একটা ভালোবাসার গল্প
পর্বঃ ০১
একটা বিকেলবেলা
বিকেল ৫ টা। এটা অন্য সব দিনের মতো নয়। আজকের বিকেলটা অনেক স্পেশাল। শীতের বিকাল। তাছাড়া স্পেশাল হওয়ার আরো একটা কারণ আছে। বিকেল বেলা একটা বড় জাম গাছের নিচে ৫ জন মানুষের আড্ডা। সবাই চাকরি করে। একেকজনে একেক জায়গায় থাকে। ফোনে কথা হলেও দেখা তেমনটা হয় না। কিন্তু আজকে হয়েছে। সেই ছোটবেলায় ৫ জন বন্ধু যেভাবে এই জামগাছটার নিচে গল্পসল্প ঝগড়াঝাঁটি করত। আজকেও তেমনভাবেই তারা বসেছে। সবাই প্রতিষ্ঠিত। সবাই দামী চাকরী করে।
আগে যখন তারা ছোট ছিল, তখন আশেপাশে অতটা ঘরবাড়ি ছিল না। শুনশান নীরব ছিল চারদিকটা। কিন্তু এখন পরিবেশটা অনেকটাই পালটে গেছে। চারদিকে পাকা পাকা দালান উঠেছে। জাম গাছটার সামন দিয়ে সাপের মতো লম্বা রাস্তা। রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে অটোরিকশা, সিএনজি, প্রাইভেট-কার। পরিবেশটা যে একদিনে এমন হয়ে যাবে, তারা ছোটবেলায় সেটা কল্পনাও করতে পারে নি।
করিম, জাভেদ, সালাম, আরিফ আর বিজয়। এই পাঁচ বন্ধু। করিম, সালাম আর বিজয় দেশের বাইরে থাকে। তারা এক মাসের জন্য ছুটি নিয়ে এসেছে। জাভেদ আর আরিফ দেশেই ভালো একটা কোম্পানিতে জব করে। তাদের ছুটি দশ দিন। এই ছুটির জন্য অবশ্যই তাদের বেতন কাঁটা যাবে। কিন্তু সেটা যাক। বন্ধুত্বই অনেক বড়। বেতন তো পরের মাসে আবার পাওয়া যাবে।
পাঁচ জনের হাতেই চা। আগের মতো গায়ে পড়ে গল্প আর হয় না। এখন চারদিকে লোকজন। সেই আগের মতো গল্প করা যাবে না। চায়ের কাপে চুমুক দিলো আরিফ। কাপটা একপাশে রেখে বলল, সবাই কতো বড় হয়ে গেছি তাই না?
জাভেদ বলল, বড় হবি না তো সেই আগের মতো ছোট থাকতে চাস?
আরিফ বলল, অবশ্যই। ছোট হওয়ার কোন অপশন আছে নাকি রে?
জাভেদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, আছেই তো?
- কীভাবে?
- একটা বিয়ে করে ফেল। বাচ্চাকাচ্চা হবে। বাচ্চার সাথে সাথে তুইও একটা বাচ্চা হয়ে যাবি।
- ফাজলামো করিস? এতে বয়সটা কি কমবে?
- আরে পাগলা! মনের শিশুই আসল শিশু।
- রাখ তোর মনের শিশু। আগে ছোটবেলায় বাবার কাছে ১০ টা টাকা চাইলে পেতাম। টাকা পয়সা কামাই করার কোন চিন্তা ছিলো না। খাও দাও ঘুমাও। কিন্তু এখন? নিজের রোজগার নিজে করতে হয়। অফিসে যেতে হচ্ছে। বসের ঝাড়ি খেতে হচ্ছে। তার পরেও নিজেকে কিভাবে শিশু মনে করতে পারি? মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।
আরিফের কথা শুনে সালাম বলল, এসব কথা বাদ দে তো। বড় তো হতেই হবে। কেউ তো ছোটই থাকে না সারাজীবন। সবাই বড় হয়। এইযে দেখছিস না, মাথার উপরের জাম গাছটা? আমরা ছোটবেলায় গাছটা যেমনটা দেখেছি, এখনো কি গাছটা তেমনটা আছে? আমরা বড় হয়েছি, আমাদের দায়িত্ব বড় হয়েছে। কিছুদিন পর বিয়ে করতে হবে, বউয়ের দায়িত্ব নিতে হবে, বাচ্চার দায়িত্ব, আরো কত কী। আর ছোট হওয়ার চিন্তা করিস না। যেমন আছিস, তেমনটা নিয়েই সুখে থাকার চেষ্টা কর।
বিজয় সালামের কথায় তাল দিয়ে বলল, হুম... কথা সত্য বলেছিস রে ভাই। যেমনই আছি তেমনটা নিয়েই সুখে থাকার চেষ্টা করবি।
বিজয়ের কথা শুনে আরিফ বলল, করো তো বিদেশে বড় দামের চাকরী। নিজের লাইফ নিয়ে চিন্তা নেই। খাও তো বিলাতি খাবার। ঘুমাও বিলাতি বিছানায়। তোমরা আর আমার কষ্ট কিভাবে বুঝবে। নিজে করি সামান্য একটা কোম্পানির চাকরী। তার মধ্যে এই দশ দিনের ছুটির জন্য স্যালারি থেকে ১৬ পারসেন্ট টাকা কেটে রাখবে। কম কথা নাকি।
- তোর এই সামান্য টাকা কেটে রাখলে কী হবে শুনি?
- অনেক কিছুই হবে। কোম্পানির চাকরি। পরিশ্রম করে কামাতে হয়।
বিজয় উপহাসের গলায় বলল, কোম্পানি বুঝি তোকে রিকসা চালাতে দেয়? যে অনেক কষ্টের কাজ।
- তেমনটাই। সারাদিন রিকসা চালাই। প্যাসেঞ্জার রিক্সায় তুলি, প্যাসেঞ্জাররা পয়সা দেয়। সেই পয়সাতেই চলি আমি। হয়েছে তোদের? এবার খুশি?
- তেমনটা হলেই তো খুশি হতাম।
- তার মানে আমাকে রিকসা চালাতে দেখলে তোরা সবাই খুশি হবি?
- অবশ্যই হবো। রিকসা চালানো তো অনেক ভালো কাজ। তুই কোনদিন রিকশাওয়ালাদের পেটে ভুঁড়ি দেখেছিস? তাদের কখনো ভুঁড়ি হয় না। আর এদিকে অফিসে বসে বসে কাজ করতে করতে আমার পেটে একটা ফুটবল গজাচ্ছে।
- আচ্ছা ঠিক আছে। কালকে থেকে তুই নিজেই রিকসা নিয়ে বের হবি। কিছুদিন রিকসা চালালে তোর ফুটবলটাকে ক্রিকেট বল বানাতে পারবি।
বিজয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, এতে সমস্যা কী? ঠিক আছে। কালকে সকালেই তোদের বন্ধু একটা রিকসা নিয়ে বের হবে। তোদের সামনে দিয়ে আমি রিকসা চালিয়ে যাবো।
বিজয়ের কথায় সায় দিয়ে সবাই বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। কালকে দেখা যাবে আমাদের বন্ধু কীভাবে রিকসা চালায়।
সন্ধ্যা নেমে আসছে। জাম গাছটার নিচে আর বসে থাকার মতো অবস্থা নেই। প্রচুর মশা। এখনে আর কিছুক্ষণ বসে থাকলে নিশ্চিত ম্যালেরিয়া বাঁধবে। তাই আজকের মতো এই জাম গাছের নিচের আড্ডাটা স্থগিত করতে হবে। সালাম উঠতে উঠতে বলল, আয় চল আজকে আবার মিতালী মাসীর ওইখানে গিয়ে চা খাই। অনেকদিন ধরে মাসীর চা খাই না।
সালামের কথা শুনে জাবেদ আর আরিফের মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে গেল। মিতালী মাসির চা ছোটবেলায় সবাই খেত। চায়ের সাথে ফ্রি ফ্রি বিস্কিট। অমন আদর আর কেউ করত না। ঠিক যেন মায়ের মতো। কোন ছেলে মেয়ে না থেকেও যেন তার অনেকগুলো ছেলেমেয়ে ছিলো। মিতালী মাসি নাকি আর এই দুনিয়ায় নেই। কিন্তু তার বানানো চায়ের স্বাদ এখনো সবার মুখেই রয়ে গেছে।
রাত দশটার দিকে বাসায় আসলো বিজয়। এসেই ঘড়টা একটু কোনরকম পরিষ্কার করে নিল। এই রুমটা বিজয়েরই। কিন্তু এখানে থাকা হয় না। রুমের কিছু কিছু জায়গাতে মাকড়সার জালে ভড়ে গেছে। কালকে সেগুলা একটু পরিস্কার করতে হবে। তা না হলে এই মাকড়সাগুলো তাকে তুলেও নিয়ে যেতে পারে। বিজয়ের বাবা এখন বাড়িতেই। আগে সরকারি চাকরি করতো। এখন রিটায়ার্ড। তাই বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকেন। তবে এভাবে বসে থাকতে তার নাকি মোটেও ভালো লাগে না। তাই সে একটা প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকের চাকরিটা নিতে চাইছে। বিজয় একবার বলেছিলো, বাবা! এই বয়সে কি তুমি পাগল হতে চাইছো? বাচ্চাদের পড়ানোর মতো ঝামেলার কাজ মনে হয় আমার জন্মে দেখিনি। তুমি সেটা পারবে না। এই শেষ বয়সটাতে আমি চাই না যে তোমার মাথাটা গোল্লায় যাক। কিন্তু তার বাবা একরাম হোসেন সেই কথা মানতে নারাজ। শেষমেশ বিজয় হেরে গিয়ে বলল, হয়েছে। তোমার যা ইচ্ছা করো।
সেদিনের মতো বিজয় শুয়ে পড়ল। শোয়ার আগে বিজয়ের বাবা বিজয়ের কাছে আসলেন। তারপর বিছানায় বসে বললেন, বিজয়! বিদেশে এখন কেমন লাগছে রে?
বিজয় বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, খুব খারাপ লাগছে বাবা। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে, সব কিছু ফেলে তোমার এইখানে চলে আসি। কিন্তু আসা হয় না।
একরাম হোসেন তার ছেলেকে বলে, তোর মা মরে গেছে তা প্রায় ১৭-১৮ বছরের মতো হবে। আমার বয়সটাও কিন্তু তখন অতো বেশি ছিলো না। আশেপাশের লোকজন তো বলেছিলো আমাকে আরেকটা বিয়ে করতে। কিন্তু আমি বিয়ে করি নি। কারণ তোর বয়স কম। নতুন মা তোর সাথে কেমন ব্যবহার করবে তা অনিশ্চিত ছিল। সেই চিন্তায় আর বিয়ে করি নি। তোকে মানুষ করাটাই ছিলো তখন আমার একমাত্র লক্ষ। আর আমি সেটা পেরেছিও। এখন আমার বয়স বেড়ে গেছে। এখন তো আর আমি তোর দায়িত্ব নিতে পারবো না। আমি ভাবছি, তুই তো এই মাসটা দেশেই আছিস। এই মাসেই তুই বিয়েটা করে ফেল।
একরাম হোসেন বিজয়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পান বিজয় ঘুমিয়ে গেছে। ছেলের কপালে একটু আদর করে বিছানা থেকে উঠে পড়ল সে। বাতিটা নিভিয়ে দিল। ঘুমাক। দেশের মাটিতে অনেকদিন ধরে ঘুমায় না ছেলেটা।
সকাল ৮ টা বেজে গেছে। আরিফ ফোন করেছে। ফোনের রিংটোনের শব্দে বিজয়ের ঘুম ভাঙে। ফোনটা রিসিভ করে বিজয়। হ্যালো!
ওপাশ থেকে আরিফ বলে, কীরে মামুর ব্যাটা? তোর ঘুম ভাঙে নি?
- হ্যা। ভেঙেছে তো।
- ওঠ তারাতারি। গতকালকের কথা মনে আছে কী?
- কীসের কথা? অনেক কথাই তো বললাম কাল।
- অইযে... রিসকা চালাবি।
- আরে! এই সামান্য কথাই তুই সিরিয়াসভাবে নিচ্ছিস?
- সিরিয়াসের কী হলো? তুই আমাদের সবাইকে কথা দিয়েছিস। আজকে সেই কথা তোকে রাখতে হবে। ব্যাস। আর কথা বলা যাবে না।
- আরে! আমি এমনি বলেছি।
- কোনো এমনি টেমনিতে হবে না। আমরা রিকসা হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তুই তারাতারি চলে আয়।
এই বলে আরিফ ফোনটা কেঁটে দিল। বেচারা বিজয়ের মুখটা এক্কেবারে চুপসে গেল। সে ঝোকের বসেই গতকাল কথাটি বলে ফেলেছিলো। এখন সেই কথার মাশুল দিতে হচ্ছে। কী আর করার। এখন সে যাবে। গিয়ে তার বন্ধুকে দেখিয়ে দিবে যে সে-ও রিকসা চালাতে পারে। রিকসা চালানো মোটেও কোন খারাপ পেশা না।
সকাল বেলা বিজয় কোন নাস্তা করল না। বিজয়ের বাবা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল। আর বলল, কীরে, এতো সকালে কই যাস?
- আরিফ ফোন করেছিলো। যেতে বলেছে।
- এতো সকালে কিসের জন্য দেখা করতে বলেছে? নাস্তা নেই পানি নেই বের হয়ে চলে যাবি?
- বাইরে খেয়ে নেব। সমস্যা নেই।
- আচ্ছা। তারাতারি চলে আসিস। আমিও বাইরে যাব। আসতে দেরি হতে পারে।
- চেষ্টা করব। আর সাবধানে যেও।
কোনরকমে বিজয় বাসা থেকে বের হয়ে আসে। বের হয়েই একটা রিকসা নেয়। তারপর রিকসা হাউজের উদ্দেশ্যে বের হয়। মনে মনে আরিফকে একশো একটা গালি দিতে ইচ্ছে হলো বিজয়ের। ঘড়িতে সারে আটটা বাজে। শীতের সকাল। শহরের বাইরে যে এতোটা শীত পরে জানা ছিল না। ঘড়ে তো দিব্বি গরম গরম ছিলো। আরিফটাও একটা পাগল। যেই শীত পরেছে। কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমা। এই আবহাওয়ায় নিজে তো ঠকঠকিয়ে কাঁপছিস, সাথে বন্ধুকেও কাপাচ্ছিস। আরো কিছুক্ষন পরে বিজয় রিকসা হাউসের সামনে পৌছায়। বিশাল বড় টিনের ঘড়। এইখানে রিকসা ভাড়া দেয় এক দিনের জন্য। ৫০০ টাকায় ভাড়া নিতে হয় রিকসা। রাত বারোটার আগে ফেরত দিতে হবে। রিকসা হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরিফ আর জাভেদ। বিজয় রিকসা থেকে নেমে ভাড়াটা দিয়ে দুজনের কাছে গিয়ে বলল, তোরা আমার বন্ধু নাকি শত্রু রে? আরিফ বলল, তুই এখন যেটা মনে করিস। জাভেদ বলল, বন্ধুই তো।
- বন্ধু হয়ে থাকলে তো এই শীতের মধ্যে আমার ঘুমের সর্বনাশ করতি না।
আরিফ জাভেদের উদ্দেশ্যে বলল, দেখেছিস, রাজার ছেলে। সকাল ৮ টা বাজে। এখনো ঘুমায়। আর এদিকে আমরা ৬ টায় উঠে গোছল করে ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে অফিসে যাই।
আরিফ বলল, আরে তেমনটা না। বাংলাদেশে কতদিন ধরে ঘুমাইনা বলতো। কোথায় বিদেশের মাটি আর কোথায় আমাদের মাতৃভূমি। এই দেশের মতো দেশ আর কোথাও নেই। আরিফ বলল, হয়েছে তোর দেশের প্রতি ভালোবাসা। আর তোর নাটক দেখতে চাই না। ছোটবেলায় স্কুলে যখন জাতীয় সংগীত গাওয়া হতো। তখন তো গাইতি না। আমাদের পিঠের মধ্যে খোঁচাখুচি করতি।
- মনে মনে তো গাইতাম ঠিকই।
জাভেদ বলল, হুম। হিন্দি গান গাইতি। শুনতাম তো।
বিজয় বিরক্তের সাথে বলল, আমাকে তোরা পেয়েছিস টা কী? এভাবে অপমান করতে তোদের ভালো লাগছে?
জাভেদ বলল, ভালো লাগছে দেখেই তো করছি। ভালো না লাগলে কি আর এভাবে বলতাম তোকে। আরিফ বলল, হয়েছে। বেচাড়াকে ছেড়ে দে। এখন কাজের কাজটা করি। ওর জন্য একটা রিকসা দেখি।
রিকসা হাউজের মালিকের সাথে কথা বলে আরিফ বিজয়ের জন্য একটা ভালো রিকসা নিল। কিন্তু ঝামেলাটা বাঁধল রিকসার ভাড়া মেটানোর সময়। রিকসার ৫০০ টাকা ভাড়াটাও বিজয়ের পকেট থেকে দিতে হবে। কী আর করার। অনেকগুলা গালি জমা হয়েছিল বিজয়ের মুখে। কিন্তু এই পাবলিক প্লেসে সেগুলো ব্যাবহার করা যাবে না। অগত্যা নিজের পকেট থেকেই ৫০০ টাকার চকচকে নোট বের করে রিকসার মালিককে দিতে হল। মনে মনে বিজয় বলল, সময় হলে এই টাকা আমি সুদে আসলে তোর কাছ থেকে গুনে নেব।
এতোক্ষন শীত ছিল। কিন্তু বেলা যতই বাড়ছে, শীতের তীব্রতা কমে গিয়ে রোদের পরিমানটা বাড়ছে। আল্লাহর নাম নিয়ে রিকসাটায় উঠে বসল বিজয়। চালকের সিটে। আর দুই ছাগল বসল পেছনে। আরিফ বলল, এই রিকসাওয়ালা। একটু বাজারের দিকে নিয়ে যাও তো।
সামনে বসে রাগে ফোস ফোস করছে বিজয়। মনে হচ্ছে রিকসা শুদ্ধ্বা দুই ছাগলকে উলটে ফেলে দিতে। কিন্তু কেন জানি পারছে না। এরা কী বন্ধু নাকি শত্রু? নিজের বন্ধুকে রিকসাওয়ালা বলবে তাই? বিজয় রাগটা কোনভাবে কন্ট্রোল করে। নিজের মনকে শান্তনা দেয়, রিকসা চালানো কোন খারাপ পেশা না। অনেকে মানুষই তো চালায়।
বিজয় রিকসা চালিয়ে যাচ্ছে। এতোক্ষন শীতের যে ভাবটা ছিল, সেটা এক্কেবারে কেঁটে গেছে। গরম লাগছে ভালোই। ঘড়িতে ৯:২০ বাজে। বাজারের সামনে এসে পরেছে তিনজনে। বাজারের সামনে নেমে আরিফ বিজয়কে বলল, এখন রিকসা থেকে নাম। আয়, এক কাপ চা খাই। চা খেলে শরিরে শক্তি আসবে। বিজয় বলল, চা তোরা খা। তোদের শক্তি দরকার। আমি খাবো না। আল্লার রহমতে আমার গায়ে ভালোই শক্তি আছে। জাভেদ বলল, তা মিথ্যে বলিস নি। ভালোই শক্তি আছে। ষাড়ের মতো।
- অপমান করলি, নাকি প্রশংশা করলি?
- এখন তুই যেটা মনে করিস। তোর ব্যাপার।
বিজয় মনে মনে বলল, আল্লাহ... এমন বন্ধু তুমি আর কাউকে দিও না। এদের সাথে আমি এতোটা বছর কিভাবে আছি? অন্য কেউ থাকলে তো এতোদিনে পাগলাগারদে থাকতো। ছোটবেলায় এই বন্ধু নামের প্রানীগুলো যে খুব ভালো ছিলো তা মোটেও না। তখন আরো বজ্জাতের হাড্ডি ছিল এরা। বিশেষ করে জাভেদ। আল্লাহ যে ওকে কী দিয়ে বানিয়ে ছিল, কে যানে। বাপ মায়ের একমাত্র ছেলে ছিল জাভেদ। এই ছেলেটা যখন ছোট ছিল। তখন এলাকার মানুষ এই ছেলের জ্বালায় গাছে পেঁয়ারা, আম, ক্ষেতে শশা কিছুই নিরাপদে রাখতে পারতো না।
একদিন স্কুলে আসার সময় একটা বড় আপু নাকি জাভেদের গালে টস করে একটা থাপ্পড় মেরেছিলো। জাভেদ কান্না করতে করতে বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে বিচার দিতে গেল। জাভেদের মা তো রেগে আগুন। ছেলের গায়ে হাত? তাও আবার ক্লাশ এইটের একটা মেয়ে? তখনি জাভেদের মা রওনা হলো মিতুদের বাড়ি। বাড়িতে গিয়ে সে কী ঝগড়া। আমার একমাত্র ছেলে। চড় মেরেছে। যদি কিছু হয়ে যেত? কে দিত জরিমানা? মিতু ঠান্ডা গলায় বলল, আগে নিজের ছেলের কাছে শুনুন সে কী বলেছে? চড় তো আর সাধে মারি নি।
জাভেদের মা তার ছেলেকে বলে, কী বলেছিস রে মিতুকে?
জাভেদ কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, মিতু আপু আমাকে ফুল দিয়ে বলল, এই জাভেদ... তোকে বিয়ে করবো। আই লাভ ইউ। আমি বলেছি, "না। আমি পারবো না।" তার পর ঠাস করে আমার মুখের উপর বসিয়ে দিল। এই কথা বলে আবার ভ্যা করে কান্না।
মিতুর চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হল। সাথে সাথে ঠাস করে আরো দ্বিগুন শক্তি নিয়ে মায়ের সামনে একটা থাপ্পড় মেরে দিল। "সত্যি বল বলছি, মিথ্যা কেন বলছিস? ফের মিথ্যা বললে আরেকটা বসিয়ে দিব গালের উপর।", মিতু ধমকিয়ে কথাগুলো বলল। জাভেদের মা যেন ঘটনাটা হা করে দেখল। তারপর জাভেদ সত্য কথাটা বলল। সে মিতুকে ফুল দিয়েছিল। মিতুর সাথে প্রেম করবে। এইটুকু বয়সে পেকে গেছে। সেদিন জাভেদের মা তার সাথে কী করেছিল কেউ জানে না। তবে পরদিন সবাই জানতে পারল, ছেলেটার খুব জ্বর।
কিছুক্ষন পর আমরা চা খেলাম। এক কাপ চা না খেয়ে আর পারলামই না। চা-টা খেয়ে আসলেই একটু ক্লান্তি দূর হল। চায়ে চুমুক দিতে যাচ্ছি এমন সময় একটা জিনিস খেয়াল করলাম। একটা মেয়ে। শাড়ি পড়েছে। মাথার চুলগুলো খোলা। গলায় ঝোলানো একটা আইডি কার্ড। কোন একটা জব করে হয়তো। মেয়েটা ছটফট করছে। একবার ডান দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার বাম দিকে তাকাচ্ছে। হাতে একটা হ্যান্ড-ব্যাগ। বিজয় কিছুক্ষনের জন্য যেন হাড়িয়ে গেল। এরকম সুন্দর মেয়ে সে আগে কখনো দেখেছে কিনা জানা নেই। বিজয় অনেক্ষন তাকিয়ে থাকার পর বুঝতে পারল মেয়েটা একটা রিকসা খুঁজছে। অনেকগুলো রিকসা থামানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু কোন রিকসাই যাচ্ছে না।
বিজয় একসময় চায়ের দোকান থেকে উঠে পড়ল। এটাই সময় মেয়েটার সাথে দেখা করার। বিজয় তার রিকসার সামনে গেল। গিয়ে রিকসায় উঠে বসল। রিকসায় আয়নাতে তাকিয়ে দেখল নিজেনে। কী আজব! নিজেকে এখন পুরোপুরি রিকসাওয়ালাদের মতোই দেখা যায়। তার কী রিকসাওয়ালা হয়ে জন্ম নেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ভুলে সে অন্য পেশায় ঢুকে গেছে?
বেশি দেরি করা যাবে না। নাহলে মেয়েটা অন্য কোন একটা রিকসায় উঠে যেতে পারে। রিকসার প্যাডেলে পা রাখতেই পেছন থেকে একটা চিকন গলার মেয়ে বলে উঠল, শ্যামপুর রেলগেটে যাবেন? বিজয় মেয়েটার দিয়ে তাকাচ্ছে আর মনে হচ্ছে সে যেন আস্তে আস্তে হ্যালুসিনেট হয়ে যাচ্ছে।
- এই ভাই! আবেন নাকি?
- কো... কোথায়?
- শ্যামপুর রেলগেট?
- যাবো যাবে। অবশ্যই যাবো। উঠে বসুন।
- ভাড়া কতো নেবেন?
- আপনার যা ভালো লাগে তাই দিবেন।
- মানে?
- মানে! যা ভাড়া তাই দিবেন।
"চলুন", বলে মেয়েটা বিজয়ের রিকসায় উঠে বসল। তারপর বিজয় সাবধানে রিকসা চালিয়ে রওনা হল মেয়েটাকে নিয়ে।
এতোক্ষন আমাদের জাভেদ আর আরিফ ঘটনাটা হা করে দেখছিলো। জাভেদ বলল, ব্যাপারটা কী হলো রে?
- আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা, তুই-ই বল।
- আমরা দুইজন রিকসাতে উঠেছিলাম বলে রাগে ফুলে গিয়ে আমাদের চৌদ্দ গোষ্ঠি উদ্ধার করলো, আর সে কিনা এই মেয়েকে নিয়ে সরাসরি রিকসায় উঠে ভোঁ... করে চলে গেল?
- এই ওকে ফোন দে তো একটা।
জাভেদ নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে বিজয়কে ফোন দিল। কিছুক্ষন পরে বিজয় রিসিভ করে বলল, "এই ফোন দিয়েছিস কেন? ফোন রাখ, ট্রিপে আছি।" এই কথা বলে ফোন কেঁটে দিল সাথে সাথে। আরিফ বলল, বুঝেছিস! লারকী কা চাক্কার হ্যা ভাই। সালা আমাদের মুখে ধুলো দিয়ে কিভাবে পালিয়ে গেল দেখলি?
- আরে, মুখে না, চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে।
- চুপ। একদম চুপ থাক। ভেবেছিলাম ওকে নিয়ে একটু রিকসা করে এলাকাটা ঘুড়বো। এখন সালা নাকি ট্রিপে আছে। ইনকাম করবে।
- হুম। পার্ট টাইম জব।
- চুপ।
Comments
Post a Comment