একটা ভালোবাসার গল্প

পর্বঃ ০২

বিজয় রিকসা নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। মেয়েটা পিছন থেকে বার বার বলছে, একটু তারাতারি যান প্লিজ। অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে। বিজয় বলল, আরে, চিন্তা করবেন না। চেষ্টা করছি তো। এমন সময় বিজয়ের ফোনের রিং বেজে উঠল। বিজয় দেখল জাভেদ ফোন করেছে। কেন ফোন করেছে সেটা সে জানে। ফোনটা রিসিভ করে বলল, "এই ফোন দিয়েছিস কেন? ফোন রাখ, ট্রিপে আছি।" এই কথা বলে ফোন কেঁটে দিল। এখন কারো সাথে কথা বলার মুড নাই।
এমন সময় পেছন থেকে মেয়েটা বলে উঠল, আচ্ছা, আপনার হাতের ফোনটা কি আপনার? এতো দামী ফোন পেলেন কোথায়? বিজয় এই কথার কোন সঠিক জবাব দিল না।
বিজয়য়ের বুকটা ধক করে উঠল। নিজের ফোনটা কেন বের করার দরকার ছিলো? গত মাসেই বিজয় এই ফোনটা কিনেছে। অনেক দামী ফোন সেটা দেখেই বোঝা যায়। এখন সে মেয়েটাকে কী জবাব দিবে?
"কি হলো? কথা বলছেন না কেন?"
বিজয় সাহস নিয়ে বলল, কেন, কি মনে হয়? আমরা রিকসাওয়ালারা কি দামী ফোন ব্যাবহার করতে পারবো না?
- তা তো নিষেধ করি নি।
- শোনেন। রিকসাওয়ালারা রিকসা চালায় বলে যে তাদের কাছে টাকাপয়সা নেই তা কিন্তু মোটাও না। এখনকার রিকসাওয়ালাদের কাছে কিন্তু যথেষ্ঠ টাকাপয়সা আছে। কিন্তু তারা সেটা প্রকাশ করে না।
- আপনি একদম ঠিক বলেছেন। আমাদের থেকে আপনারা অনেক সুখে আছেন। যতদিন থেকে এই জব-এ আছি ততদিন থেকে নিজেকে একটা গোলামের মতো মনে হয়। নিজের ইচ্ছামতো কোথাও যেতে পারি না। এই যেমন আজকে খুব শপিং করতে ইচ্ছে করছে। বাট আজকে আমার সারাদিন একটুও সময় নেই। যদিও শুক্রবারে অফিস ছুটি। তবে সেদিন দেখা যাবে বাসা থেকে বাইরেই যেতে ইচ্ছা করবে না। আর এদিকে আপনারা যা ইচ্ছা করতে পারেন। যখন খুশি তখন চলে যেতে পারেন যেখানে সেখানে। আপনি একটা দামী ফোনও কিনে ফেলেছেন। আর এদিকে আমি দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে এই ফোনটা ইউজ করছি। এখনো একটা নতুন কিনতে পারছি না। বাসা বাড়া, বাজার, বাবা-মায়ের অসুধ, এসব কিনতেই মাসের সব টাকা শেষ হয়ে যায়।
- আসলে সবার জীবনেই কিছু না কিছু সমস্যা থাকেই। সমস্যা না থাকলে কেউ আর খোদাকে মনে রাখত না।
- আই অ্যাম সরি! আপনার সাথে কী না কী বলে ফেলেছি, কিছু মনে করবেন না।
- আরে না। মনের করার কী আছে?
- আচ্ছা, আপনি লেখাপড়া কতদুর করেছেন?
- হঠাৎ! এই কথা কেন?
- আপনার কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুব শিক্ষিত। এতো সুন্দর চলিত ভাষায় কোন রিকসাওয়ালাকে আজ পর্যন্ত কথা বলতে দেখি নি। আপনাকেই প্রথম।
- বিজয় বলল, আপনার অফিস চলে এসেছি।
মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, আপনি তো যথেষ্ঠ বুদ্ধিমান। এটাই আমার অফিস সেটা জানলেন কিভাবে? আইডি কার্ড দেখে তাই তো? বিজয় সামান্য একটা হাঁসি দিয়ে বলল, হুম সেটাই।
মেয়েটা অফিসে চলে গেল। মেয়েটার যাওয়ার দিকে বিজয় অপলকভাবে তাকিয়ে রইল। দুপুরের দিকে বিজয় রিকসাটা জমা দিয়ে বাসায় চলে গেল। রিকসার মালিক বলল, কী ভাই! এখনি রিকসা জমা দিচ্ছো যে। একটু আগেই তো নিয়ে গেলে। বিজয় সামান্য হেসে বলল, সেটা আপনি বুঝবেন না বড় ভাই। কালকে আবার আসবো। বিজয় চলে আসল সেখান থেকে। তবে মেয়েটার কথা বিজয় সারাদিন একটু সময়ের জন্যও ভুলে থাকতে পারল না। এরকম তো বিজয়ের আগে কখনো হয় নি। একটা মেয়ের চিন্তায় আজকে কোন কাজই ভালোভাবে করতে পারছে না সে। খেতে গিয়েও সে ভালোভাবে খেতে পারল না। একরাম হোসেন বলল, কীরে! এমন তাড়াহুড়ো করে খাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে? বিজয় বলল, কিছুনা। এমনি।
- বন্ধুদের সাথে কোথায় গিয়েছিলি?
- একটু ঘুড়তে গেছিলাম।
- গেলি তো দেখলাম। মাথার চুলটাও আচঁড়িয়ে গেলি না। খাওয়াদাওয়া তো দূড়ের কথা। কিসের জন্য যেতে বলেছিলো সেটা বল এখন।
বিজয় রাগ দেখিয়ে বলল, তুমি এতো চিন্তা করছো কেন সেটা আমি বুঝতে পারছি না। বন্ধুরা এমনি ডেকেছিলো। একটা দরকারে।
- তো দরকারটা তাহলে আমাকে বলা যাচ্ছে না।
- সত্যি বলতে, না। বলা যাচ্ছে না।
- ঠিক আছে। আমিও আর জানতে চাইবো না। তোর ইচ্ছা হলে বলিস।
- আচ্ছা।
সেদিন রাতেও বিজয়ের ভালোমতে ঘুম আসলো না। কখন সে আবার সেই মেয়েটাকে দেখতে পারবে সেই চিন্তাগুলোই মাথার মধ্যে ঘুড়পাক খাচ্ছে। সেদিন রাতে বিজয় একটা স্বপ্নও দেখে ফেলল। স্বপ্নটা অনেক সুন্দর ছিলো। সেই মেয়েটাকে নিয়ে। কিন্তু কি আজব! সকালে ঘুম থেকে উঠে সেই স্বপ্নটার ঘটনা কিছুতেই মনে করতে পারল না। 

পরদিন বিজয় ঘুম থেকে উঠে ভালোমতে পরিপাটি হয়। নাস্তা খেয়ে নেয়। তারপর বাবাকে বলে, বাবা, বাইরে যাচ্ছি। কিছুক্ষন পরেই এসে পড়বো। বিজয় তারাতারি করে বের হয়ে যায়। একটা রিকসা নিয়ে রিকসা হাউজের সামনে যায়। রিকসার মালিকের সাথে আজকেও সে কথা বলে। ৫০০ টাকা ভাড়া। বিজয় একটা নিয়ে নেয়। হাতে বেশি সময় নেই। ঘড়িতে ৯ টা ১০ বাজে। বাজারের সামনে যেতে হবে জলদি। নইলে মেয়েটা অন্য কোন রিকসায় উঠে পড়বে। তখন আমও যাবে ছালাও যাবে। বিজয় তারাতারি পেডেল চালায়। তাকে দেখে কেউ রিকসাওয়ালা ব্যতিত অন্য কিছু মনে করবে না। চলার পথে অনেকগুলো মানুষের “এই রিকসা” ডাক উপেক্ষা করে বিজয় এগিয়ে চলল। ৯ টা ৩০ বেজে গেছে। বিজয়ের কপালে ঘাম। নিশ্চই মেয়েটা আজকে অন্য কোন রিকসায় চলে গেছে। বিজয় হতাশ হয়ে বাজারের সামনে পৌছাল। চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখল সে। কই? নেই তো। তাহলে কি রিকসা নেওয়াটাই আজকে লস হল?
বিজয়ের চোখের পাতা কেঁপে উঠল। সাথে বুকটাও। হ্যা। পা-ও কাঁপছে। অইযে মেয়েটা। বিজয়ের দিকেই তাকিয়ে আছে। শুধু তাকিয়ে আছে না। মেয়েটা রিকসার দিকে এগিয়েই আসছে। বিজয় গতকালকের মতেই অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। বিজয়ের চেতন ফিরল একটা লোকের ধমকে। আরেকজন রিকসাওয়ালা। পেছন থেকে বলল, অই হুমুন্দির পো! গাড়ি হড়া কইলাম। নইলে ধাক্কা দিমু। বিজয় এরকম কথার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। কিন্তু আশেপাশে মানুষ এবং সেই মেয়েটা। বিজয় রিকসাটা একপাশে সরিয়ে নিল।

“কেমন আছেন?”
মেয়েটার কথার উত্তরে বিজয় বলল, ভালো আছি। আপনি?
- এইতো। আর ভালো।
- মানে?
- মানে কালকে আমার কাছ থেকে রিকসা ভাড়া নিয়েছেন? আমিও আপনার ভাড়া দিতে একদমই ভুলে গেছিলাম। অফিসে দেরি হয়ে গেছিলো। এই নিন ১২০ টাকা ভাড়া। আজকের আর কালকেরটা মিলে। বিজয় টাকাটা নিয়ে পকেটে রাখল।
মেয়েটা রিকসায় উঠে বসল। বিজয় মেয়েটার অফিসের দিকে রওনা হল। মেয়েটা বলে উঠল, আচ্ছা! আপনি কি এখান দিয়েই রিকসা চালান? নাকি অন্য কোথাও যান।
- এখানেই চালাই।
- এখন থেকে ঠিক ৯ টার সময় আমার জন্য অইখানটাতে অপেক্ষা করবেন। প্রতিদিনই দেরি হয়ে যায়।
বিজয়য়ের মনের ভিতরে একটা ঝড় চলছে। এই মেয়েকে রিকসায় করে প্রতিদিন অফিসে নিয়ে যেতে হবে। ভেবেই বিজয়ের কেমন যেন লাগতে লাগল। এক ধরনের ভালো লাগা। বলে বুঝানো যাবে না।
কিছুক্ষন পরে মেয়েটা নেমে গেল। আর বলে গেল, কালকে সকালে সময়মতো এসে পড়বেন। বলেন তো কয়টার সময়?
- নয়টায়।
- ঠিক। মাথায় থাকে যেন।
মেয়েটা অফিসে ঢুকে গেল। বিজয়ের কাজ শেষ। গতকালকের মতো আজকেও সে রিকসাটা জমা দিয়ে দিল। রিকসার মালিক বলল, কী ভাই! সত্যি কথা বলো তো, তুমি রিকসা দিয়ে কী করো?
বিজয় হেঁসে বলল, কী আবার, চালাই।
- তাইলে এতো তারাতারি ফেরত দেওয়ার কারণটা জানতে পারি?
- বলা যাচ্ছে না এখন। তবে সময় হলে সব খুলে বলবো। আর হ্যা। কালকেও কিন্তু যথা সময়ে আসবো। একটা ভালো রিকসা রেডি রাখবেন।
বিজয় সেদিন চলে আসল। তার মুখে যেন বিজয়ের হাসি। কালকেও সে মেয়েটার সাথে দেখা করবে। আচ্ছা। মেয়েটাকে তার পছন্দ হয়। এই কথা সে কবে বলবে তাকে। মেয়েটার চিন্তায় তার রাতে ঘুম হয় না। একরাম হোসেন ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই দুদিন ধরে যা করছিস, সেগুলা আমার কাছে খুব সন্দেহ লাগছে। সত্যি করে বলতো, তুই আমার থেকে কী লুকাচ্ছিস। বিজয় এখন কোন কথা বলে না। একরাম হোসেন আবার বলেন, আমার স্কুলের চাকরিটা হয়ে গেছে। কালকে থেকে পড়াতে যেতে হবে। আমাকেও সকালে যেতে হবে।
- কয়টার সময় বাবা?
- ৯ টায়।
- ভালো। বলেছিলাম এই শেষ বয়সে মাথা খেও না। তা আমার কথা শুনলে না তো। আমি আর কী বলবো। তোমার যা ভালো লাগে তাই করো। তা স্কুলটা কোথায়?
- অই শ্যমপুর রেলগেট এর কাছে।
তারমানে অই মেয়েটার অফিস আর বাবার স্কুল দুইটা একই জায়গায়? এতে বিজয়ের সুবিধা হলো নাকি অসুবিধা হলো সেটা সে ধরতে পারলো না। তবে মনে হল একটু অসুবিধাই হলো। তাই সে বাবার কথা শুনে হা করে রইল। তার বাবা বলল, কিরে, এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন আমার দিকে? বিজয় বলল, কিছুনা বাবা।

পরদিন সকালে বিজয় আগের দিনের চাইতে একটু আগেই রওনা হল। যাওয়ার সময় বিজয়ের বাবা বলল, প্রতিদিন সকালে তুই কোথায় যাচ্ছিস সেটা আমাকে বলছিস না। আমি জানি তুই আমার কাছ থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছিস। তবে কী লুকাচ্ছিস সেটা আমাকে বলছিস না।
- বাবা, সেরকম কিছু কেন হতে যাবে বলো তো। আমি বড় হয়েছি না? আমি কি এখন ঘড়ে বসে থাকার ছেলে? আর অনেক দিন ধরে এলাকার খোঁজখবর নেই না। তাই এখন একটু বের হই। আর তুমি খেয়েদেয়ে স্কুলে চলে যেও। আমি একটু পরেই এসে পড়বো।
বিজয় বাসা থেকে বের হয়ে আসে। আচ্ছা, বিজয় বাবাকে মিথ্যা বলে কি ঠিক কাজ করল? সত্য কথাটা বললে কি কোন সমস্যা হতো? এর উত্তর সে জানে না। তবে সত্য কথা বললে হয়তো তার বাবা একটু বিশেষভাবে অবাক হতো। তার ছেলে সামান্য একটা মেয়ের জন্য প্রতিদিন রিকসা চালাচ্ছে। এটা সে নাও মেনে নিতে পারতো। ঘড়িতে সময় সকাল সারে সাতটা। আজকেও প্রচন্ড শীত। রিকসা হাউজে গিয়ে রিকসা নিল বিজয়। তারপর রওনা হলো বাজারের দিকে।
শীতে কুয়াশায় ভালোভাবে কিছু দেখা যাচ্ছে না। সেই কুয়াশা ভেদ করে বিজয় এগিয়ে চলল রিকসা নিয়ে। মাঝে মাঝে ক্রিং ক্রিং শব্দ করে বেল বাজাচ্ছে সে। অকারণেই। এই শব্দটাতে তার কিসের যেন একটা সৃতি জড়িয়ে আছে। কেন যানি এই শব্দটা তার কাছে প্রচন্ড ভালো লাগে। কী সেই সৃতি? সেটাও সে মনে করতে পারছে না। বাজারে এসে বিজয় ভাবল, শ্যামপুরে যদি বাবার সাথে কোনভাবে রিকসা চালানো অবস্থায় দেখা হয়ে যায়, তাহলে একটা বিরাট ঝামেলা হয়ে যাবে বোঝা যাচ্ছে। এর থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে মাক্স। মুখে মাক্স দিলে আর দেখা যাবে না। তাই বিজয় দোকান থেকে একটা মাক্স কিনে সেটা মুখে পড়ে নিল। তারপর রিকসাটা একটা ফাঁকা যায়গায় নিয়ে একটা দোকানের সামনে গিয়ে বসল। মেয়েটা আসতে এখনো অনেক দেরি। কেবল, আটটা বাঁজে। আরো এক ঘন্টা। এতোক্ষন কী করা যায়? এক কাপ চা খেলে কেমন হয়? বিজয় চাওয়ালাকে বলল, মামা! এক কাপ রঙ চা দিও চিনি বেশি করে।

চাওয়ালা চা দিয়ে গেল। বিজয় একটা চুমুক দিতে যাবে তখন সে দেখল, মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে রিকসার জন্য। আজব। এখন কেবল ৮ টা ২০ বাজে। আজকে মেয়েটা এতো আগেই আসলো কেন? বিজয় চা-টা পুরোপুরিভাবে খেতে পারলো না। চাওয়ালাকে টাকা দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে গেল সে। রিকসার কাছে গেল বিজয়। আজকে মেয়েটা শাড়ির উপরে একটা কালো সোয়েটার পড়েছে। এই মেয়ে যেটাই পড়ুক সেটাই দারুন মানায় দেখা যাচ্ছে। বিজয় রিকসায় উঠে বসল। তারপর মেয়েটাকে বলল, আজকে এতো তারাতারি এলেন যে। কোন দরকারি কাজ আছে? মেয়েটা অল্প কিছুক্ষন চিন্তা করে বলল, কোন কাজ নেই। তবে আজকে একটা জায়গায় যেতে চাচ্ছি।
- কোথায়?
- সেটা গেলেই বুঝতে পারবেন।
- উঠে বসুন তাহলে।

বিজয় রিকসা চালাতে আরাম্ব করল। মেয়েটা পেছনে চুপ করে বসে আছে। বিজয় মেয়েটার নিরবতা ভাঙ্গার চেষ্টা করার জন্য বলল, আচ্ছা আপনার সাথে অনেক দিন ধরে কথা হচ্ছে, কিন্তু আমি এখনো আপনার নামটাই জানতে পারলাম না। মেয়েটা একটু হেসে জবাব দিল, আমার নাম জেনে আপনার লাভটা কী?
- সবখানে লাভ খুঁজেন কেন? সবকিছুতেই কি লাভ পাওয়া যায়?
- জানিনা সেটা। আমার নাম মিতু। নামটাও আমার আইডি কার্ডে লেখা আছে। কিন্তু একটু ছোট, তাই হয়তো দেখতে পান নি। তো আপনার নামটাও তো জানা হলো না।
- আমার নাম বিজয়।
- বিজয়, ভিক্টোরি। অনেক সুন্দর নাম।
রিকসাটা অনেক্ষন চালানোর পর মেয়েটা একটা জায়গায় থামতে বলল। রিকসা থামার পর মিতুও রিকসা থেকে নামল এবং বিজয়কেও নামতে বলল। জায়গাটা অনেকটা শুনশান। আশেপাশে কোন মানুষের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা কিছুক্ষন হেঁটে যাওয়ার পর একটা জায়গায় গিয়ে থামল। বিজয় অবাক হয়ে দেখল এটা একটা গোরস্থান। এতো জায়গা থাকতে মিতু গোরস্থানে কেন আসল? বিজয় আরো একটু এগিয়ে গেল। বিজয় খেয়াল করল, মেয়েটা একটা কবরের সামনে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বিজয় মেয়েটাকে কিছু বলতে গিয়েও কিছু বলতে পারলো না। আচ্ছা! মেয়েটার চোখে কি জল এসেছে? চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে না। তবুও বিজয়ের অবচেতন মন জানান দিল মেয়েটা কান্না করছে। কিন্তু কেন?

মিতু আবার রিকসায় উঠে বসল। বিজয়কে হাল্কা গলায় বলল, এইবার চলুন। বিজয় রিকসায় উঠে আবার মেয়েটার অফিসের দিকে রওনা হল। বিজয়ের মাথায় শুধু এটাই ঘুড়পাক খাচ্ছে যে অই কবরটা কার? তখনি মিতু পেছন থেকে বিজয়কে বলল, আপনি ভাবছেন অইটা কার কবর, তাই না? বিজয় এর কোন জবাব দিল না। কিন্তু মেয়েটা বলতে আরাম্ব করল, আসলে, আমার সামনে যেই কবরটা ছিলো, অইটা আমার বড় ভাইয়ের কবর। বিজয় অবাক হয়ে বলল, আপনার বড় ভাই?
- হ্যা। ভাই মারা গেছে প্রায় ৫ বছর হয়ে গেল। আমার ভাই নতুন চাকরিতে জয়েন করেছিলো। অনেক দামী চাকরি। লেখাপড়াতেও অনেক ভালো ছিলো। বাবা ভাবলেন, এইবার হয়তো সে নিজে একটু বিশ্রাম নিতে পারবেন। কিন্তু বাবার কল্পনাটা আর বাস্তব রুপ নিতে পারল না। একদিন কলেজ থেকে আসার পর জানতে পারলাম, আমার ভাই কার আ্যকসিডেন্ট করেছে। খুব খারাপ অবস্থা। আমি হাসপাতলে যাওয়ার পর আমার ভাইকে আর জীবিত দেখতে পারি নি।
এই বলে মিতু সেখানেই শব্দ করে কেঁদে উঠল। কিন্তু এই মুহুর্তে মেয়েটাকে শান্ত করার মতো কোন ভাষা খুঁজে পেল না বিজয়। চুপচাপ মেয়েটার কথা শুনে গেল সে।

অবশেষে মেয়েটার অফিসে এসে রিকসা থামাল বিজয়। মেয়েটা রিকসা থেকে নেমে ভাড়া দেওয়ার সময় বিজয় বলল, থাক। আজকে আর ভাড়া দিতে হবে না। আপনি যান। আপনার অফিসের আজকে অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। অন্য কোন মেয়ে থাকলে জোর করেই ভাড়াটা রাখার জন্য অনুরোধ করত। কিন্তু এক্ষেত্রে মিতু হচ্ছে ব্যাতিক্রম। মেয়েটা চুপ করে অফিসের দিকে রওনা হয়ে গেল। বিজয় আগের দিনের মতোই মেয়েটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। অফিসে ঢোকার পরে মেয়েটা পুনরায় বিয়য়ের দিকে তাকাল। দুজনের চোখ একে অপরের সাথে কিছুক্ষনের জন্য আটকে গেল। ওভাবে তাকাল কেন মেয়েটা? বিজয়ের মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন ঘুড়পাক খেতে লাগল।

আজকে শুক্রবার। আজকে এবং কালকে মেয়েটার সাথে আর দেখা হচ্ছে না। মেয়েটাকে দেখার জন্য তার কেমন জানি মনটা ছটফট করতে লাগল। কী করা যায় তাহলে? বাসায় কোনভাবেই মন টিকছে না তার। মেয়েটার মোবাইল নাম্বারটা নিতে পারলে অনেক ভালো হত। কিন্তু সেটা নেওয়ার সাহস হয় নি বিজয়ের। ভেবেছে একদিন মেয়েটার নাম্বার নিবে। মাঝে মাঝে কথা বলবে। কিন্তু কী সম্পর্কে কথা বলবে? নিজের ভালোবাসার কথাটা প্রকাশ করবে? নাকি এমনি টুকিটাকি আলাপ আলোচনা করবে? ধুর এসব কী ভাবছে বিজয়। নাম্বারই তো নেই। এখনো তারা একে অপরকে ভালোভাবে চেনে না। এই কয়দিনের পরিচয়। কিন্তু তবুও। মেয়েটাকে এতো পছন্দ হয় কেন বিজয়ের? মেয়েটার জন্য রাতে ঘুম হয় না। মিতু। মেয়েটার নাম মিতু। নামটাও তো দারুণ। মিতুর কথা যখন তার মনে পরে বুকটা কেমন জানি করে ওঠে। অজানা এক ধরনের অনুভুতি।

বিকেলবেলা। আজকেও জাম গাছের নিচে বন্ধুদের আড্ডা বসেছে। সবার হাতেই চা। চারদিকে কুয়াশার চাদর আস্তে আস্তে নেমে আসছে। বোঝা যাচ্ছে প্রচন্ড শীত পরবে। তবুও এখানটাতে মানুষের ভিড়। আশেপাশের কিছু দোকানে এখন থেকেই চা সিঙ্গারার ব্যাবসা জমে উঠেছে। চলবে অনেক রাত পর্যন্ত।
আরিফ বলল, ইদানীং বিজয়কে দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে না। কারণটা কি? কোথাও থাকা হয় ওর?
সামাদ বলল, আমিও তো সেটাই ভাবছি। কোথায় থাকিস সারাদিন।
বিজয় আসামিদের মতো করে জবাব দিল, কই আবার থাকবো। কিছুদিন ধরে বাসায়ই থাকি। কিছুদিন ধরে শরিরটা একটু খারাপ। তাই বাইরে কোথাও যাই না।
কথাটা শুনা মাত্রই জাভেদ বলল, ভালোই তো মিছে কথা বলতে পারিস। আজকে তোর বাবার সাথে দেখা হয়েছিলো। তোর কথা বলেছিলাম। তুই নাকি প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে আমাদের সাথে দেখা করতে আসিস? কই। তোকে তো সকালে কোথাও দেখা যায় না। আমাদের সাথেও তো দেখা করিস না। তাহলে যাস কোথায়?
আর সেদিন তো একটা মেয়েকে নিয়ে রিকসায় করে দিলি দৌড়। তারপর থেকে আর তোর ছায়াও আমরা কেউ দেখতে পাচ্ছি না। কারণ কী এর?
বিজয় বিরক্ত গলায় ঝাকি দিয়ে বলল, থামবি তোরা। তোরা সবাই বিচারক, আর আমি একাই আসামি। আমাকে নিয়ে তদন্ত করা বাদ দে তো।
সামাদ শান্ত গলায় বলল, হয়েছে তো। থাক। আর কথা বাড়াতে হবে না। বিজয়ের ব্যাপারে কথা বাদ। কোথায় যায় না যায় সেটা তো ওর স্বাধীনতা তাই না। যত তারাতারি পারিস, প্রসঙ্গটা পাল্টানোর চেষ্টা কর।
সামাদের কথাটার পর বিজয়কে নিয়ে সেখানে কোন কথা হল না। কয়েকজন বন্ধু মিলিত হলে কোন প্রসঙ্গ খুঁজে পাওয়া যাবে না, সেটা তো আর হয় না। নানান কথা। হাসি তামাসা। আস্তে আস্তে সুর্যটাও ডুবে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পরে অনেকে ঘড়ে চলে গেল। যেন আস্তে আস্তে পরিবেশটা খালি হচ্ছে। জাম গাছটার তলায় মশার উৎপাত শুরু হতে যাচ্ছে এখন। যত তারাতারি সম্ভব এখান থেকে কেঁটে পরা ভালো। জাভেদ বলল, চল এখান থেকে। এখানে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। চল.. দোকানে গিয়ে গরম গরম সিঙ্গারা খেয়ে শরিরটাকে গরম করে আসি।


চলবে....

Comments

Popular Posts