার প্রতিবেশি বন্ধুর। কিন্তু জালটা তো তোমার জন্য বিপদ ডেকে এসেছে।
আলী কিছু বলল না। চুপ করে রইল। আজকে আর মাছ ধরা হবে না। ইচ্ছাও নেই। সেদিন সকালে খেয়েদেয়ে ওরা রওনা হলো আজাদ-দের বাড়ির দিকে। কিছুদিন ধরে আজাদের সাথে দেখা-ই হচ্ছে না। মাছ ধরতেও আসে না। আলীর কাছে ব্যাপারটা সন্দেহ লাগে। তাই সে চিন্তা করেছে আজকে সব বিষয়গুলো খোলাসা করবে।
আজাদের বাড়িতে আসার পরেই ওর মেয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। আলী ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে নাঈমা, কেমন আছিস? নাঈমা আলী এবং তারপর আরিফের দিয়ে তাকিয়ে কিছুটা লজ্জা নিয়ে বলল, ভালো।
- তোর আব্বা কোথায়?
- বাড়ির পেছনে জাংলা দিচ্ছে।
আলী বাড়ির পেছনে গেল। তারপর আজাদকে দেখতে পেয়ে বলল, কেমন আছো?
- আরে! আলী ভাই যে। আজকে এতো সকালে কী মনে করে? আর সাথে এটা কে?
- আমার নাতি।
- বলো কি? এতো বড় হয়ে গেছে? তোমার ছেলেকেই তো এমন দেখেছিলাম।
- হুম। বড় হয়ে গেছে।
- চলে ঘড়ে চলো। একটু বসা যাক।
আলীর মুখ গম্ভীর। তখন সে আজাদকে বলল, বসার জন্য আসিনি। একটা জিনিস জানতে এসেছিলাম।
আজাদ কিছুটা বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী আলী ভাই?
বাড়ি থেকে একটু দূড়ে চলে আসে ওরা। ওদের বাড়ির পেছনে। এদিকে কোন মানুষ আসে না। আলী বলল, এখানে কেন নিয়ে আসলে? আজাদ সত্যিই অনেক বিচলিত। শরির ঘামছে তার। রীতিমত কপাল থেকে পানি বেয়ে বেয়ে পড়ছে। আরিফ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আজাদের দিকে।
অবশেষে আজাদ মুখ খুলল, তোমার কাছ থেকে একটা জিনিস গোপন করেছি আমি। তবে গোপন না করেও উপায় ছিলো না। তবে যখন জানতেই চাচ্ছো, তখন তোমাকে মিথ্যে কথা বলবো না। তবে আমাকে কথা দাও, এই জিনিসটা যাতে আর কেউ না জানে।
- কী এমন কথা? বলো শুনি।
আজাদ বলতে লাগল,
প্রায় দশ-বারো দিন আগের ঘটনা। আমি একটা নৌকা ভাড়া করেছিলাম রাতে মাছ ধরবো বলে। পুর্ণিমার রাত ছিলো। আকাশটা দিনের মতো উজ্জ্বল। আমার সাথে একটা ছেলে ছিলো, নাম লোকমান। তোমার নাতির বয়সীই হবে প্রায়। ওদিকে কেউ মাছ অতটা ধরতে যায় না। কিন্তু আমার সেদিন যেতে ইচ্ছে হলো। এতো সুন্দর রাত ছিলো তখন। তবে আশেপাশে কেউ নেই। পুরো এলাকায় একটা কুকুরের ডাকও শুনতে পাইনি সে-রাতে। বেশ কয়েকবার জাল ফেলে ভালো মাছই ধরলাম। লোভ ধরে গেল কেমন যেন। সেদিন অনেক মাছ ধরছিলাম। আরো একটু এগিয়ে যেতে চাইছিলাম। তবে তারপরে যে ঘটনাটা ঘটলো, সেটার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি জালটা ফেলেছি। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর জালটা তুলতে যাবো, তখন দেখলাম জালটা সহজে উঠছে না। অনেক ভারী। লোকমানকে ডাকলাম। দুজনে ধরে জালটা তোলার চেষ্টা করলাম। অনেক কষ্টের পর অবশেষে জালটা উপরে তুললাম। কিন্তু সেখানে কোন মাছ নেই। যেটা দেখলাম, জীবনে কখনো এতো অবাক হই নি। অতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলাম সে রাতে। আমি রাতে কখনোই ভয় পাই না। অথচ... আমি খেয়াল করলাম ভয়ে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। আমি জালটা নৌকায় তোলার পর দেখলাম ওই জালের ভেতরে পেচানো আরেকটা জাল। আর তার ভেতরে আছে মানুষে অনেকগুলো কঙ্কাল। লোকমান সেটা দেখার পর মাথা ঘুড়ে সাথে সাথে পড়ে জ্ঞান হারাল। এতো ভয় সে আগে হয়তো পায় নি। ওর যে হুস ফিরিয়ে আনতে হবে সেই চিন্তাও আমি করি নি।
পরে একসময় শান্ত হলাম। ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। মনে সাহস আনলাম। কার কঙ্কাল এগুলো? একসময় জালটা আমি আস্তে আস্তে বের করলাম সাবধানে। হাড়ের সাথে জালের কিছু অংশ আটকে গেছে। ছাড়ালাম সেগুলো। কঙ্কালগুলো থেকে জালটা আলাদা করলাম। তারপর গুনে গুনে দেখলাম পুরো ছয়টা মানুষের কঙ্কাল। কে এরা? কোথা থেকে এসেছিলো এখানে? আর জালের ভিতরেই বা এলো কিভাবে? ভেবেছিলাম, ঘটনাটা সবাইকে জানাবো। কিন্তু পরে আর সেটা করি নি। থানা পুলিশের ঝামেলাটা আর নিতে চাই নি। পুনারায় একে একে ছয়টা কঙ্কালই নদীতে ভাঁসিয়ে দিলাম। জালটা ফেলে দিতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, লাশের সাথে হয়তো জালটাতেও পচন ধরেছে। কিন্তু একি! জালটা এক্ষনো অক্ষত আছে। একটুও বাজে গন্ধও বের হচ্ছে না। জালটার মায়ার পড়ে গেলাম, ঠিক তুমি যেমনটা পড়েছিলে।
আলী আর আরিফ এতোক্ষন হা করে আজাদের কাহিনি শুনছিলো। এতো বড় একটা ঘটনা সে লুকিয়ে রেখেছে? একটা দুইটা না। ছয় ছয়টা কঙ্কাল একটা জালের মধ্যে পাওয়া গেছে। অনেক বড় একটা ঘটনাই তো। অথচ গ্রামের কেউ এটা জানে না। তারপর আজাদ বলতে লাগলো, জালটা খুব পছন্দ হয় আমার। পরে সেটা বাসায় নিয়ে আসি। পরদিন মাছও ধরলাম সেই জাল দিয়ে। কিন্তু তারপরের রাত থেকেই ঘটনা শুরু হলো। রাতে আর ঘুমাতে পারি না। প্রতি রাতেই জাল থেকে কে যেন চিৎকার করে। আমি একাই শুনি। আমার মেয়ে কিছুই শুনে না। আমার মেয়ে এখন আমাকে দেখেই ভয় পায়। ভাবে, পাগল টাগল হয়ে গেছি হয়তো। কিছুদিন এভাবে চলার পর মনে হলো, সত্যিই আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। রাতে যেন আমার পাশে কে শুয়ে থাকে। উঠে অনেকবার খুজেও কাউকে পাই না। পরে বুঝতে পারলাম যা কিছু হচ্ছে, এই জালটার জন্যই।
তারপরের দিনই তুমি জাল কেনার কথা বললে। ভেবেছিলাম, তোমার কাছে জালটা গেলে এসব কিছুই হবে না। তাই তোমাকে জালটা দিয়েছি। আমার অনেক বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দাও। না বুঝে তোমাকে অনেক বড় একটা বিপদে ফেলে দিয়েছি। আলী কোন কথা বলল না। আজাদের কথা শুনে সে চুপ করে রইল। ছয়টা মানুষের কঙ্কাল, কাদের এগুলো? কোথা থেকে আসলো এই কঙ্কালগুলো? আরিফ কেবল কথাগুলো হাঁ করে শুনছিলো। কী আজব একটা ঘটনা। অথচ এলাকার কেউ এই খবর জানেই না। আলী বলল, তো থানায় জানানো উচিৎ ছিলো।
- তখন সাহস হয়নি। একবার ভেবেছিলাম পুলিশে জানাবো। তবে থানা পুলিশের ঝামেলায় কে যেতে চায় বল। আবার নিজেই এই মামলায় ফেঁসে আসামী হয়ে যাই কিনা। তাই আর করলাম না। তা জালটার কী করেছ?
- আসার পথে জালটা পুড়িয়ে ফেলেছি।
- দেখতে অনেক সুন্দর ছিলো জালটা। কেন যে এর উপরে অভিশাপ আসলো।
আরিফ আলীকে বলল, থাক। এটা নিয়ে তোমাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। জালটা যেহেতু পুড়িয়ে ফেলেছি তাই আমার জানামতে আর কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আলী বলল, আমিও সেটাই মনে করি। কিন্তু আমার খুব চিন্তা হচ্ছে এটা ভেবে যে তাহলে ওই কঙ্কালগুলো তাহলে কাদের? কোন দোষে তাদের এভাবে মারা হলো।
- আমিও সেটাই মনে করি। কঙ্কালগুলো খুব পরিকল্পনামতো জালের ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই আমি মনে করি এগুলো নিয়ে থানায় একটা জিডি করার দরকার ছিলো।
- আমিও তাই মনে করি। তবে এখন তো কোন প্রমানও হাতে নেই। জালটা পুড়িয়ে দিলাম। আজাদের কঙ্কাল পাওয়ার ঘটনাও কেবল একটা গল্প মাত্র। কোন প্রমান নেই।
গল্প করতে করতে দুজনে বাড়িতে চলে আসে। আজকে রাত থেকেই বোঝা যাবে সবকিছু ঠিক আছে কিনা। যদি সব ঠিক থাকে তাহলে কোন সমস্যা হবে না আশা করা যায়। আবার নতুন একটা জাল কিনে তারপর মাছ ধরা আরাম্ব করতে হবে সেটা ভেবেই একটু খারাপ লাগল। কিনতে তো হবেই। জালটাই যে তাদের একমাত্র রোজগারের মাধ্যম। মাছ না ধরলে চলবে কিভাবে? আলী তাই বলল, চল, আজকে আমি আর তুই বাজারে যাবো। সুন্দর দেখে একটা জাল কিনতে হবে। যাবি আমার সাথে?
- অবশ্যই যাবো দাদা। কখন যাবে?
- বাজার বসবে বিকেলের দিকে। তখন অনেক কিছু পাওয়া যাবে। তুই আগে গ্রামের বাজার দেখিস নি?
- না দাদা। দেখার খুব ইচ্ছা আছে।
আজকে গ্রামের পরিবেশটা অনেক সুন্দর। ইদানিং ঘণ ঘণ বৃষ্টি হয় বলে পরিবেশের সব কিছু চক চক করে। কিছুক্ষন পর পর আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। বাতাস বয়, মাঠের মধ্যে হাজার হাজার গরু-ছাগল বাঁধা। গৃহস্থেরা ছুটে যায় সেগুলো আনতে। অনেকে মাঠে ধান শুকোতে দেয়। আকাশে মেঘ দেখলে ধান তোলার জন্য উঠেপরে লেগে যায় সবাই। মেঘ কেঁটে যায় কিছুক্ষন পরেই। বিশাল বড় বাতাসের ঝটিকা এসে সেই মেঘকে দক্ষিন থেকে উত্তরে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আবার রোদ ওঠে। বৃষ্টি হয় না। গৃহস্থ পুরুষ আবার গরুগুলো মাঠে দিয়ে আসে। কৃষকেরা আবার রোদের নিচে ধান নেরে দেয়। কিছুক্ষন পরে আবার দক্ষিনের আকাশে মেঘ দেখা দেয়।
আরিফ দূরে বসে এগুলো পর্যবেক্ষন করে। আরিফ ভাবে, গ্রামে না আসলে এসব কিছু সে দেখতেই পেত না। আলী দুপুরে খাওয়ার জন্য ডাকে। তারপর বলে, খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করে একটু পরে তোকে নিয়ে বাজারে যাবো।
চলবে...
Comments
Post a Comment