একটা ভালোবাসার গল্ল
একটা ভালোবাসার গল্প
পর্ব ৮
বিজয়েরও বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। প্রতিটা ছেলেরই বিয়ের আগে আলাদা এক রকম অনুভুতি হয়। কিভাবে কী করবে, কিভাবে সময় কাঁটাবে একটা অচেনা মেয়ের সাথে। এখন আশেপাশের মানুষ দেখা হলেই বলে, বিজয় ভায়া। শুনলাম বিয়ে করতে যাচ্ছো। বিজয় হালকা হেঁসে বলে, তোদের দোয়ায় হবে আলহামদুলিল্লাহ্।
একরাম হোসেন নিজেই বিয়ের সব কাজ করবেন। অতোটা বড় ভাবে অনুষ্ঠান করা হবে না। পরিচিত কিছু মানুষকেই দাওয়াত করা হবে। বিয়ের সময় নির্ধারণ করা হলো। সামনের সপ্তাহেই বিয়ে। নিজেদের বাসাটা পরিস্কার করা হল। বিয়ের জন্য অনেক কিছু কেনাকাটা করতে হবে। বলতে গেলে বিজয়ের সম্পুর্ণ নতুন একটা অভিজ্ঞতা হচ্ছে।
আস্তে আস্তে বিয়ের সময় ঘনিয়ে আসছে। তবে বিজয় একটা জিনিস ভেবে পাচ্ছে না। মেয়ের ছবিটা এখনো দেখে নি। সে কেমন হবে দেখতে? মেয়ের ব্যবহার যে ভালো হবে সেটা সে নিশ্চিত। তার বাবা পছন্দ করেছেন। অবশ্যই মেয়ে ভালো হবার কথা। বিয়ের কার্ড ছাপা হলো। অনেক আত্বীয়কে জানানো হলো। মেয়ের নাম জান্নাতুল নাঈমা। অনেক সুন্দর নাম।
অবশেষে বিয়ের দিন চলে আসলো বিজয়ের। সকাল থেকেই বাসায় ধুমধাম আরাম্ব হয়ে গেল। অনেক আত্বীয় স্বজনেরা আসতে লাগল। বিজয়ের কয়েকটা বন্ধুও আসল। তবে বিজয়ের মন খারাপ হচ্ছে এটা ভেবে যে জাভেদ আর আরিফ আসতে পারবে না। ওরা সেই ছোটবেলার বন্ধু। হঠাৎ করে ওরা কিসের যেন কাজে আটকে গেছে। আজকের দিনটাতে যে তার অনেক ধকল যাবে এটা সে বুঝতে পারছে। বিজয়ের বাবা ছোটখাটো একটা আয়োজনই করতে চেয়েছিলো, তবে সেটা আর হয়ে উঠে নি। অনেক আত্বীয় এসেছে বাসায়। একটা ওয়েডিং প্ল্যানার টিম ভাড়া করা হয়েছে। ঘড়টা সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। বিশেষ করে বিয়ের বাসর ঘড়। বিজয়ের মনে নানান রকম চিন্তা জমা হয়। কী হবে তার পরবর্তী জীবনে। একরাম হোসেন বার বার ছেলের কাছে আসছেন। বিজয়ের খবরাখবর নিচ্ছেন।
একরাম হোসেন বলল, সকালে কিছু খেয়েছিস?
- কিছুই খাই নি বাবা। তবে কেন জানি খেতে ইচ্ছা করছে না।
- চিন্তা করছিস?
- না বাবা। চিন্তা কিসের। তুমি তো আছোই।
- হুম। আর বাইরে গিয়ে একটু সবকিছু দেখে আয়। তোর বিয়ে, কেমন করে সাজানো হবে সেটা তুই বলবি।
- সেখানেই রওনা হচ্ছি বাবা।
বিজয় বাইরে আসে। এখনো অতোটা মানুষ আসে নি। দূপুরের দিকে আত্বীয় স্বজন নিয়ে রওনা করা হবে কনে পক্ষের বাড়ির দিকে। আজকে বাইরে খুব সুন্দর রোদ উঠেছে। আশেপাশে কিচিরমিচির স্বরে পাখি ডাকছে। সকালটা অনেক সুন্দর। ওয়েডিং প্ল্যানাররা সকালেই এসে বাইরের দিকটা সাজাচ্ছে। কয়েক ধরনের ঝাড়বাতি আনা হয়েছে। সকালে এতোটা সুন্দর দেখা না গেলেও রাতে যখন পুরো ঘড়টা আলোকিত হয়ে যাবে, তখন ব্যপারটা দারুন লাগবে।
বেলা এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সবার ব্যাস্ততা বাড়তে লাগলো। বিজয়ের চাচাতো ভাই-বোনেরা এসেছে। চাচাতো বোনেরা হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিলো কিছুক্ষন। বিজয়ের খালা আর কাকিরা এসেছে। তারা বসেছে হলুদ নিয়ে। এগুলো দিয়ে নাকি তাকে গোছল করানো হবে। ভেবেই হাঁসি পায় বিজয়ের। হলুদ দিয়ে গোছল করলে শরিরের উজ্জ্বলতা বাড়ে এটাই সে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে। আজকে বাস্তবে তার প্রমান দেখা যাবে।
১১ টার দিকে গোছল করতে বসল বিজয়। একে একে সবাই এসে বিজয়ের গায়ে একটু একটু করে হলুদ মেখে দেওয়া আরাম্ব করল। এভাবে এর আগেও এক বার বিজয়কে হলুদ দিয়ে গোছল করানো হয়েছিলো, যখন বিজয়ের খৎনা করানো হয়েছিলো। তখন অনেক ছোট ছিলো সে। বাপ রে বাপ। তখন ছিলো শীতকাল। শীতের দিনে সকালে আন্টিরা ঠান্ডা হাতে গায়ে হলুদ মেখে দিচ্ছিলো। যদিও এখন গরমকাল। সকালে গোছল করতে ভালোই লাগছে।
গোছল করে যখন বিজয় নিজের ঘড়ে গিয়ে আয়নার সামনে গেল, তখন খেয়াল করে দেখল সে আগের চাইতে একটু ফর্সা হয়েছে। অতোটাও না। নিজের চেহাড়ার দিকে ভালোভাবে তাকানোর সময়ই পায় না সে। পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ে রেডি হয়ে নিল। আত্বীয়রা আস্তে আস্তে রেডি হল। তিনটা গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। গাড়িগুলোও সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।
দুপুরের পরে রওনা হলো সবাই। তিনটা গাড়ি ভর্তি আত্বীয়। বিজয়ের কাকা-কাকি, মামা-মামী, কাজিনরা সবাই এসেছে। এই প্রথম বিজয় খেয়াল করল, তাদের ফ্যামিলিটা আসলে অনেক বিশাল। তবুও জীবনের অনেক সময় তার নিজেকে একা মনে হয়েছে। কনের বাড়ি বেশি দূরে না। আধা ঘন্টার রাস্তা। গাড়ির ভিতরে কাজিনরা গান চালু করেছে। সবার মুখেই হাঁসি। এসব দেখে বিজয়ের ভালোই লাগছে। সে নিজে গাড়ির এক পাশে পাঞ্জাবী পায়জামা গায়ে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে।
একটু পরেই মেয়ের বাড়ি এসে পরে সবাই। গাড়িটা কনেপক্ষের বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে চারদিকে হই হই পরে গেল। জামাই এসেছে, জামাই এসেছে, চারদিকে কথাটা ছড়িয়ে গেল। মেয়ের কানেও এতোক্ষনে হয়তো কথাটা পৌছে গেছে।
গাড়ি থেকে নামা মাত্র এক ঝাক মেয়ে এসে পথ আটকে ধরল। বলল, টাকা না দিলে জামাইকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। কী আর করা। টাকা দিতে হচ্ছে। অবশেষে মেয়েগুলোকে কিছু অর্থ দেওয়ার পর তারা পথ ছেড়ে দিলো।
বিকেলের দিকে খাওয়াদাওয়া হলো। মেয়েপক্ষের বেশি আত্বীয় সে দেখতে পেল না। বিজয় তার কাজিনদের সাথে খেতে বসেছে। খাচ্ছে আর নানান বিষয়ে ওদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। কাজিনদের সাথে তার নিজের অতোটাও ভালো সম্পর্ক নেই। কখনো ফোনে কথা হয় না। হলেও মাঝে মাঝে। আর দেখা হলে দু-একবার কথা হতো আগে। এখন চাকরি করার পর সে আত্বীয়স্বজনদের প্রায় ভুলতে চলেছে। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে একদিকে তাকিয়ে বিজয় থমকে গেল। একটা মেয়ে খাচ্ছে। মেয়েটাকে বিজয় এর আগেও যেন কোথাও দেখেছে। কোথায়? বড্ড পরিচিত মনে হচ্ছে তাকে। কিন্তু মেয়েটা কে? কোনভাবেই মেয়েটাকে সে মনে করতে পারছে না। খেতে খেতে বার বার বিজয় মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু বেশিক্ষন তাকাতে পারলো না। কনেপক্ষের সবাই মাঝে মাঝেই বিজয়ের দিকে তাকাচ্ছে। সেই মেয়েটাও বার বার তাকাচ্ছে বিজয়ের দিকে। কী লজ্জার ব্যাপার।
তবে বিজয় মেয়েটাকে বার বার মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। অবশেষে হাল ছেড়ে দিল সে। এটাও কী দেজাভু? হতে পারে। খাওয়াদাওয়া ভালোই হলো। খেয়েদেয়ে সবাই একেকজন বিশ্রাম নিল। তারপর আসরের নামাজের পর বিয়ের কাজ শুরু হল। কাজি এসেছেন। একে একে আত্বীয়স্বজনরা সবাই এসে উপস্থিত হল। এখন শুধু কনে আসার পালা। এই সময়টা যেন কোনভাবেই কাঁটছে না বিজয়ের।
অনেক্ষন সময় পার হওয়ার পর কনে উপস্থিত হল। লাল বেনারসি পরা। পুরো মুখটা ঘোমটা দিয়ে টানানো। শাড়িটাতে আলো প্রতিফলিত হয়ে মেয়েটাকে চকমক করছে। ছেলেপক্ষ আর মেয়েপক্ষের মধ্যে গাঁধা ফুলের একটা দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। কাজি সাহেব বিয়ের কাজ শুরু করলেন।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে গেল। এখন মেয়ের বিদায় নেওয়ার পালা। বিদায় বেলায় প্রতিটা মেয়েই হয়তো কান্না করে এটা ভেবে যে, এতোদিন তারা যে বাড়িটায় নিজের বাড়ি ভেবে থেকেছে। আজ থেকে এই বাড়িতেই আত্বীয় হয়ে মাঝে মাঝে আসতে হবে। হঠাৎ এই পরিবর্তনে প্রতিটা মেয়েই একটা ধাক্কা খায়।
বাসা ভর্তি আত্বীয়। কয়েকজন পরিচিত অপরিচিত ছেলে-মেয়েরা বিজয়ের সাথে ছবি তুলতে এগিয়ে আসলো। সবার সাথে পরিচয় হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেল। এইবার বিদায় নেওয়ার পালা। পাত্রীসমেত এইবার রওনা হবে বিজয়দের বাসার দিকে। মেয়েটা যে অনেকটা লজ্জা পাচ্ছে সেটা বিজয় ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। মাথা নিচু করে আছে। এখন সে মেয়েটার সাথে কোন কথাই বলছে না। তাকে একটু একা থাকার সু্যোগ দেওয়া যাক। বিজয়ও মেয়েটার মতো করেই চুপ করে রইল। পুরো রাস্তায় আর তেমন কারো সাথেই কথা হলো না। স্পিকারে কোন গানও বাঁজল না।
রাতের বেলা পুরো বাসাটা চকচক করছে। নানার রকমের ঝিকিমিকি বাতি জ্বলছে চাকদিকে। বাসা ভর্তি মানুষ। নতুন বউ আনা হয়েছে। সবার মাঝেই এক ধরনের আলাদা রকমের আনন্দ। বিজয় এখনো মেয়েটাকে দেখে নি। কী আযব। এখন মেয়েটা তার নিজের বউ। এখন দেখলে সমস্যা কী? তবে বাবার আদেশ। বাসর ঘড়ের আগে বউয়ের মুখ দেখা যাবে না। বাবাটাও না। কেমন জানি। তাকে সে ভালোভাবে বুঝতেই পারলো না, এতোটা বছর সে বাবার সাথে থেকেও।
বিকেলে খাওয়ার পরে বাসায় এসে আবার খাওয়াদাওয়া পর্ব অনুষ্ঠিত হলেও বিজয় খেল না। পেট ভরা তার। কাজিনরা বাসর রাতের নানান রকম টিপস দেওয়া আরাম্ব করে দিল। অথচ নিজেরা একটাও এখনো বিয়ে করে নি। বাসর রাতে কোন টিপস কাজে আসে না। সবাই জামাইকে যতোই টিপস দিক না কেন। বাসর ঘড়ে ঢুকলে সেগুলো একটাও মনে থাকে না।
সুদীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পর রাত হলো। এখন ঘড়ে প্রবেশ করার পালা। বউ ভিতরে অপেক্ষা করছে। শুনেছি বাসর রাতে এক গ্লাস দুধ নিয়ে যেতে হয়। থাক। অতো নিয়মকানুন কে মানে? অনেক চিন্তাভাবনার পর আস্তে করে দরজা খুলে নিজের রুমে প্রবেশ করল। ভেবেই পাচ্ছে না বিজয় যে, এটা তার নিজের রুম। কিছুদিন আগেও যেই রুমটাতে মাকড়সার জালে ভড়পুর ছিলো, এটাই সেই রুম। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, সে কোন ভুল বাড়িতে চলে এসেছে।
- আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকুমুস সালাম।
বিজয় আস্তে করে বিছানায় বসলো। খুব নার্ভাস সে। তবে সেটা দেখে বোঝা যাচ্ছে না। বিজয় হালকা গলায় বলল, কেমন আছেন?
- ভালো আছি। আপনি?
- গলার স্বর এমন লাগছে কেন? ভেঙে ভেঙে আসছে কেন? সর্দি লাগিয়েছেন নাকি?
- হুম। বৃষ্টিতে ভিজেছি। গলা বসে গেছে।
- অসুধ খেতে হবে।
মেয়েটা মাথা ঝাকালো। বিজয় কিছুটা হাঁসিমুখে এইবার বলল, এইবার কি তাহলে আমার প্রিয় বউটাকে দেখতে পাবো না? আমি কিন্তু আপনাকে এখনো দেখি নি। আপনার কোন ছবিও দেখি নি। আমার বাবার নিষেধ ছিলো। এমন বাবা কারো হয়?
মেয়েটা কোন কথা বলল না। বিজয় চুপ করে বসে রইলো বউয়ের সামনে। নিজের হাত দিয়ে বউয়ের ঘোমটাটা খুলবে এই সাহসটা তার হচ্ছে না। অনেক্ষন বসে থাকার পর বিজয় মেয়েটার কাছে একটু গিয়ে গেল। তারপর বলল, দেখি আমার বউটা কতো সুন্দর। এই কথা বলে বিসমিল্লাহ্ বলে মেয়েটার মুখ থেকে ঘোমটাটা আস্তে আস্তে সরিয়ে ফেলল বিজয়।
কী থেকে কী হয়ে গেল বোঝা গেল না। বিজয়ের চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল। তারপর ধপাস করে বিছানার উপর পরে জ্ঞান হাড়াল। মেয়েটা কিছুটা অবাক হবার কথা ছিলো, কিন্তু সে অবাক না হয়ে বিজয়ের পাশে গিয়ে বলতে লাগলো, শুনছেন? কী হলো? ঠিক আছেন? সত্যি অজ্ঞান হয়েছে বিজয়। মেয়েটা জগ থেকে এক গ্লাস পানি এনে বিজয়ের মুখে ছিটানো আরাম্ব করল। কাঁপুনি দিয়ে উঠে পড়ল বিজয়। তারপর সবকিছু বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগলো। আজকে তার বিয়ে, এখন সে বাসর ঘড়ে আছে। সামনে তার বউ। শাড়ী পড়া। সেই মেয়েটা, যাকে সে আগে প্রতিনিয়তই দেখত। রাস্তার পাশে রিকসার জন্য যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকতো, এটা সেই মেয়ে। মিতু। হ্যাঁ। মিতুই তো এটা।
বিজয় অবাক হয়ে বলল, তুমি?
মিতু বলে উঠল, চিনলেন আমাকে তবে?
- এসব কিভাবে হলো?
- মিথ্যেবাদী। এভাবে আমাকে না ঠকালেও পারতেন।
- মানে? কী বলছেন আপনি?
- আপনি রিকসা চালান? আমার সাথে মজা করলেন কেন?
- সত্যি কথা বলতে। শুধুমাত্র আপনার জন্যই এসব করেছি। আপনার সাথে দেখা করার জন্য রিকসা ছাড়া তো আর উপায় ছিলো না।
- সত্যটা বলে দিলে আমার নিজের এতো ঝামেলা হতো না। সব দোষ আপনার।
- আচ্ছা। আমি মাফ চাইছি। কিন্তু আমার মাথায় একটা জিনিস মোটেও ঢুকছে না যে, বাবার পছন্দে আমি বিয়ে করেছি। বাবা আপনাকে চিনলো কিভাবে?
- আপনার বাবাই তো আমাদের বাসায় এসেছিলো। আর আপনার একটা ছবিও দিয়েছিলো জানেন? আমি দেখে তো আপনার মতোই অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম।
- তাহলে আপনি সব কিছু জানতেন?
- হুম।
- আমাকে তো আপনার কোন ছবি-ই দেখায় নি। আমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলেছিলো। এখন বিষয়টা বুঝলাম। আপনিই আমার সারপ্রাইজ।
- তো সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো?
- আল্লাহ্ আমাকে এতোটা খুশি করে দিবে এতোটা ভেবেও দেখি নি। আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া।
অনেক্ষন কথাবার্তার পর বিজয় বলল, তাহলে জান্নাতুল নাঈমা কে? মিতু বলল, এটা আমার আসল নাম। মিতু আমার বড় ভাইয়ের দেওয়া নাম। এটা মুখে বলা সহজ। তাই। সবাই মিতু বলেই ডাকে।
মিতু আস্তে আস্তে বিজয়কে সব কথা খুলে বলল। অনেক রাত পর্যন্ত দুজন গল্প করল। সকালে ঘুম থেকে উঠে বিজয় দেখল মিতু আগেই উঠে গেছে। বিজয়কে উঠতে দেখে মিতু বলল, উঠেন। ঘুম তো অনেক হলো। বেলা হয়ে গেছে।
বিজয় বিছানা থেকে উঠে ফ্রেস হতে গেল। মিতু বাসাটা টুকটাক গোছানো শুরু করল। এখন থেকে এই ঘড়টাই তার নিজের। জীবনের বাকি স্বপ্নটুকু এখানেই বুনতে হবে। বিজয় ফ্রেস হয়ে ঘড়ে আসলো। এসে দেখলো, মিতু ঘড়ের টুকিটাকি কাজ করছে। বিজয় হঠাৎ পেছন থেকে মিতুকে জড়িয়ে ধরে বলল, অনেক ভালোবাসি তোমাকে। শুধু তোমার জন্যই এতোদিন এসব করেছি। তোমাকে পাওয়ার জন্য।
মিতু বিজয়ের হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, কী করেছেন আপনি? কিছুই করতে পারেন নি। সব করেছে আপনার বাবা। আর এতোই যখন আমাকে ভালোবাসতেন, তাহলে আমাকে ছেড়ে চলে যেতেন না। জানেন, কতো খুঁজেছি আপনাকে? খুঁজতে খুঁজতে রিকসার মালিকের কাছে চলে গেছিলাম। তবুও সেখানে আপনাকে পাই নি। আমার কান্নাগুলো কী দেখেছেন?
বিজয় কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায় না। নিজেও তো অনেকটা ভুল করেছিলো। সেগুলো নিয়ে আর কথা বাড়াতে চায় না। নতুন বিয়ে করেছে সে। এভাবে কথা বলাটা ঠিক হবে না।
শেষমেশ বিজয় পুনারায় মিতুকে দুহাত দিয়ে মিতুকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, আমি সত্যিই একটা ভুল করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করা যায় না?
মিতু হালকা গলায় বলল, আর কতো ভুল করবেন? আমার সাথে তো প্রতিনিয়তই ভুল করে যাচ্ছেন।
- এমন ভুল তো আমি বার বার করতে চাই।
- ছাড়েন এবার। চলেন, বাবা খাওয়ার জন্য ডেকেছিলেন।
বাসার ছাদে একরাম হোসেন পত্রিকা নিয়ে বসে আছেন। বিজয় হালকা কাশি দিয়ে বাবার সামনে দাঁড়ালো।
- আসসালামু আলাইকুম। বাবা।
- ওয়ালাইকুমুসসালাম। কী খবর?
- আলহামদুলিল্লাহ। ভালো।
- আমার সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো? বউকে পছন্দ হয়েছে?
- এসব কিভাবে করলে?
- ম্যাজিক বুঝলি?
- বলো বাবা। এটাই তো সেই মেয়েটা। যার যন্য এতোদিন রিকসা চালালাম।
- তোর ড্রয়ার থেকে সেদিন একটা কাগজ পেলাম। একটা বাসার ঠিকানা। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে অইটা অই মেয়েটার বাসারই ঠিকানা। একদিন সময় নিয়ে বাসায় চলে গেলাম। তোর ছবি দেখালাম। আমার ছেলে তুই, রাজি না হয়ে যাবে কোথায়?
- তুমি পারোও বটে। ডাকতে আসলাম। খাবে চলো। একরাম হোসেন পত্রিকাটা ভাঁজ করে চেয়ার থেকে উঠে নিচে নেমে আসলো। সবাই একসাথে খেতে বসলো। খাওয়ার সময় একরাম হোসেন মিতুকে বলল, তা কেমন লাগছে নতুন পরিবারটা?
- ভালো।
- বিজয়ের মা মারা গেছে অনেকদিন হলো। মায়ের আদরের কথা ওর মনে আছে কিনা জানিনা। সেই জন্যই ছেলেটা এমন। মাঝে মাঝে পাগলামি করে।
বিজয় মুখ টিপে বলল, এসব কথা পরে বললে হয় না?
একরাম হোসেন বলতে লাগলেন, এ বাড়িতে তোমার কোন সমস্যা হবে না। এখন বিয়ের সময়টাতে অনেক আত্বীয় আশেপাশে। তবে দুদিন পরে দেখবে কেউ নেই। পুরো বাসাটা ফাঁকা। তখন মনে করবে, পুরো বাসাটাই তোমার।
মিতু কোন কথা বলল না। চুপ করে খেতে লাগলো।
বিকেলবেলা মিতু আর বিজয় সেই লেকটার সামনে গেল। লেকের পানি অনেক বেড়েছে। বর্ষা কাল বলে কথা। বিজয় আর মিতু সেই বেঞ্চটাতে গিয়ে বসলো। বিজয় বলল, কফি খাবে?
- হুম। খাবো।
পাশের দোকান থেকে দুইটা কফি এনে একটা মিতুকে দিয়ে বলল, আজকের পরিবেশটা অনেক সুন্দর। তাই না?
- হ্যাঁ। সত্যিই অনেক সুন্দর।
- গান গাইতে পারো?
মিতু হেসে বলল, নাহ্। আপনি পারেন?
- হুম। শুনবে?
- অবশ্যই।
বিজয় প্রথমটাতে একটা কাঁসি দিয়ে হাল্কা গলায় একটা গান ধরল:
আমি থাকতে চাই তোমার পাশে,
চলে যেও না দূরে।
বুকের মাঝে দু-হাত দিয়ে
রাখবো চেপে ধরে।
তুমি শুধু আমার...
তুমি শুধু আমার...
ভালোবেসে তুমি আমি দিবো,
সাত সুমুদ্র পাড়।
মিতু হেঁসে বলল, বাহ। অনেক সুন্দর গাইতে পারেন আপনি। শিখলেন কিভাবে?
- গান কি কেউ নিজে শিখতে পারে? এটা একটা প্রতিভা।
- আপনার প্রতিভা আছে অনেক দেখা যাচ্ছে।
কিছুক্ষন পর দক্ষিন আকাশটা হঠাৎ করে কালো মেঘে ছেয়ে গেল। পুরো পরিবেশটা অন্ধকার হয়ে গেল। আর কিছুক্ষন পরেই যে বৃষ্টি নামবে সেটা বোঝা গেল। বিজয় বলল, আসো, আজকে যাওয়া যাক। এমনিতেই তোমার সর্দি লেগে আছে। বৃষ্টিতে ভেঁজা যাবে না।
- না। আমি ভিঁজবো আজকে।
- না। আজকে না। বৃষ্টি আরো হবে।
এভাবে বলতে বলতে দুজনের মধ্যে টানাটানি শুরু হয়ে গেল। বিজয় বলল, চলো বাসায়।
এসব বলার সাথে সাথেই ঝপঝপ করে বৃষ্টি নেমে গেল। বৃষ্টি এসে দুজনকে কাকের মতো ভিজিয়ে দিয়ে গেল। মিতু এইবার হাঁসতে হাঁসতে বলল, এইবার ভালো হয়েছে না? চলুন বাসায় যাওয়া যাক।
সমাপ্ত
Comments
Post a Comment